সারারাত জ্বলেছে নিবিড়
ধুসর নীলাভ এক
তারা
তারই কিছু রঙ নাও
তুমি...
...যা কিছু নেই
নাই বা হল
সব
পাওয়া
না পাওয়ার রঙ
নাও
তুমি
...কিছুই রাঙানো হল
না
নয়তো
আগামীর রঙে ছোপাতাম
হয়তো
এই মলিন আর
এ
ধুসর
পথ
চাওয়া
এ চাওয়ার রঙ
নাও
তুমি
...আগামীর রঙ (নাও)
দাও
তুমি
এই যে রঙগুলোকে দিচ্ছে এবং উৎসর্গোদ্যত অবস্থায় দু-হাত ভরে, যেন বা অঞ্জলি, এমনতরই সে সমর্পণ, সেই শূচী সময়ে, অনেকটা মন্ত্রোচ্চারণের মতই বলে উঠছে, আগামীর রঙটা দিতে; গানটাকে তার ইন্সেপশনের সময় থেকেই এইভাবেই শুনে এসেছি আমি; দেওয়া – নেওয়ার মধ্যে, আমারই ভিতর দ্বন্দ্ব জাগলে; যে আগামীর রঙ নেবে, তাকে এত মরা রঙ দেওয়া কেন, এমত ছিল আমার ভাবনা; - যে, সব মরা রঙ দিয়ে, পরিবর্তে, বার্টার ইকোনমি যথা, তার কাছ থেকে আশার মত, স্বপ্নের মত, ঝলমলে রঙ নিয়ে নেওয়া, ও, ফলতঃ বেঁচে থাকতে থাকা। তাই, দিতে অনুরোধ করা, নিতে নয়।
এভুল আমার হয়েছে, ইন্টারনেট সার্ফিং করে, গানটার লিরিক নিয়ে নিশ্চিত হতে গিয়ে। পরে সুমনামি বলে একটা সাইটে গিয়ে আমার দেখা হয়ে হলো গানটার সেই লিরিকের সঙ্গে, যেটা আমি পোষণ করে এসেছি।
তবে সত্যি সত্যি এমন ভুল আমার সবচেয়ে বেশী হয়েছে রবীন্দ্রগীতি শুনতে গিয়ে, পরে, সে ভুল ভেঙেছেন শ্রী সাগর চন্দ্র সেন, শ্রী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বোপরি শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা গীতবিতান স্বয়ং। একটা মানুষ এক জীবনে পঞ্চাশ কিংবা তারও বেশী বৈ কম নয়, গান লিখে গিয়েছেন, তাতে সুর বসিয়ে দিয়েছেন, যেগুলো, যতদিন সভ্যতা থাকবে, ততদিন রয়ে যাবে। এমনধারা গান। পঞ্চাশটা। একজন। একজীবনে। ভাবা যায় !
হ্যাঁ, যদি ধরে থাকেন, তো, আমার মতে ঠিক ধরেছেন, যে, এটা একটা ভালোবাসার গান, যার সঙ্গে আর একটা গানের শেষ ভার্সটা জড়িয়ে গেছে, বাঘ যেমন আঁখির আঠায় জড়িয়ে গিয়ে নড়ে বসে না, গানটাও তেমনই, গ্যাঁট হয়ে বসে গেছে আমার মগজে, যেন চোরকাঁটা, থেবড়ে বসে, খুঁটে খুঁটে তুলতে হয় সে স্তবককে –
সাত সমুদ্দুর, সাত সমুদ্দুর তের
নদী আমি নাইবা পেরোলাম
কত দুরত্ব, কত দুরত্ব কতকিছুই তো পেরোনো হয় নি
জানি শুধু এই, জানি শুধু এই তোমার হাত দুটো ধরতে
পেরেছি
এই দুরত্বটুকু পেরিয়ে ভরসা পাই আরো চলার
তুমি তুমি তুমি আমাদের চলাচলে
আরো হাত ধরে নেব আরো মুখ কাছে থাকবে
আমাদের জগত ,আমদের জগত সকলেরই ইতিহাস
আমাদের পথে যেন আলো দেয় সবার আকাশ।
ভালবাসাও তো এমনই পেলব, আর সেজন্যই তো আলোকিত হয়ে থাকুক তার চলার পথের সবটুকু, তাকে তো কারোর আঘাত দেওয়ার কথা নয়; তেমনই তো শুনে এসেছি গুরুজনেদের কাছে, যে, ভালোবাসার ভার বয়ে চলা, প্রত্যেক খ্রীষ্টানের নিজের ক্রশ নিজে বয়ে নিয়ে চলা যেমন, কতই না কষ্টের; কত ভালবাসার কুঁড়ি তাই তো ফুল হয়ে ফোটে না, তার আগেই ঝরে যায়। অর্থাৎ ভালবাসাকে সময়ের রেখার ধার ধরে বইবার জন্য একটা সবল কাঁধ চাই। সে কাঁধ থাকলে ভালবাসা চিরত্বের মর্যাদা পায়, যার জন্য তার জন্ম। আর এরকমের চারটে সবল কাঁধে চেপেই ভালবাসার খোলস, কি ইলেকট্রিক ক্রিম্যেটরে, কি মাটির তলায় সেঁধিয়ে যায়। রয়ে যায় ভালবাসার আত্মা। এইরকম কত স্পিরিটে যে ভালবাসা ভরে আছে পৃথিবী জুড়ে, জ্ঞানচক্ষু থাকলে টের পাওয়া যেত। তাদের।
আচ্ছা, এই যে এইরকম ভাবছি, এটা কি নেহাতই একটা আরবান ভাবনা নয়? ভালবাসা; সে কি নগর আর গ্রাম্য জনপদে আলাদা হয়ে যায় না? ফেলে আসা কৈশোর থেকে আজ, এই মুহূর্ত অবধি, যা যা ভেবেছি ভালবাসা সম্পর্কে, যা যা ভালবেসেছি, সেগুলো কি শহুরে বৈশিষ্ট্য দিয়ে পাঙ্কচুয়েট করা নয়? এই যে লিখতে বসে, এত কমা, সেমিকোলন দাঁড়ি দিয়ে বাক্যগুলোকে সাজাচ্ছি, এর ভেতরও কি নাগরিক ভাবনা ঘাপটি মেরে বসে নেই, যে, বাক্যগুলোকে ঠিক করে দিতে হবে, এবং এটা কি প্রকারান্তরে নিজের ভাবনাটাকে মূলতঃ চারিয়ে দেওয়া নয়? মুখে বারংবার বলছি যে পাঠক মেধা-মননকে যথোপযুক্ত সম্মাননা দিয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য যথাবিহিত হ্যান্ড হোল্ডিং সাপোর্ট, লেখককেই দিতে হবে, অথচ, লেখার মধ্যে কি প্রকৃত প্রস্তাবে, আমি কি পাঠক মেধাকে সম্মান করছি? আদপে?
গ্রামের কথা ভাবা যাক; গ্রামের মানুষের মধ্যে নাকি খুব সারল্য আছে এবং সেটাকে নাইভ বললে সারল্য আর শহুরে মানুষকে বললে নির্বোধ তথা গাড়ল। শব্দার্থ এভাবে জিওগ্র্যাফিক্যাল টেরিট্যরি পাল্টালে পুরোপরি লাট খেয়ে চোখ ওল্টায় ! একটা মিয়্যার শব্দ যদি করতে পারে এটা, তাহলে, ভালবাসার গোটা ধারণা শহরে আর গ্রামে কি করে ইন্ট্যাক্ট থাকবে? শহরে ভালবাসা নাকি অনেকটা বেশী কাব্যিক, কাব্যিক কেননা শহরে শিক্ষা আছে বলে; তুলনায়, গ্রামে তো নিরক্ষরদের ভিড়, সেখানে ভালবাসা কাব্যিক হবে কি করে? অর্থাৎ ভালবাসার কাব্যায়নকেও আমরা ছকে ফেলে দিয়ে উঠতে পেরেছি। তাহলে, কোথায় গিয়ে পোয়েটিক জাস্টিস পাবে, ভালবাসা? গ্রামের মেঠো পথ বা আল ধরে, মাথায় খড়ের আঁটির বোঝা, এক মধ্যবয়সের দম্পতি ফিরছে ঘরের দিকেই। তাদেরও নিজেদের মত করে সচ্ছ্বলতা আছে। ঘরেতে হয়তঃ তাদের সন্তান ইলেকট্রিক নিওন টিউব বা পাওয়ার কাট হলে, কেরোসিন কুপি বা জ্বালানর চেষ্টায় আছে; অর্থাৎ কিনা, মোটের ওপর পর্যাপ্ত আলো, যেখানে পড়া-লেখার কাজটা সুসম্পন্ন হয়। আলপথ ধরে খড়ের বড়গোছের আঁটি মাথায় করে বয়ে নিয়ে তাদের অরব হেঁটে চলার মধ্যে কি ভালবাসা নেই, প্রতিটা মুহূর্ত দিয়ে যেটাকে মার্ক করা যায়? আমাদের নগুরে ভালবাসাকে চিহ্নিত করা যায়, কারণ তার থেকে ঠিকরে বেরয় দেখনদারির ছটা, আর গ্রামের আলপথের ওই দুই মানুষ-মানুষীর ভালবাসার প্যারোকিয়াল পার আছে, তার থই-কূল নাকি পাওয়া যায় সহজেই, যেহেতু সেটা, নৈঃশব্দ্যের অলঙ্কারে সেজে আছে বলে? অথচ, দিনের শেষে কিন্তু, নীরবতার শব্দ খুঁজে নিতে সবাই-ই উথাল হয়ে ওঠে, বিশেষ করে নগর-জগতের লোকেরা। সেই অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে গেঁয়ো, শব্দহীন কিন্তু অথই ভালবাসার হাতে ওঠে না ট্রফি, বিজয়ীর বরমাল্য যেমন?
ভালবাসার দোহাই পেড়ে যতই গ্রাম আর শহরকে আলাদা করার প্রয়াস হোক না কেন, আমরা কি জানি না, যে, একটা গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক আছে নাটকের সে অংকে; - মৃত্যু। আমরা কি জানি না, যে, এই তো জীবন, এই দাহ যেমত; নাহ, এখানে, আদতে, কোন লোলা নেই, কোন লুলু নেই, থাকার কথাও নয়; যেমন থাকবে না হিংসা, বিবাদ, লোভ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, যখন সাধের এই দেহটাও, যেখানে কিনা চামড়া দিয়ে মোড়া আছে ক'খানা এই হাড়, চোখ বুজলে সবই তো শেষ, এবং, নেই যে কিছু আর; শুধু পড়ে থাকবে একমুঠো সাদা ছাই, পিছনে পড়ে রবে সবকিছু, যা কিনা পার্থিব; মান্ডেন পৃথিবীর সঙ্গে সময়ের যত কিছু হিসেব নিকেশ, যা চিতাতেই সব শেষ। তাহলে কি কিছুই থাকবে না? কে বলেছে থাকবে না? নিশ্চয়ই থাকবে, থেকে যাবে ভালবাসার সেই স্পিরিট, যে স্পিরিট নিয়ে মানুষের জন্য আগামীর রঙ চাওয়া হয়েছিল, যে স্পিরিট বলেছিল, দিন দুই তিনের জন্য ভবে, কত্তা বলে সবাই মানে, সে কত্তারে দেবে ফেলে, কালাকালের কত্তা এলে। বলেছিল, ক্ষমা করো সবে, বলে গেল ভালবাসো, অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো। বলেছিল, দু'দিনের এই ভবে এসে, মানুষকে যাও ভালবেসে। বলেছিল, মানুষকে যে ভালবাসে সেই তো আসল খাঁটি, কবর দাও বা চিতায় পোড়াও মরলে সবাই মাটি। সেই মাটি নিয়ে মাটি হওয়ার আগে কাঁদতে থাকা মানুষগুলোর পাশে এসে মানুষ হয়ে দাঁড়াতে হবে, এই ইচ্ছে নিয়ে, যে, ইচ্ছে করে সবার দু-হাত ভরে উঠুক, সবার রান্না ঘরে ভাতের গন্ধ ছুটুক, ফুলের চেয়ে ভাতের গন্ধ ইচ্ছে করে, আমার দেশে, সবার দেশে, সবার ঘরে। ফুলগুলোকে তাই বলে কি বাদ দিতে চাই? শস্য এবং ফুলের জন্য গান গেয়ে যাই... সেই ভাল থাকার গান গাইতে গাইতে মানুষের হাত ধরতে হবে, সে কিছু বলতে চায়, তার সেকথা শোনার আগে, মুখে যদি রক্ত ওঠে, সেকথা তখন বলা পাপ। অবশ্যই কিছু গান, ভালবাসা, সমবেদনা এইটুকুই মাত্র সম্বল হয়ে থাকবে; মানুষ বড়ো একলা, তাহার পাশে এসে দাঁড়ানর জন্য, হেসে দাঁড়ানর জন্য, ভেসে দাঁড়ানর জন্য, ভালবেসে পাখির মত দাঁড়ানর জন্য। ভালবাসা, নাগরিক – গ্রাম্য ভেদাভেদ ভুলে, তার ঊর্দ্ধে উঠে, কোন একজনকে নয়, সমস্ত মানুষের জন্য ভালবাসা, যে ভালবাসাকে ভালবাসা যায়।
আর কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে তিনি ভালবেসেই সব দেখছেন আর হাসছেন মিটিমিটি। সশস্ত্র হোক, বা অস্ত্রের গৌরবহীন, একা; - মগজে ভালবাসা, মুখে গান, হাতে মানুষের হাত, পায়ের নীচে দেশের মাটি। হ্যাঁ, মানুষ হয়ে জন্মেছি যে কালে, সে কালে যদিও আমাদের বলার বা করার কিছু ছিল না; তবুও জন্মাতে যখন একবার হয়েইছে, আমাদের মানুষের মতই বাঁচতে হবে।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটোকার্টসিঃ গুগল ইমেজেস।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment