Monday, October 24, 2022

দীপান্বিতার সন্ধ্যে থেকে রাত সাড়ে তিনটেঃ আমি যেমন দেখেছি

 

সেই যে সেই লোকটা, যাকে কিনা বাবা বলে ডাকতাম, যে কিনা আমার অস্তিত্বের বীজ দিয়েছিলো, যাকে ২০২১ সালের ১৬-ই জানুয়ারী তারিখে আমি, জয়িতা, আমার মা, আর আমার বাবা, অর্থাৎ কিনা, আমরা; চারজনের এই সেটটা ভেঙে গিয়ে তিনজন হয়েছিলাম এবং এই তিনজন শেষ বিদায় জানিয়েছিলাম সেই যে গমনোদ্যতকে; ভেবে রেখেছিলাম, যে, আমি, অন্ততঃ একা, ২০২২ সালের কালীপূজার দিন; অবশ্য এটা ২০২১ সাল অনওয়ার্ডস যেকোনো বছর হতে পারতো, তবে, আমার আয়ু অনুনগ; যখন কিনা চতূর্দশী টপকে অমাবস্যা পড়ে যাবে, তখন, আমার তারা মায়ের ডোমেইনে গিয়ে, পন্ডিত শ্রী অজয় চক্রবর্তীর কন্ঠে, শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা, গানটা, যার গীতিকার কাজী নজরুল ইসলাম, জনকথিত এক মুসলমান মানুষ, কাদের-যেন-ঠিক-করে-দেওয়া-ধর্মানুযায়ী; তো, ওই গানটা শুনবো এবং বাবার চারটে ছবি, যখন বাবার লাশ, ইউফেমিজম করে বললে, বাবার বডিটাকে, মরচুয়ারী ভ্যান ভায়া নার্সিংহোম থেকে এনে, অর্থাৎ, যখন, আমাদের বাড়ীর ভিতর বারান্দায় এনে শোয়ানো হয়েছে, সেসময়, মরচুয়্যারী র‍্যাপ; এই ফান্ডাটা নতূন এসেছে, যদিও কন্টেন্টটা নতূন কিছু আদপেও নয়, পাতি সাদা মার্কিন কাপড় দিয়ে আপামাথা মুড়ে দেওয়া, সেই মরচুয়্যারী র‍্যাপিং এবং বাবার নাকে আর ঈষৎ হাঁ হয়ে থাকা মুখে থ্যাবড়া করে তুলো গুঁজে দেওয়া; আমি তুলোগুলো সরিয়ে, নাহ, সবটা পারিনি, বাবার ঈষৎ হাঁ করে থাকা মুখে তুলোর তন্তু কিছু রয়ে গিয়েছিলো, মায়াজাল যেন বা; এই হাঁ-মুখ দেখলেই আমার বাবার ঘুমিয়ে থাকা মুখটা মনে পড়ে, আজও; ডান চোখ অর্ধনিমীলিত, যেটার ক্যাটার‍্যাক্ট অপারেশন করানোর ছিলো, ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং প্রাথমিক দ্যাখা দেখিয়ে, বায়োমেট্রি, সুগার, প্রেশার, কমপ্লীট হেমোগ্রামিত্যাদি করেও শেষ পর্যন্ত অপারেশনটা করা আর হয়ে উঠলো না; সেই আধেকখোলা ডান চোখ, মুখের তুলোর তন্তুজাল নিয়ে, জয়িতার মোবাইলে, কেননা ওর মোবাইলের ক্যামেরাটা বেশী ভালো ছিলো, তখন, সেই মোবাইলে তোলা শেষ চারটে ছবির মধ্যে কোনো একটা দেখবো আর কাজী নজরুল ইসলামের লেখা, পন্ডিত শ্রী অজয় চক্রবর্তীর কন্ঠে, ওই গানটা শুনবো

 

আর এটা আজকের প্ল্যান নয়, বেশ কিছুদিন আগে থেকে এটা ভেবে রাখাই ছিলো

 

তারপর? তারপর আর কি, শুনলাম, যদিও সেই শোনার মাঝখানে ঘাই মেরে মেরে যাচ্ছিলো অন্য ভাবনা, আর আমি, রাখাল যেমন আগেকার দিনে, হ্যাঁ, আমার আবছা, ঘোলাটে স্মৃতি আছে এ বিষয়ে; দিন সারা হলে ছোপটির ঘা মারতে মারতে গরুগুলোকে ঘরে নিয়ে আসে, বলদ বা ষাঁড় প্রসঙ্গ জানি না, আসলে জিজ্ঞাসা তো কোনোদিন করা হয়ে ওঠেনি; যেমন, সন্ধ্যার মুখে, এ বাড়ী ও বাড়ী থেকে ভেসে আসে শাঁখের ফুঁ দেওয়ার শব্দ, কোনোটা বা বড়ো, কোনোটা আবার মাঝারি বা ছোট, যার যেমন শ্বাসের জোর আর কি, কলজে বলতে গিয়েও সামলে নিলাম, ভুল না হলেও শব্দপ্রয়োগের বাহুল্যতা বা ক্ষেত্রবিশেষে, বাচালতা, অন্য মানে বহন করে আনতেই পারে, যেটা আমি, এখন অন্ততঃ, চাইছি না; যখন আমার স্বকর্ণে শোনা, আমাদের, তখনকার ভাড়া বাড়ীর একটু দূরে, একটা বুড়ীর গলাঃ আয়, আয়, গোড় গোড়, আয়, আয়, আয় বলে পোষা হাঁসগুলোকে ডেকে নেওয়া ও সেই কন্ঠস্বরকে রোজ শোনা; ঠিক সেরকম অদর্শিত কোনো এক ছোপটির বাড়ি, সেই রাখাল যথা মারতে মারতে ভেসে ভেসে আসা অন্য কথাগুলোকে সরানোর চেষ্টা করছিলাম প্রাণপণ একবার নয়, দু – দুবার শুনলাম গানটা, হাতে সেলফোনে ধরা বাবার অন্তিম শয়ানের ছবি; - কান্না তো দূরের কথা, কোনো দুঃখ, কোনো শোক, এসব কিছুই আমার মগজে চাগিয়ে উঠলো না; তবে আমি আশ্চর্য হইনি, অ্যাতোগুলো বছর বাঁচতে বাঁচতে আমি এটাই সার বুঝেছি, যে, মন কখন কি ভাববে, সেটা ভাবনার এক মুহূর্ত আগে, মন নিজেও জানে না; মনন, অর্থাৎ প্যারাস্যাজিট্যাল লোব নিজের মর্জি মতো চলে আলটপকা যাকে বলে, ঠিক সেইরকমভাবে, বাবার কথা মনে পড়লে আমি কেঁদেছি কিন্তু প্রি-প্ল্যান্ড কিছু করে অশ্রু... ওটা সিনেমা-থিয়েটারওয়ালারা পারে, আমার মতো কমোনারদের কম্মো নয় ওটা

 

 

পুনশ্চঃ ভেবেছিলাম, বাবার অন্তিম শয়ানে তোলা চারটে ছবির মধ্যে, একটা; যেখানে, বাবার নাকের তুলোর গোলা খুলে নেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু, মুখ থেকে সরিয়ে নেওয়া সত্ত্বেও রয়ে গিয়েছিলো মায়াজাল, এহ্‌, সরি, তুলোর ফেঁসো; সেই ছবিটা দুবার লেখা পিতৃতর্পণে দিয়েছি; - অতএব, তুলো ঠাসা আছে নাকে ও মুখে, এরকম একটা ছবি দেবো পরে মনে হলো, কিই বা হবে দিয়ে, লেখাটায় তো আর নতূন কোনো মাত্রা যোগ হবে না, উল্টে, মাঝখান থেকে লেখাটা গ্র্যাফিক হয়ে যাবে আর আমি, এখানে, ডায়েরী লেখার মতো করেই যা লেখার, সেটা লিখছি, কারোর করুণা মাগবার জন্য তো আর নয় করুণা মেগে কিই বা আর হবে, সেই তো, হয় ক্যানসারে, যার সম্ভাবনা বেশী, নয়তো হয় সেরেব্রালে, নচেৎ, কার্ডিয়াক অ্যারেষ্টে, যদিও কার্ডিয়াক অ্যারেষ্টই শেষমেশ সবার হয়, কারোর আচমকা, কারোর বা রোগে ভুগে, কেনকি, পাম্প মেশিন চালু থাকলে মানুষ, বা অন্য যে কোনো প্রাণী, যারা এখানে একফোঁটাও বিবেচ্য নয়, তারা মরবে কি করে !

 

হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিলো যে কোনো ধরনের মৃত্যু... আচ্ছা, মৃত্যুর আবার ধরন কিসের? – মৃত্যু, সে অন্য আর কিছু তো নয়, মৃত্যুই; তার প্রাথমিক কাজটা হলো ফস করে, আর নতুবা, অপেক্ষামাফিক এসে, টুক করে হার্টটাকে বন্ধ করে দেওয়া, যাতে মানুষটা যায় যেতে পারে অতএব করুণার জন্য মাধুকরী করলে, আর যাই থাক, এটা শিওর, যে, লাভ কিছু নেই; মাধুকরীর জন্য, একটা ইন্ডিভিজুয়ালের জীবন-মৃত্যুর কড়া-গন্ডা গণন ব্যতিরেকে, আরো অনেক বৃহত্তর ইস্যু আছে, যেগুলো অ্যাড্রেস করা একান্তই দরকারমানুষের জন্য অন্ততঃ নিজের ক্ষমতানুযায়ী আমায় সেটা করে যেতে হবে বাবার জন্য; আমার বাবা, সবার ভালো হোক, সেটাই চেয়েছিলো ভীষণভাবে আমি সাক্ষী ভীষণভাবে

 

প্রায় সব লেখাতেই আমি একটা করে ছবি দিয়ে থাকি কেন সেটা যেন আবার জিজ্ঞাসা করবেন না ধরে নিন, ওটা একধরনের ব্যসন আমার একটা তাহলে এখানেও দিই কান্ধা দেওয়ার সবথেকে বড়ো দেওয়া তো বোধহয় এটাই, মৃত্যুর পরে চারটে পেশল কাঁধ খুব খারাপ যাবে না কি বলেন?

  

 

 


  

 

অনিন্দ্য ঘোষ ©

ফটোকার্টসিঃ গুগল ইমেজেস

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা সেইসব গানের অংশভুক সকলকে


No comments: