# ১
দূর না হলেও মাঝারি পাল্লার লোক্যাল গ্যালপ ট্রেন, যখন কিনা পুরো গতিতে, তার দরজার মাঝখানের হ্যান্ডেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বিকেলের আকাশ দেখার আনন্দ-ই আলাদা। এর সঙ্গে যদি হয়ে যায় গোধূলি, তাহলে, আমার বাবার কথা মনে পড়ে। আমি বারবার ভেবেছি কেন এমন হয়, অনেক ভেবে এই বুঝেছি যে, অম্লান গোধূলির মতোই, বোধহয়, নিষ্কলুষ ছিলো বাবা, অন্ততঃ, আমার কাছে।
গ্যালপ ট্রেন তার গতি নিয়ে, জীবন যথা, ছুটে চলে, ধূলো ওড়ে ষ্টেশনের, যেমন বেঁচে থাকা; অতীত, বর্তমান সব একাকার হয়ে ঘুলিয়ে ওঠে। ওড়ে কাগজের ঠোঙা বা প্লাষ্টিক, পিছ-জীবনের কোনো বড়ো - সড়ো ঘটনা মাফিক, প্রথম প্রেম যেমন; - সেইরকমই কিছু কবিতার তুলো ওড়ার মতো করে ওড়ে।
বাবার হাত ধরে, সুদূর সে ছোটবেলায়, কোথা থেকে যেন ফিরছিলাম, সেটা মনে নেই, কিন্তু, এটা স্পষ্ট মনে আছে, সে বিকেলে তখন গোধূলি থইথই করছিলো; বাবা, যে আমায় কোনদিন বাইরের খাবার খেতে দিতো না, সেই বাবা-ই নিজে থেকে বলেছিলোঃ বাবি, কুলপি খাবি?, বলে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই কিনে ফেলেছিলো দুটো বড়ো সাইজের কুলপি।
সেই কুলপির স্বাদ, গন্ধ নিতে নিতে, গোধূলির মধ্যে দিয়ে, যেন চাঁদোয়া, আমরা বাড়ী ফিরেছিলাম।
আর এই তো সেদিন, বাবার ডান চোখের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে ফেরার সময়, তখন অবশ্য রাত, যদিও আকাশ ছিলো অদ্ভূত রকমের লাল; ডাক্তারের বাড়ী থেকে বেরিয়েই বাবা বলেছিলো যে বৃষ্টি হবে, সেই আসন্ন বৃষ্টির তলা দিয়ে আসতে আসতে, এক ফুচকাওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে বাবা নিজে থেকে বলেছিলোঃ বাবি, ফুচকা খাবি? বলে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফুচকাওয়ালার সামনে গিয়ে বললোঃ দাও, তো বাবা, ফুচকা। খানচারেক খেয়ে বাবা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলোঃ তুই খা, ভালো লাগলে, বলে রুমালে, নস্যি ভর্তি রুমালে মুখ মুছে নিয়েছিলো; আমি আরো খান কুড়ি পঁচিশ খেয়ে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। ফাউ হিসেবে বাবার জন্য চেয়ে দিয়েছিলাম টক জল ছাড়া একটা ফুচকাকে।
অতঃপর সেই ফুচকার স্বাদ, গন্ধ বাঁচিয়ে রাখতে রাখতে, যখন কিনা রাতের আকাশ রক্তাভ, সেই লালিমার সামিয়ানার তলা দিয়ে আমরা বাড়ী ফিরেছিলাম।
দুটো ষ্টেশন, মধ্যে অনেক দুরত্ব, গ্যালপ দাঁড়ালো না, ধুলো উড়লো, উড়লো কাগজের ঠোঙা এবং প্লাষ্টিক-ও, দুটো ষ্টেশনেই, শুধু আমি দেখিনি, খেয়াল করিনি, আসলে, সম্ভবতঃ মগজ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো, যে, ডেষ্টিনেশন আসতে চলেছে।
বাবা বলতে আমার কি মনে পড়ে? প্রথমেই, চান করে এসে ভিজে গায়ে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে কিছু বিড়বিড়ানি, কোনো অসহায় মানুষ (বাবা ভিখারি শব্দটাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতো, আমায় শিখিয়েছিলো অসহায় মানুষ বলতে, আমি আজও তা-ই বলে থাকি; কি ছুটির দিন, কি অফিসের দিন, আঙিনায় এলে), একজন অসহায় মানুষ এসেছে বলে তার সঙ্গে দু-এক কথা, তাকে খেতে দেওয়া, ফ্রিজের ঠান্ডা জল দেওয়া।
…আর মাছের প্রতি দুর্নিবার প্রেম, সত্যি বলছি, বাটা মাছ অতো তাড়াতাড়ি আমি আজ পর্যন্ত কাউকে খেতে দেখিনি; যাই হোক, যেটা বলছিলাম, খেয়ে দেয়ে ফিটফাট বাবুটি না হলেও, ভালো পোশাক পরে সাইকেল চালিয়ে ষ্টেশন অবধি যাওয়া, তারপর ট্রেন, তারপর সামান্য হেঁটে অফিস। শেষদিকে এটা পাল্টে হয়ে গিয়েছিলো বাইক, বাড়ী থেকে অফিস, অফিস থেকে বাড়ী, সটান। চা–হাল্কা স্ন্যাক্স খেয়ে, অতঃপর তাস খেলতে যাওয়া।
# ২
তখন প্রথম প্রেম, আজকালকার ভাষায় যেটা ক্রাশ; আন্দাজ করেই একপ্রকার, বাবা, একদিন, অফিস যাওয়ার আগে খেতে খেতে জানতে চেয়েছিলো যে, আমি মেয়েটাকে ভালবাসি কিনা, তারপর যা বলেছিলো, সেটা আমার ইন ভার্বাটিম মনে আছেঃ দেখিস বাবি, ওরা কিন্তু ব্রাহ্মণ, অনেক শিক্ষিত বংশ; ওর বাবা-মা দুজনেই টিচার আর অনেক বড়লোক, যা করার, বুঝে শুনে করিস বাবা, কেমন, এই কথা শুরুর সময় বাবা বাটা মাছ ভাজা খেতে শুরু করেছিলো, কথা শেষ করার পর, মাকে হেঁকে বলেছিলোঃ কই, চাটনি দাও।
আর মনে আছে, রিটায়ারমেন্টের পর ক্রমশঃ প্যারাসাইট হয়ে যাওয়া, অ্যাগোরাফোবিয়াতে আক্রান্ত, এক বৃদ্ধ, বাড়ী-বাজার-নির্দিষ্ট মুদির দোকান-বাড়ীর ট্যাঙ্কে জল তোলা-দুপুরে ঘন্টা খানেক ঘুম-সান্ধ্য তাস খেলতে যাওয়া-বাড়ী – এই ছিলো যার সুপার অ্যানুয়েশনোত্তর জীবনের দৈনন্দিন যাপন। মাঝে মধ্যে ছিলো, মুদির দোকানের লোকজনদের সঙ্গে দু- তিন দিনের জন্য পুরী বেড়াতে যাওয়া, যেটার পুরোটা কোভিডের লক ডাউন এসে তছনছ করে দিলো।
একবার, তখন কোভিডের লক ডাউন কাল, আমার পেট খারাপ হয়েছিলো, যা একেবারেই বিরল ব্যাপার, বাবা এক সন্ধ্যায় তিনবার জিজ্ঞাসা করেছিলো কেমন আছি, ডাক্তার ডাকতে হবে কিনা, আমি মাছি ওড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিলেও বুঝতে পারছিলাম, বাবা টেনশন করছে।
আর বাবা বলতে মনে পড়ে, আমাদের বাড়ীর সামনের ছোট্ট জমিতে পুঁই মাচা, কুমড়ো গাছ, লাউ গাছ, পেঁপে গাছ, বেগুন গাছ আর কিছু মরসুমী ফুল গাছ, যার দু-একটা জয়িতার পছন্দের এবং খালি গায়ে মূলতঃ নীলের শেডে বড়ো বড়ো চেকসের লুঙ্গি পরা বাবা, গাছগুলোর প্রতি অবিরাম তদারকে, এমনকি ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরেও। যাকে হাউসহোল্ড চ্যোরস বলে, তার অনেকটা করেও, বাগানের প্রত্যেক গাছে মরসুমী ফুল, ফল ফলানো আমার বাবা লোকটা, ইদানীং বাইরের পৃথিবীর সামনে কেমন যেন থতমত খেয়ে যেতো।
# ৩
বলে নেওয়া যাক, বাবা বলতে এই যে মনে পড়া, এগুলো সব-ই অ্যাডেনডাম বা বলা চলে, রেফারেন্স নোটস; বাবা, আমায়, সেই ছোট্টবেলা থেকে যা দিয়েছে, তা হলো, গান। আমি মায়ের কাছ থেকে পরে শুনেছি যে বাবা প্রথম দিকে শ্যামল মিত্রের গান খুব গাইতো, কিন্তু, আমি আশৈশব যা শুনেছি, সবটাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কখনো প্রাইভেট রেকর্ড, কখনো সিনেমার গান, কখনো বা রবীন্দ্রসঙ্গীত; - সেই কিন্ডারগার্টেনের সময় থেকে আমার জীবনে ভরপুর গান। মনে পড়ে, ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছায়াছবির একটা গান, যাই চলে যাই এবং বেসিক ডিস্ক থেকে একটা গান, আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো, শুনে সেসময় বিস্তর কাঁদতাম; সেদিক দিয়ে দেখলে নিরুদ্দেশ তথা মৃত্যু-চেতনা আমার বাবা-ই আমার মধ্যে ইন্ট্রুড করে দিয়েছিলো। ভাগ্যিস করে দিয়েছিলো।
আবার এমন অনেক সিনেমা আছে, যা আমি দেখিইনি, বাবার বলা সিচুয়েশন থেকে কল্পনা করে নিয়েছি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, - ‘স্বরলিপি’ চলচ্চিত্রে একটা গান ছিলো, ‘দয়াল রে, কতো লীলা জানো, যে জলেতে তুমি তৃষ্ণা মেটাও, সেই জলেতে কেন মরণ হানো’, বাবাকে জিজ্ঞেস করায় বাবা বলেছিলোঃ ‘বন্যা হয়েছে, বুঝলি। চারিদিকে শুধু জল আর জল। ফসলের ক্ষেত, পুকুর, রাস্তা, মেঠো বাড়ী সব একাকার হয়ে গেছে। এর মাঝখানে ক্ষেতের আল ধরে একটা লোক, কাঁধে একটা বাচ্চা, আর এক কাঁধ থেকে বড়োসড়ো পোঁটলা ঝুলছে, মাথায় বাঁ হাত দিয়ে একটা চুবড়ি ধরা, এক কোমর জল ভেঙ্গে চলেছে আর গানটা ভেসে আসছে। আমি আর কোনোদিন-ই সিনেমাটা দেখবো না, কারণ ওই বলাটা আর অফুরান সাদা-কালো সিনেমা দেখার দৌলতে, আমি, সিনেমাটা না দেখেই সিচুয়েশনটা ভিসুয়ালাইজ করতে পেরেছি, আর পেরে, তখন বাবা আর নেই, সেই কল্পিত দৃশ্য এবং বাবার কন্ঠস্বর ভেবে কেঁদে-ও ছি।
এছাড়া বাবা ছিলো আমার নস্ট্যালজিয়ার আধার। আমি এই পৃথিবীকে কোনোদিন-ই ভালোবাসিনি, আমার ভালোবাসা পড়ে আছে সেখানে, যেখানে এতো টেকনোলজি নেই, এতো সোডিয়াম ভেপার বা নিওন নেই, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নেই, আলট্রা এল ই ডি ফোর কে কার্ভড টিভি নেই, ইনভার্টার এ সি নেই, ষাট ওয়াটের হলদে বাল্ব যেখানে আলো দেয়, যেখানে এতো এফ এম নেই, আছে শুক্রবারের কোলকাতা ক এর সন্ধ্যা আটটা দুইয়ের নাটক, সেই নাটক শুনতে শুনতে মা, দিদি (মাতামহী) এবং মণি মা (মামীমা) -এর তরকারী করা, রুটি সেঁকা, সেই পৃথিবীতে। তো, সেই পৃথিবীর গল্প শুনতে আমার আগ্রহ প্রচুর, আমার বাবা, খুব সম্ভব, এটা আঁচ করতে পেরেছিলো। বাবার মুখে সেসময়ের; এমনকি, বাবার কৈশোরবেলার সোনারপুর – রাজপুরের গল্প কতো যে শুনেছি। সবকটাকেই প্রথম জীবনে অর্থাৎ কৈশোরে ভেবেছি, সভ্যতা আসার গল্প, আর আজ বুঝি, ওগুলো আসলে ছিলো সভ্যতা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাপঞ্জী।
# ৪
বাবাকে আমি প্রায়শঃ বলতাম তুমি আরো দুটো ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে পাবে, বাবাও মেনে নিয়ে বলতো যে, আমাদের পরিবারে গড় আয়ু পঁচাশি – ছিয়াশি, বরং মায়ের দিকে কম, অনেক অকালমৃত্যু মায়ের দিকে ছড়িয়ে আছে সেখানে হরির নুটের বাতাসার মতন; মায়ের ক্যানসারটাও আমাদের চিন্তায় রাখতো। বাবাকে দেখেই সবার মনে যেটা আসতো, সেটা হলো, সুঠাম চেহারার লোক, মেপে জীবন কাটায়, সুগার বলে মিষ্টির দিকে তাকায়-ই কম, নিজেকে নিজে রেস্ট্রিকশনে বেঁধে রাখে; বাবার থেকে মায়ের জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা অনেক বেশীই ছিলো। জানি না, আসন্ন কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ আমি কিভাবে, কার সঙ্গে দেখব; হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান তো আর শুনি না, বা বলা ভালো, শুনতে পারি না, ২০২১ সালের ১৬-ই জানুয়ারীর পর থেকে; আমার জীবনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে এনে দিয়েছিলো বাবা, আবার সঙ্গে করে নিয়েও চলে গেলো !
বাবার কথা বলছি আর আমের প্রসঙ্গ উঠবে না, তাও কি হয় ! বিয়ে বাড়ীতে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানবাড়ীতে বাবা যেমন চার পিসের কম মাছ না খেয়ে ছাড়তো না, অবশ্য অন্য কিছু তেমন খেতো না, কিন্তু, বাড়ীতে, ওই মাছ আর আম...
সেই কাঁচা আমের অম্বল থেকে শুরু করে তখনো-তৈরী-না-হওয়া-গোলাপখাস, তারপর একে একে হিমসাগর, বোম্বাই, ল্যাংড়া থেকে ফজলি অবধি, এমনকি ফজলির পরেও চৌসা আমের নামে বিদঘুটে স্বাদের আম অর্থাৎ আদৌ চৌসা নয়; তখন বর্ষার মাঝামাঝি, কিন্তু আমের আমদানির শেষ নেই; বাবা আয়েশ করে আম খেতে খেতে একটাই কথা বলতোঃ মাছ আর আম এইদুটোর জন্য আবার আমাকে জন্মাতে হবে। আম আর ইলিশ – পর্যায়ক্রমে তখন আসছে আর সটান পেটে চলে যাচ্ছে।
আমি চাকরী থেকে রেজিগনেশন দিই ২০১৬ সালের শেষে, আমার কর্মক্ষেত্রের অসুবিধা শুনে বাবা বলেছিলোঃ তুই চাকরী ছেড়ে দে। আমাদের যা আছে, তাতে তোর শাক-ভাত জুটে যাবে। তখন মা সবে নার্সিংহোম থেকে ফিরেছে, বাবা তখন বোঝেনি, মাল্টিপল মাইলোমা কি ধরনের রোগ এবং এর চিকিৎসার জন্য খরচা কেমন; যখন বুঝেছিলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, যে চাকরীই আমি দেখি না কেন, দেখতে পাই, আমি তার বয়সসীমা পেরিয়ে গেছি, এছাড়াও, কোনো এক ইন্টারভিউ ক্র্যাক করলে সে ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রীর ফোনঃ কল লেটার আসবে কিন্তু আমি যেন সেটাকে অ্যাক্সেপ্ট না করি, এই সরকার যতোদিন থাকবে ততো আমার কোনো চাকরী হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি; আমার কাছে সেই কলের রেকর্ড আছে, প্রয়োজনে পেশ করতে পারি, যে, মিথ্যাচারণ করছি না। আমার বাবা ছিলো ব্যাঙ্কার, দেখতে পেতাম, বাবা কেমন যেন অবাক হয়ে যায়, যে, এ’রকম-ও হয়; মন্ত্রী নিজে ফোন করে চাকরীতে জয়েন করতে বারণ করে, আমি হাসতাম, বলতামঃ বাবা এটা ২০২০ সাল। এখানে ওমনটা হয়েই থাকে, তুমি পার্কষ্ট্রীট, কামদুনি দেখোনি, শোনোনি, পড়োনি? তার তুলনায় এ আর কি এমন।
কিন্তু বাবার এই অবাক হওয়াটা সময়ের এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে শঙ্কার দিকে এগোচ্ছিলো, বাবা চলে গেলে আমার কি হবে এটা বাবাকে রীতিমত ভাবাতো এবং বাবা চুপ হয়ে যাচ্ছিলো। মায়ের চিকিৎসা, আমার নানারকম খরচ, প্রতিদিনের খাওয়ার খরচ, যে বাবা কোনোদিন খাওয়ার ব্যাপারে কোনোদিন কমতি করেনি, দু–তিন টুকরো মাছ যার অভ্যাস ছিলো, সেই বাবা একটা কন্সট্রেন্টের ভিতর রাখতে চাইছিলো সংসার খরচকে, যাতে মায়ের চিকিৎসাটা ঠিকঠাক হয়; জয়িতা তার স্বল্প আয় থেকে যতোটা সম্ভব বাবাকে সাহায্য করতো, এক আমিই কিছু করতে পারিনি।
# ৫
বাবার ডান চোখের একটা বড়োসড়ো অপারেশন করানোর ছিলো, অপটোমেট্রিষ্টের কথা চালাচালি আমার-ই হতো, ডেট-ও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। এই সময় বাবাকে একটু বিষণ্ণ দেখতাম, সবই করছে, এমনকি মায়ের জন্য ইরিথ্রোপৈয়েসিস ষ্টিমুলেটিং এজেন্ট ইঞ্জেকশন আনানোর অর্ডার দিয়েছি কিনা, সে বিষয়েও তাড়া লাগাচ্ছে, কিন্তু, কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছিলো, আমি অনুভব করতে পারছিলাম, কিন্তু ঠিক কোথায়, সেটা ধরতে পারছিলাম না।
একদিন জয়িতা অফিসে বেরিয়ে গেছে, আমি ঘুম থেকে উঠে কি করবো ভাবছি, বাবা বসেছিলো একটা বেতের চেয়ারে, খুব নীচু গলায় হঠাৎ বলে উঠলোঃ জানিস বাবি, আমি আর বেশীদিন বাঁচবো না। আমি, প্রথমে, ভাষা হারিয়েছিলাম, কারণ বাবা পেসিমিষ্টিক কথা বিশেষ বলতো না; তারপর ভাষা খুঁজে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ কি হয়েছে, তোমার? এইরকম কথা বলছো কেন? বাবা, তার আগের দিনই সেলুন থেকে ঘুরে এসেছে, ঝকঝকে গাল আর সরু গোঁফের মাঝখান থেকে বলেছিলোঃ জানি না রে, আমার ভিতর থেকে কে যেন একটা বলছে, তুই আর বেশীদিন নেই। এই কথার পর পৃথিবীর সর্বত্র নীরবতা নেমেছে, চিরদিন, এক্ষেত্রেও নেমেছিলো। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম বাবাকে খুব তাড়াতাড়ি একটা সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সেই রাতেই ডিনারে মুলো পোস্ত রান্না করেছিলো মা, আমি দু চক্ষে এই মুলো জিনিসটাকে দেখতে না পারলেও, বাবার ভীষণ প্রিয় ছিলো এই মুলো পোস্ত; এমনকি জয়িতা বিয়ের আগে মুলো না খেলেও, এখানে এসে দিব্যি খেতো এবং আমায় টীজ করে বলতো এবং এখনো বলেঃ কি খেলি জীবনে, শুধু মাংস ছাড়া; যে গরু, মোষ, শুওর, উট খেতে পারে, সে মুলো, নিম-বেগুন খেতে পারে না? জবাবে, আমার একটাই বাক্য যথেষ্ট বলে আমি মনে করি এবং সেটাই বলে থাকি, যে, ভীল কি চেভন কি মাটনে তো ওইরকম উৎকট গন্ধ নেই, বরং পিঁয়াজ, রসুন, আদা ঠিকমতো দিলে অপরূপ গন্ধ বেরোয়, যা কিনা স্বর্গীয়।
আমাদের শুতে শুতে চিরকালই রাত হয়, বাবা একটু আগে শুতো, কারণ ভোরের মিউনিসিপ্যালিটির জল ধরতে হবে। এরপর যা কিছু, তার সবটাই প্রায় অন্যদের মুখে শোনা, শুধু পরের দিন সকালের মায়ের আর্তরবটুকু বাদ দিলেঃ বাবি, দেখ তোর বাবা কেমন করছে। আমি ওঠার আগেই জয়িতা উঠে গিয়েছিলো। আমি উঠে কোনোদিকে না তাকিয়ে বাবার জিভের তলায় সরবিট্রেট দিয়ে জয়িতাকে বলেছিলামঃ অ্যামবুলেন্স ডাক। ততোক্ষণে বাবার বাঁ হাত দিয়ে নিজের মাথায় হাত বোলানো দেখে বলেছিলামঃ বাবার বোধহয় সেরেব্রাল অ্যাট্যাক হয়েছে। তখন মায়ের মুখে শুনলাম রাত দেড়টা নাগাদ বাবা একবার ওয়াশরুমে গিয়েছিলো এবং ফেরার সময় মাকে কিছু একটা খুঁজতে দেখে বলেছিলোঃ এখনো শোওনি ! মা, প্রত্যুত্তরে বাবাকে বলেছিলো যে পোশাকটা পরে মা শুয়েছিলো, সেটা খুব টাইট লাগায় মা লুজ কিছু খুঁজছে।
আমি আর জয়িতা একমুহুর্ত দেরী করিনি, অ্যামবুলেন্স এলেই, বাবাকে তুলে, সবচেয়ে কাছের নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। বাবাকে ওরা আই সি ইউ তেই অ্যাডমিট করে নিলো, আমি লাইফ সেভিং ড্রাগের কথা তুললে, এমনভাবে আর এম ও আমার দিকে তাকিয়েছিল, যেন, আমি… তখন, আর এম ও, লোকটা বোধহয় নাটকও করে, নচেৎ, ডায়ালগ ডেলিভারির কায়দা তথা টাইমিং জানে কোত্থেকে, জানালো যে, বাবার ডান সাইডটা পড়ে গেছে, মানে, প্যারালাইজড, সঙ্গে বাকশক্তিও। জানলাম এবং আরো জানলাম, বাবাকে যে বড়ো ডাক্তার দেখবেন তিনি আসতে আসতে নাকি ন’টা – সাড়ে ন’টা বাজবে, আমি মোবাইলে দেখেছিলাম সাতটা চল্লিশ বা তার কাছাকাছি কিছু; জয়িতাকে বললাম অটো ধরে বাড়ী পৌঁছে রিফ্রেশড হয়ে আসতে। জয়িতা চলে যেতে, পাশের চা এর দোকানে গিয়ে বড়ো ভাঁড়ের এককাপ চা আর সিগারেট অনেকটা চাঙ্গা করে তু্ললো আমাকে, নতূন উদ্যমে আমি এখানে কাছেপিঠে কোথায় পেটাই পরোটা পাওয়া যায়, জেনে নিয়েছিলাম, বাইরের খাবারের মধ্যে এটাতেই আমি সবথেকে অ্যাকাস্টামড। সে দোকানে গিয়ে পেটাই পরোটা আর খুব ঝাল দেওয়া চানা, মানে, কাবলি ছোলার তরকারী খেয়ে, ফিরে নার্সিংহোমের ওয়েটিং চেম্বারে বসে আছি; একবার কায়দা করে, ওপরে উঠে বাবাকে দেখে এলাম, নাক ডাকছে খুব, বেশ প্রশান্তভাবেই। নীচে নেমে এসে দেখেছিলাম, জয়িতা এসে গেছে, ওকে কিছু বলার আগেই এসে গেলো সেই সে, যার নাম বড়ো ডাক্তার।
বড়ো ডাক্তার রোগী দেখতে বেশী সময় নিলেন না, সব পেশেন্ট পার্টিকেই বলা হচ্ছিলো যে তাদের পেশেন্ট বাঁচবে না, কারণ সবাই-ই নাকি বড়ো দেরী করে ফেলেছে। আমাদের টার্ন এলে বড়ো ডাক্তার বলে দিলেন, যে, ডান সাইড আর স্পীচ ফাঙ্কশন করছে না, সেরেব্রাল অ্যাট্যাক হয়েছে এবং সিটি স্ক্যান রিপোর্ট না দেখে তিনি এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে পারবেন না।
এগারোটা নাগাদ আবার অ্যামবুলেন্স এবং এবারের গন্তব্য বেশ দূরের একটা ল্যাব, যেখানে নাকি খুব ভালো সিটি স্ক্যান করা হয়। বাবাকে অ্যামবুলেন্সের একপাশের বিছানা তো আর বলা যায় না, বেঞ্চে শুইয়ে, উল্টোদিকের বেঞ্চে আমরা বসতেই অ্যামবুলেন্স ছেড়ে দিলো এবং আমরা তীরবেগে ছুটে চললাম সেই ল্যাবের উদ্দেশ্যে, যেখানে নাকি খুব ভালো সিটি স্ক্যান করা হয়। গাড়ীর মধ্যে আমি বাবার বাম হাতটা একবার ধরতেই সেটা খুব জোরে আমার পাঞ্জাকে চেপে ধরলো, আমি একটু অবাকই হলাম, বাবা কি কিছু বলতে চাইছে? বাবার ভিতরে কি তাহলে এখনো জ্ঞান আছে? আমি যতক্ষণ বাবার হাতটা ধরেছিলাম, একমুহুর্তের জন্যও বাবার পাঞ্জার চাপ কমেনি। আমি জয়িতাকে এ’কথা বলতেই ও বাবার হাতটা ধরতে চাইলো, আমি বাবার হাতটা ছেড়ে দিতেই ও ধরে নিলো বাবার হাতটা, খানিক পরে দেখলাম ওর দু-চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নেমে গাল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
বাবাকে সিটি স্ক্যানের জন্যও পাঠিয়ে আমরা দুজন, বাইরে বেরিয়ে এসে চায়ের দোকান খুঁজছিলাম, পাওয়াও গেলো, একটু দূরে; সেখানে চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে সবে সিগারেটটা ধরিয়েছি, এমনসময় দেখলাম, অ্যামবুলেন্সের ড্রাইভার আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে বললো যে, ল্যাব থেকে আমাদের দুজনকে ডাকছে, সিটি স্ক্যান যে এতো তাড়াতাড়ি হয়, আমাদের জানা ছিলো না, আমি বন্ধুবান্ধবদের বাবা বা মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে বিশেষ একটা দেখতে যাই না, বরং, মানুষের শেষ যাত্রায় আমায় পাওয়া যায় বেশী। তো, ল্যাবে পৌঁছে দোতলায় গেলাম, যেখানে ওদের টেকনিশিয়ান বসে; সে, আমাদের দুজনকে দেখে বললোঃ বসুন। তারপর সামান্য সময় নিয়ে যা বললো, তার সারকথা এইরকম যে, সে জীবনে বহু সিটি স্ক্যান করেছে, কিন্তু, মস্তিষ্ক জুড়ে এতো রক্তক্ষরণ সে খুব কম দেখেছে। আমিও প্রথম কম্পিউটার টোমোগ্রাফির ছবি দেখছি, টেকনিশিয়ান জানতে চাইলো বাবার রক্তচাপ খুব বেশী ছিলো কিনা, ততোক্ষণে তার বলা হয়ে গেছে যে, এই পরিমাণ হেমারেজের পর বাঁচবার চান্স খুব কম। আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই জয়িতা বলে দিলো যে, বাবাকে রুটিন চেক আপের জন্য অনেক কিছু টেষ্ট করিয়ে ডাক্তার দেখানো হয়েছিলো ঠিক চোদ্দ দিন আগে, সেই ডাক্তার বাবার ব্লাড প্রেশার সামান্য হাইয়ের দিকে দেখে টেলমা ২০ খেতে দিয়ে বলেছিলেন যে, জাষ্ট রুটিন ওষুধ, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ফেরার সময় বাবার হাত ধরলে সেখানে আর কোনো চাপ পেলাম না, শুধু নাকডাকার মতন একটা ঘড়ঘড়ানির শব্দ। অ্যামবুলেন্স আমাদের নার্সিংহোমে ফিরিয়ে দিলে, ওরা বাবাকে আবার আই সি ইউ- এর সেই বেডেই পাঠিয়ে দিলো। অক্সিজেন, স্যালাইন, হার্ট-লাঙ মেশিন, আর নানান রঙের গ্রাফের মধ্যে বাবাকে রেখে আমরা বাড়ী ফিরে এলাম।
বিকেলে বড়ো ডাক্তারের আসাটা নাকি অসরাচর। সেই ঘটনাটাই ঘটলো, সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে, বড়ো ডাক্তার বললেন যে এ পেশেন্ট যে এখনো সারভাইভ করে আছে, সেটাই নাকি ওঁর বড়ো আশ্চর্যের ঠেকছে। তিনি কনক্লুড করেছিলেন এই বলে যে এই পেশেন্ট এক-দুদিনের বেশী নয়; তার আগেও ঘটে যেতে পারে, এমনকি, এখনই। আমার মাকে নিয়ে এসেছিলাম, মা ওপরে বাবাকে দেখতে গেলো, লিফটে, সঙ্গে আমি, বলাই ছিলো, মা ক্যানসার পেশেন্ট, ওনার সাপোর্ট দরকার। নার্সিংহোমে ভর্তি করলেই, নার্সিংহোম, নিজেদের নিয়ম এবং ডিজাইন মাফিক একটা পোশাক পরিয়ে দেয়; বাবার এক কাঁধ থেকে সে পোশাক সরে গিয়েছিলো, বোধহয় লুজ বলে, আর, এদিকে, আই সি ইউ- এর প্রচন্ড ঠান্ডা আমার শীতকাতুরে বাবা নিশ্চয় সহ্য করতে পারছে না, এইটা বুঝে মা আই সি ইউ- এর অ্যাটেন্টডেন্টদের একজনকে আর একটা কম্বল দিতে বললে, সে, প্রত্যুত্তরে একটা বিশাল হাই তুলেছিলো, সে’ হাই তোলার পর মিনিট পাঁচেক কেটে গেলো, তবু সে নিজেকে তুললো না দেখে, আমি জানতে চাইলা্ম, সে নিজে থেকে উঠবে নাকি আমি তাকে তোলার বন্দোবস্ত করবো; এইবার বাবার ভাগ্যে আর একটা কম্বল জুটলো।
# ৬
বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে, আমরা, মানে, আমি আর জয়িতা, কেউই পরদিন বাবাকে দেখতে যাই নি; এক কাকা নাকি গিয়েছিলো, সঠিক জানি না এবং জানার কোনো আগ্রহও নেই, এখনো; আমরা গিয়েছিলাম দু – তিনটে প্রপার কোলকাতার নার্সিংহোমে, বাবার সব টেষ্ট আর অপরাপর ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে, উদ্দেশ্য ছিলো, কয়েকজন ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করা এবং সবার উপরে, আমার বন্ধুর মাধ্যমে পাওয়া, এক অত্যন্ত প্রভাবশালী সাংসদের রেকমেন্ডেশনে, বাবাকে, পিজি হাসপাতালের নিউরোলজি (বাঙুর ইনষ্টিটিউট অফ নিউরোলজি )-তে ভর্তির এক মরীয়া চেষ্টা। কোলকাতার সব ডাক্তার-ই মোটের ওপর একই কথা বললেন, যে, এ পেশেন্টের বাঁচার চান্স, বলতে গেলে, নেইই, আর যদি কোনো মিরাক্যলে বেঁচেও যায়, তাহলে, ওই প্যারালাইজড ডান দিক, বাকশক্তি – এসব বাবা আর কোনোদিন ফিরে পাবে না। তবে অপারেশন-ই একমাত্র ভরসা, এবং সেক্ষেত্রে, পেশেন্টকে যতো তাড়াতাড়ি অ্যাডমিট করা যায়, সেটা আমাদেরই দেখতে হবে। পিজি হাসপাতালের ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বললাম, তিনি, ওই রেকমেন্ডেশনের গুঁতোয় বোধহয়, ওয়েটিং লিস্টের এক নম্বরে বাবার নাম লিখলেন। তারপর জানতে চাইলেন আমরা অন্য কোনো নার্সিংহোমে চেষ্টা করছি না কেন, আমাদের সারাদিন ধরে ঘোরার কাহিনী শুনে উনি সামান্য হাসলেন, তারপর বললেন যে, যে কোনো নার্সিংহোমেই আমরা বাবাকে ভর্তি করাই না কেন, ট্রিটমেন্ট তো সব জায়গায় একই, পার্থক্যটা মাঝখানে, পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকার প্যাকেজের মধ্যে। এরপর তিনি একটা ফোন করলেন, করার পর আমাদের দিকে সোজা চোখে তাকিয়ে দু-তিন দিন অপেক্ষা করতে বললেন, আরো বললেন যে, দু-তিন দিনের মধ্যেই দুটো বেড অন্তত খালি হবে, অন্তত হওয়ার কথা।
এই দু-তিন দিন, বাড়ীতে শুধু আত্মীয়দের ভিড়, মায়ের ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না, নার্সিংহোম থেকে বাড়ী, বাড়ী থেকে নার্সিংহোম। আর যার জন্য এতোকিছু, সে কিন্তু এক অপার্থিব ঘড়ঘড়ানির মধ্যে চলে গেছে, এই নার্সিংহোমের সেই বড়ো ডাক্তার যাকে বললেন, কোমা; যেন, আমাদের রোগারোগ্য কোনো জ্ঞানই নেই।
এইভাবে শুক্রবারটা কাটলো, মোবাইল বেজে উঠলেই আমরা শিহরিত হয়ে উঠছিলাম, যে, এটাই বোধহয় বাঙুর ইনষ্টিটিউট অফ নিউরোলজি-র কল, কিন্তু হা হতোস্মি, আচ্ছা, কেউ কেউ কি বোঝে না, যে, ম্যাসিভ সেরেব্রাল অ্যাটাকে কোমায় চলে যাওয়া একটা মানুষ কেমন থাকতে পারে?
মনে আছে, শুক্রবার রাতে আমি আমার মোবাইলটা অভ্যাসবশতঃ অফ করে ঘুমোতে গিয়েছিলাম, এ কদিন ওটা চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকতো। শনিবার ঘুম থেকে উঠে মোবাইলটা অন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোম থেকে ফোন, বাবার নাম বলে প্রশ্ন, যে সেই পেশেন্টের বাড়ীর লোক কিনা, আমি হ্যাঁ বলার আগে, আমার পৃথিবী একটু টলে গিয়েছিলো, আমার হ্যাঁ শুনেই ওরা বললো যে, শিগগিরি চলে আসতে, পেশেন্টের অবস্থা ভালো নয়, অক্সিজেন স্যাচুরেশন প্রচন্ড ফল করছে, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কতো, অ্যানালগ বেয়ে উত্তর এলো, ষাট, তবে কিছু আগে পঁয়তাল্লিশে নেমে গিয়েছিলো। আমরা নার্সিংহোমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছিলাম। বেরোতে যাবো, এমন সময় আমার পিসতুতো দিদি এলো, এই দিদি একসময় শিশুমঙ্গল হাসপাতালের নার্স ছিলো, আমি কিটোর ভেলক্রো লাগাতে লাগাতে দু – একটা কথা বললাম, এই দিদিকে আমি ভালবাসি, কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও আর সময় ছিলো না; দিদি ওর বাবার বাড়ীতে এসেছিলো বালীগঞ্জের লেকমার্কেটে, ও নিজের বাড়ী বাঁকুড়া ফিরেই যাচ্ছিলো, বালিগঞ্জ ষ্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলো আপ ট্রেন ধরার জন্য, এমন সময়, ডাউন সোনারপুর লোকাল এলো, আর কে যেন, ওকে টেনে নিয়ে এলো সোনারপুরে। এইসময় নার্সিংহোম থেকে ফোন, তারা জানতে চায় আমরা এখন কোথায়, আমি বললাম অটোতে, আর মিনিটখানেক দূরে, জয়িতা আমার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে সরাসরি জানতে চাইলো, যে, এখন অক্সিজেন স্যাচুরেশন কতো, উত্তর এলো, চল্লিশ।
অটো পেতে আমাদের দেরী হলো না, অথচ, অনেকানেক দিনে, আধঘন্টাও অপেক্ষা করতে হয়, আমরা দুজন উঠে, ড্রাইভারের দু’ পাশে বসলাম। অটো যখন ঠিক বাবাদের পৈতৃক বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, এমন সময়, নার্সিংহোম থেকে ফের ফোন, এবার জয়িতাকে, ফোনে কি কথা হচ্ছে আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না, শুধু তাকিয়েছিলাম জয়িতার দিকে, ওর দু’ চোখ বেয়ে ধারা নেমেছিলো, জলের। সেই অশ্রুর মধ্যে থেকেই ও জানতে চাইলোঃ এক্সপায়ার্ড? কখন? তারপর উত্তর না শুনেই ফোনটা নামিয়ে কোলে রাখলো, আমি সাইড ভিউতে তখনো দেখতে পাচ্ছিলাম বাবাদের একান্নবর্তী পরিবারের বাড়ী, এখানেই বাবার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।
আমরা আই সি ইউ - এর প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ঢুকলাম। বাবার অলঙ্কারগুলো ওরা খুলে নিয়েছে, শুধু নার্সিংহোমের ডার্ক চেকস পরা ইউনিফর্মটা ছিলো পরনে, মুখটা বেশ হাঁ করা, বাবা ঘুমোলে ঠিক এরকমই লাগে, আমি, আগে, বাড়ীতে, গভীর রাতে, শুতে যাওয়ার আগে, কোনো কারণে বাবা-মার ঘরে গেলে, ওদের দরজা ওরা কোনোদিনই বন্ধ করে না, এবং ওরা তখন গাঢ় ঘুমে, সেইসময় হয়তঃ বাবার নাক ডাকছে না, আমি মন দিয়ে দেখতাম বাবার পেটটা উঠছে, নামছে কিনা, দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই শুতে যেতাম। এটা আমি এখনো মা’র বেলায় করি, কখনো কখনো জয়িতার বেলাতেও, বলা যেতে পারে, এটা আমার একটা অভ্যাস। আমি, এখনো মনে আছে, বাবার হাত ধরেছিলাম, মনে মনে বলেছিলামঃ চলে গেলে? ভারত-অষ্ট্রেলিয়া সিরিজটাও তো শেষ হয়নি, তোমার কথাই সত্যি, ইন্ডিয়া এই সিরিজটা জিততে পারে আর তোমার শুভমান গিল আজ দারুণ খেলেছে, সেঞ্চুরি পায়নি ঠিকই, কিন্তু একানব্বই রান করেছে। জয়িতা বাবার মাথায় হাত বোলাচ্ছিলো পরম আদরে, ও তো আমার বাবার বৌমা নয়, আমার বাবার ছোট মেয়ে, আর আমি বড়ো ছেলে। বাবার দিকে যদি বা তাকানো যায়, জয়িতার দিকে নয়, ওর চোখের সাদা জমি রক্তাভ লাল হয়ে গেছে, চোখের জলে ও হারিয়ে গেছে। নার্সিংহোম থেকে আমাদের বলা হলো যে, ভোর পাঁচটা নাগাদ বাবার একটা কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট হয়, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ফল করতে শুরু করে, বাবা নাকি খুব ‘ফাইট’ দিয়েছিলো কিন্তু বেলা এগারোটা পঁচিশে সব শেষ হয়ে গেছে।
বাবার দেহ, সবার মুখে, একটু পরেই, যেটা হয়ে উঠবে বডি, এখনই তো নার্সিংহোম দেবে না, প্রোটোকলানুযায়ী, চার ঘন্টা পর দেবে। আমরা বাড়ী ফিরে গেলাম, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলতে শেখা মা তখনো বিড়বিড় করে যাচ্ছে, বাইরে, শীতের রোদে বেতের চেয়ারে বসে আছে আমার সেই কাকাটা, যে, প্রথম দিনে খবর পাওয়া ইস্তক আমাদের বাড়ী সামলাচ্ছিলো, বিশেষতঃ আমার দিশাহারা মাকে। বাড়ীটা যে এতো ফাঁকা, আমরা সেটা বুঝে উঠতে পারিনি, অবশ্য বুঝলেও বা কি করতে পারতাম, কি-ই বা করার থাকে। মাকে বললাম, মুখে বলে ঊঠতে পারিনি, শুধু জানালার বাইরে থেকে না-বাচক মাথা নেড়েছিলাম। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলো, জয়িতা গিয়ে মাকে সামলাতে লাগলো, আসলে, মার ক্যানসারের জন্যই আমরা এই ভয়টা পাচ্ছিলাম।
আমার ঘরে গিয়ে বন্ধুদের একজনকে ফোন করে জানালাম। জানি, আর ফোন করতে হবে না, একজনকে একটা ফোনই যথেষ্ট; মা তখনো কেঁদে চলেছে, আমার স্ত্রী এসে তার বাবা-মাকে ফোন করে জানালো, আমার কয়েকজন আত্মীয়কেও। একটু পরে আমার বাড়ীর সামনে দু-একটা গাড়ী, একে একে আমার সব বন্ধুরা হাজির হলো, যেন অন্য কারোর সদ্য পিতৃবিয়োগ হয়েছে, আমার নয়, এভাবেই আমি ওদের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হয়ে গেলাম।
চার ঘন্টা পর আমি আর জয়িতা নার্সিংহোমে গেলাম, তিনটে গাড়ীতে বাকী বন্ধুরা। ডেথ সার্টিফিকেট, পুরো মেডিক্যাল ফাইল, বিভিন্ন পরীক্ষা, তার রেজাল্ট অর্থাৎ অর্থহীন যা যা কিছু আমাদের দিয়ে দেওয়া হলো। বাবার দেহটা মরচুয়ারী র্যাপ করে বাইরে বার করে আনা হলো, মরচুয়ারী ভ্যানকে আগেই খবর দেওয়া ছিলো, সেও হাজির, সঙ্গে ফুল, মালা, খই, হরিনাম লেখা চাদর, গীতা; অর্থাৎ বন্ধুরা একদম লিষ্ট মিলিয়ে নিয়ে এসেছে, কোথাও কোনোও কমতি নেই। আমায় কিছু করতে হলো না, বন্ধুরাই বাবাকে সাজিয়ে নিয়ে মরচুয়ারী ভ্যানে তুলে দিলো।
বাবাকে বাড়ীতে এনে ভিতর বারান্দায় রাখা হলো, সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ, আমি, বাবার পাশে বসে আছি, আছি তো আছিই, করণীয় কি তা তো জানা নেই আমার। একটা সময় পর এক বন্ধু এসে আমার কাঁধে হাত রাখলোঃ এবার চল। অযথা দেরী করে লাভ কি? আমি বাবার গালে আর কপালে হাম খেলাম, সেই সে সুদূর ছোটবেলার মতো, বাবার দেহটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা।
শ্মশান নিয়ে বাবার একটা অবসেশন ছিলো, বোড়াল শ্মশানের ডানদিকের চুল্লী, কারণ, ওখানে আমার দিদি (দিদিমা) গেছে, মাম্মাম (ঠাকুমা) গেছে, বড়জেঠু গেছে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম নতূন একটা চুল্লী হয়েছে এবং সেখানেই বাবার জন্য বন্দোবস্ত করা হলো, আমি অনায়াসে বলতে পারতাম ডানদিকের চুল্লীর কথা, কারণ ওটা চালু এবং শ্মশান অদ্ভূত রকমের ফাঁকা, কিন্তু যাকে ওখানে পোড়ানো হবে, তার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলতে পারলাম না, একটি পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে।
শ্মশানে দাহকর্মের আগে কিছু কাজ থাকে, যার জন্য শ্মশান ব্রাহ্মণ বা মড়িপোড়া বামুন। সে আমাকে পাটকাঠি জ্বেলে, মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে যতবার বাবার মুখে আগুন ঠেকাতে বলে, আমি অনেক দূর থেকে একটুর জন্যও ধরি, ভয় একটাই, যদি জ্বলন্ত পাটকাঠি থেকে আগুন বাবার মুখে পড়ে, যে মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চিরটাকাল অনিঃশেষ ভালবাসা পেয়েছি, পেয়েছি আশ্বস্ততা, সে মুখে আমি, আমার হাত থেকে আগুন পড়তে দেবো ! ব্রাহ্মণ আমায় একটা দু টাকার কয়েন বার করতে বললেন, তারপর সামান্য মন্ত্র, অতঃপর বললেনঃ নিন, বলুন, মূল্য ধরে দিলাম। আমি, হেসে, তার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললামঃ দু টাকার কয়েনে পিতৃঋণ শোধ ! তার চেয়ে এই কয়েনটা আপনিই রাখুন। বলে কয়েনটা তাকেই দিয়ে দিয়েছিলাম।
বাবাকে যেই চালি সমেত ক্রিমেট্যরের ভিতরে ঢুকিয়ে ওরা লিভার সমেত ফাঁকা ট্রেটাকে টেনে আনলো, আমি আর সেখানে একমুহুর্ত দাঁড়াইনি, সোজা বাইরে এসে ওপরের চিমনিগুলোর তাকিয়েছিলাম, বারবার মনে পড়ছিলো বাবার অনেকবার বলা একটা কথাঃ যতক্ষণ কালো ধোঁয়া বেরোবে, বুঝবি আমার পাপ পুড়ছে, আর যখন কালো ধোঁয়ার জায়গায় সাদা ধোঁয়া বেরোবে, বুঝবি, আমি অনন্তের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমি ডোমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাবাকে ওরা যে ক্রিমেট্যরে ঢুকিয়েছে তার চিমনি কোনটা; ডোমটাও, কি আশ্চর্য, চিমনীর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিলো, নির্বাক; তারপর খুব মৃদস্বরে বলেছিলোঃ খুব ভালো লোক ছিলেন আপনার বাবা। ওই দেখুন, ওই চিমনী দিয়ে শুধু সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে; এমনটা খুব কম হয়। শীতের সন্ধ্যায় আমি তেমন স্পষ্ট দেখতে পাইনি, সাদা ধোঁয়া - কালো ধোঁয়ার তফাত-ও আমি বুঝি না, কিন্তু, ডোমটার এই কথাটা আজও উল্কির মতো আমার মনে সেঁটে আছে, এবং বুঝি, আমার মৃত্যু অবধি তেমন-ই থাকবে।
একসময় শেষ হলো সেই দাহ। দহনশেষে অ্যাভারেজ হাইটের বা লম্বা, বেঁটে সব বাঙালীই ধরে যায় সেই ট্রেতে, যার বেশীরভাগ ছাইয়ের রঙ ধূসর, কিছু বা কালো আর একমাত্র পাঁজরের হাড় গুলো সাদা। একটা লোহার বাঁকানো এল শেপের ডান্ডা নিয়ে, ডোম, সেই ছাই সরিয়ে বার করে দেয় অক্ষয় নাভি। সে কি জানে, ওই ছাইয়ের ভিতর কতো স্মৃতি ছাই যে হয়ে লুকিয়ে আছে, যার সবকিছু ওই নাভির মতোই অক্ষয় ! আর বাবার সঙ্গে আমার তো সব সুখস্মৃতি, যার কিছুই বলা হলো না; অবশ্য একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হয়েছে, আমারও তো কিছু থাকুক, যা কিনা নিজস্ব।
আমরা ফিরলাম। বাবাকে দাহ করে ফেরবার সময় আমি আমার কোনো অ্যাপারেল-ই ছাড়িনি, স্নান করেছি বাড়ী এসে, কাছা নেওয়া তো দূর, আমি পরের দিন যখন একগাদা আত্মীয় দেখা করতে এসেছে, আমি কালো ট্রাউজার (পায়ের দিকটা শুধু যে ট্যাপার্ড তাই নয়, নীচে ঘন নীল ব্যান্ড) আর অফ হোয়াইট ফুলস্লীভ টি-শার্ট পরে, নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে, তাদের, বাবা-মা-র ঘরে মিট করেছি। যাই হোক, শ্মশানফেরত আমাদের, আমার মামাতো বোন, যেন বরণ, করে নিলো নিম পাতা, চিনি আরো কিসব দিয়ে। আমার মনে পড়ে গেলো রামপ্রসাদ সেনের কথাঃ নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছলো…
# ৭
তারপর শুরু হলো আমার অশৌচ। আমি যে চাল খাই, সেই চালের ভাত আর নিরামিষ ডাল অর্থাৎ মুসুর ডাল বাদে, অপরাপর যে কোনো ডাল আর ভেজিটেবলসের তরকারী খেতাম; হব্বিষ্যান্ন ইত্যাদির কথা তুললে কিন্তু আমি লজ্জা পেয়ে যাবো। ঘাট-কাজের দিন মস্তক-মুন্ডন করেও পিতৃবিয়োগের চলতা-ফিরতা বিজ্ঞাপন হইনি। বাবার শ্রাদ্ধের কোনো কাজ আমি করতে চাইনি, চেয়েছিলাম যা খরচ হবে, সেটার একটা এষ্টিমেট করে, সেই টাকার পুরোটা দিয়ে কম্বল কিনে ষ্টেশনে গিয়ে অসহায় মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু প্রথমে জয়িতা আর কিছু পরে, আমার মা, জয়িতার পক্ষ নিলে আমার আর কিছু করার রইলো না। ঠিক হলো, দুটো-ই করা হবে, বাবার শ্রাদ্ধতে বেশী লোক বলা হবে না, আইটেম হিসাবে একটা প্যাকেট আর চা এবং বেঁচে যাওয়া টাকার ওপর আরো কিছু দিয়ে কম্বল। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, বাবা এমনটা বলেনি, বারবার আমায় বলেছে, ষ্টেশনের অসহায় মানুষদের কম্বল দিয়ে আসতে, বলেওছিলাম, কিন্তু ওই, একটা কথা আছে না, বিধি বাম, অবশ্য সেদিক দিয়ে ভাবলে আমাদের সরকারও একসময় বাম ছিলো, এখন অন্য দল, কিন্তু রেজাল্ট? ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।‘ বাবা, আমি জন্মানোর ঢের আগে, অ্যাক্টিভলি পার্টি করা ছেড়ে দিলেও চিরটাকাল বামদেরকেই সাপোর্ট করে গেছে; তো, শ্রাদ্ধের দিন নতূন পাজামা – পাঞ্জাবী চড়িয়ে আমি বসে গেলুম ব্রাহ্মণের সঙ্গে, ব্রাহ্মণ আমাদেরই পাড়ার, খুব ভালো মানুষ। আমার প্রতিটি কৌতূহলপূর্ণ জিজ্ঞাসার সটিক ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন; বাবার শ্রাদ্ধের দিন আমার খুব মনোযোগ ছিলো, নিষ্ঠা ছিলো, কারণ আমার মনে পড়ে গিয়েছিলো, শ্মশানে, তখন বাবা, কাঁচা কাঠের চালিতে শুয়ে, নিথর, মুখখানা বেশ হাঁ করা, যেন পরম আরামের ঘুম দিচ্ছে, এক নাকটাই শুধু ডাকছে না, এই যা; শ্মশানের ব্রাহ্মণ আমাকে বাবার মুখে জল দিতে বললে, আমি, খুব আস্তে আস্তে সরাটা থেকে জলটা ঢেলেছিলাম, আর অবাক হয়ে দেখেছিলাম, পুরো জলটার প্রতিটি বিন্দু যেন মুহুর্তের মধ্যে কেউ শুষে নিলো, আমার মনে হয়েছিলো যে, নার্সিংহোমগুলো কি আজকাল মিনিমাম স্যালাইনও দেয় না ! কি অদ্ভূত না, এই মনে হওয়াটা? কিন্তু এটাই আমি, যে যেমনরকম হয়ে থাকে, আর কি। তো, শ্রাদ্ধের দিন আমার খুব মনোযোগ ছিলো, নিষ্ঠা ছিলো, যা খুবই অসমাঙ্গ। কম্বল বিতরণও হয়েছিলো, একটা হোমের মানুষদের, জয়িতা ওই দপ্তরেই কাজ করার জন্য বেশী খুঁজতে হয়নি, এরা কারোর কাছ থেকে কোনো সাহায্য পায় না, প্রয়োজনের সময়ে নিজেদের পকেট হাতড়ে যা ওঠে, তা দিয়েই ম্যানেজ করে; হ্যাঁ, কম্বল এদেরও দরকার, কিন্তু, ওই যে বলেছিলাম, ষ্টেশন আর কিছু অসহায় মানুষ, যাদের অনেকেরই আবার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন, ওদের? উত্তর নেই, উত্তর নেই কোনো, উত্তর নেই, উত্তর নেই কোনো।
তবে হ্যাঁ, মায়ের সকাতর অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি, একবছর আমি সমেত আমরা, অবশ্য আমি বাদ দিয়েই বা কি করে আমরা হয়, তখন তো ওরা হয়ে যায়, হ্যাঁ, আমরা একাদশী পালন করে গিয়েছি, রুটি, ছোলার ডাল আর সুজি সমেত। আর রাতে খই-দুধ-মিষ্টি।
# ৮
এখন বাবার না থাকাটা… কি ভাবছেন, অভ্যাস হয়ে গেছে? মোটেও না, বাবার দুটো ফটো আছে বাড়ীতে, দুটোর-ই কোনো একটার সামনে গেলেই আমি স্থাণু হয়ে যাই, মনে হয়, বাবা দূরে কোথাও বেড়াতে গেছে, দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। অন্তত সেরকমই কথা। কখনো খেলার রেজাল্ট বলি; কখনো বা কথাবার্তার মধ্যে এইসময়ের রাজনীতি চলে আসে। এবারের আই পি এলের একটা খেলাও দেখিনি, দেখবো কি করে, আমার খেলা দেখার সঙ্গীই তো চলে গেছে। জানি না কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ আমি কার সঙ্গে দেখবো, বাবা ব্রাসিল আর আমি আর জয়িতা আরখেন্তিনা, কার সঙ্গে ধুন্ধুমার তর্ক বাঁধবে।
আমি পরে শুনেছি যে, যেদিন ঘটনাটা ঘটে, তার আগের দিন, পড়শীদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে, বাবা, সবার সঙ্গে দেখা করেছিলো। আমার যে দূর সম্পর্কের আত্মীয় আমাদের পাড়াতেই থাকে, তাদের বাড়ী গিয়ে বলেছিলো, সেই বৌদির মৃত বাবা-মা-এর কথা, তারা নাকি বাবাকে ডাকছে। সেইদিনই বাবা আমাদের বাড়ীর সামনের বাগানে বসে, ছায়ায়, আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো, যা দেখে পিছনের বাড়ীর মিঠু বলেছিলোঃ ও দাদা, সব ভাবনাটাই তো আপনি একা আজ ভেবে ফেললেন। কাল কি ভাববেন? আর আমরাই বা কি ভাববো ! প্রত্যুত্তরে, বাবা, নাকি লজ্জা পেয়ে, চোখ নামিয়ে বলেছিলোঃ এই...
খুচরো কাজকর্ম, মানে, যেটুকু করে, আমি, মদ আর নানাবিধ তামাকের নেশার খরচ জুটিয়ে থাকি আর কি; তো, সেসব শেষ করে গভীর রাতের দিকে শুতে এলে, দেওয়াল ডিঙিয়ে মায়ের ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাই আমি, আর আমার অবাক লাগে, বাবার মৃত্যুর দিন থেকে অ্যাতোদিন অবধি একদিনের জন্যও কাঁদলাম না আমি; অথচ ছোটো থেকে সবাই আমায় বাপ-ভক্ত বলে জানতো। পরে, যখন কিনা মন বিশ্লেষণ করতে পারে, আমার মনে হয়েছে যে, আমার বাবা মারা গেছে এটা আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, এমনকি, বাবা যে বৃদ্ধ হয়েছিলো, সেটাও আমি জানতে পারিনি; পারবো কি করে? - আমি তো বড়োই হতে চাইনি এবং পারিনি। কোনোদিন। কখনও।
পুনশ্চঃ ব্লগে এতো বড়ো লেখা তো আগে কোনোদিন লিখিনি, তাই ওই দ্বিবিভাজন। তো, একটা লেখাকে দুটোতে স্প্লীট করার সময় কিছু কিছু শব্দের পরিবর্তন করেছিলাম, কিন্তু কোথায় করেছিলাম মনে নেই। এখন দুভাগে লেখাটা ব্লগে উঠলে আমার পক্ষে সেই সব জায়গাগুলোকে বোঝা সত্যিই দুষ্কর; এবং সেইমতন একত্রিত লেখাটাকে পরিমার্জনা করা। সেকারণেই দুটো লেখার (খন্ডিত এবং একত্রিত) সহাবস্থান থাকুক না; পৃথিবীতে তো দৈনন্দিন কতো কদর্য জিনিসের সহাবস্থান হচ্ছে; আমাদের দেশের রাজনৈতিক মানুষগুলো, আমার মতে, তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ, আর এ দুটো তো মিয়্যার স্মৃতিচারণ মাত্র, তাও পিতৃস্মৃতি।
ছবি ও লেখা
অনিন্দ্য ঘোষ ©
No comments:
Post a Comment