Wednesday, January 4, 2023

সেলুনের সময়গুলো

 

 

পৃথিবীর যাবতীয় ভাবনা, মানে, দুর্ভাবনা ছাড়া আর কিই হতে পারে বা, মগজে ভরে নিয়ে, যারা গ্রাম্পি ফেসে কমোডে পটি (কি মিষ্টি নাম, তাই না? যে রেখেছিলো, সে, বোধহয়, টেস্ট করেও দেখে নিয়েছিলো) করতে বসে, আমি তাদের দলের না। দিন যতো কমছে, ওই সাইড থেকে বলছি, আমি ভাবনাগুলো দূরে সরিয়ে রেখে, বিন্দাসতর থেকে তম হাল্কা হচ্ছি। এমনকি, এর প্রমাণ শারীরিকও হচ্ছে; তাপসের সেলুনের রাজু, আমার দাড়িতে ক্ষুর উল্টো করে টানতে টানতে বলেঃ দাদা, তোমার চুল খুব পাতলা হয়ে গ্যাছে। দু বছর আগেও কি ঘন ক্যাঁতার মতো চুল ছিলো তোমার। বলে কাঁচির ডগা দিয়ে ব্রহ্মতালুর একটু পিছনে ইন্ডিকেট করে। আমি, হেসে ফেলা ছাড়া আর কিই বা করতে পারি, এক, ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদতে বসা ছাড়া; ওকে হাল্কা ধমকের সুরে বলিঃ তা বুড়ো হচ্ছি, চুল পাকবে না, ঝরবে না। নিয়েছিলাম এসে, চেক আউট করার সময় জমা খরচ তো মিলিয়ে দিয়ে যেতে হবে। রাজু, ক্ষুর চালানো থামিয়ে একটা অ্যাঁ ছাড়া কিছুই বলতে পারে না বিশেষ, আমি ওকে মুক্তি দিইঃ ফোম দিয়ে কাটা হয়ে গেলে থুতনিটা জল দিয়ে আর একবার মেরে দিস তো! রাজু, তার কম্ফোর্ট জোন ফিরে পেলে সবাক হয়ঃ এই কারণে তোমার দাড়ি দিন দিন কড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস করো, উল্টো করে যখন টানি, চড়চড় করে শব্দ হয়, পাশের চেয়ার থেকে লোকে শুনতে পায়। আমি বেচারাকে কিভাবে বোঝাই যে, এখন চড়চড় করে শব্দ হচ্ছে, ইলেক্ট্রিক চুল্লীতে না দিয়ে, ম্যানুয়ালি পোড়ালে ওরকম চড়চড় মড়মড় শব্দ কতো যে হবে! মড়ি পুড়লে কি মর্মর ধ্বনি জেগে ওঠে, বাপ? - মড়মড় ধ্বনিই ছড়ায়, বিকীর্ণ হয় ঊনপঞ্চাশ দিকে।

মুখে হাসি আনতে হয় না, এসেই যায়ঃ তার চেয়ে বলতে পারতিস উল্টোদিকের হোটেল থেকেও শুনতে পাবে। আর হ্যাজাস নি, কাট।

 

প্রতিদিনই এইরকম কথপোকথন না হলেও প্রায়শই এর কাছাকাছি গোছের কিছু একটা হয়।

চুলটা শেপ করে, দাড়ি ইত্যাদি নামিয়ে, ওরে চিপকু, তুই তো ঝলমলে হয়ে গেলি রে টাইপ হয়ে বাড়ী ফিরতে ফিরতে একদিন আমার যে বোধিটা হয়েছিলো, তা অনেকটা এইরকমঃ চুল পড়ছে। রাইট। ভাবনা-দুর্ভাবনাগুলোকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। ঠিককথা। কাটা চুল মাটিতে পড়ছে। পার্ফেক্ট। ছেড়ে দেওয়া ভাবনা-দুর্ভাবনাগুলোকে কে ঘাড় পেতে নিচ্ছে সেটা জানি না এবং আরো বড়ো যে কথা, সেটা এই যে, জানতে চাইছিও না। হাল্কা হয়ে এসেছি, হাল্কা হয়ে ফিরতে হবে; ফিরবো। সেদিক থেকে দেখলে অকৃতজ্ঞভাবেই যেতেই আমি যেন বেশী রাজি। তাহলে কাটা চুলগুলো হলো গিয়ে ভাবনা-দুর্ভাবনাগুলোর ভার। ফুরফুরে আমিতে টাক পড়ছে। টাক হাল্কা কিনা জানি না, তবে দেবদূত যে টেকো হয়, অন্ততঃ হতে পারে, বুঝি সেটা।

আজ দুপুরে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলুম, আমার মাথার রাজুর সেই কাঁচি নির্দেশিত জায়গায়, একটা বড়োগোছের গোল টাক পড়েছে আর সেই গোলটাকের চারিদিকে ভর্তি কালো চুল। আর রাজু কাঁচিটা পরিসীমা বরাবর ঠেকাতে ঠেকাতে বলছেঃ ও কি গো, দাদাএই অ্যাতো চুল ফের গজালো কোত্থেকে! প্রত্যুত্তরে আমার ঘড়ঘড়ে গলায় কিছু জড়ানো শব্দ বেরোয়। পিছন থেকে বাবা সাইকেল নিয়ে, সাইকেলের হ্যান্ডেলে দু ব্যাগ ভর্তি আনাজপাতি, মাছ ইত্যাদি নিয়ে আমার কাছে এসে বললোঃ কিরে, হয়েছে? ফিরবি কি এখন?  

আমার কাজ হয়ে গিয়েছিলো, তাড়াতাড়ি রাজুর হাতে টাকা (যে রেটে ও আমার প্রত্যেকবার ক্ষৌরী করে) গুঁজে দিয়ে, বাবাকে বলিঃ আমার হয়ে গ্যাছে, বাবা। চলো।

ফিরতি পথে, ভাবছিলাম, বেশ তো ছিলাম, ভাবনাহীন। হাল্কা। যেসময় বাবার সঙ্গে কৈশোরের ফেরার মতো ফেরা হতো, তেমনই, ভাবনাও নেই, দুর্ভাবনাও নেই। তাহলে কি নতুন করে ভাবনাগুলো ফিরে আসছে। শুনতে পাচ্ছি, আমার সাইকেল থেকে ফুট ছয়েক দুরত্ব বজায় রেখে বাবার হামিং - মুছে যাওয়া দিনগুলি...

 

আর কি? আর কিছুই নয়। সবকিছুর যে একটা ডেফিনিট, কংক্রিট শেষ হতে হবে, তার নিশ্চয়তা আছে না কি? - না, নেই, নিঃসন্দেহে নেই; অন্ততঃ যদি জীবন ধরে চলি। গোদারের কথাটা মনে পড়েঃ একটা গল্পের শুরু আছে, মাখখান আছে, শেষ আছে। কিন্তু এই ক্রমেই যে তাদেরকে থাকতে হবে, তেমনটা নয়। 

আমি আবার একধাপ এগিয়ে ভাবি, যদি বেঁচে থাকার খাত বরাবর চলি, তাহলে, অনেক গল্প পাবো, যার মাঝখান আছে, শেষও আছে কিন্তু শুরু নেই। উদাহরণঃ আমার বাবা। যাকে নিজের হাতে পুড়তে পাঠিয়েছি প্রায় দু বছর হতে চললো। আবার অনেক গল্পের শুরু আছে, মাঝখান আছে কিন্তু শেষ নেই, উদাহরণ? - এই যে, আমি, এখন, লিখছি। আবার শুরু আর শেষ আছে, মাঝখান নেই। উদাহরণঃ আমার অস্তিত্ব; - ঘন করে বললে আয়ু, আর একটু জ্বাল দিয়ে ক্ষীর ঘন করলে, বলতে হয়ঃ আমার বেঁচে থাকা। শুরু নেই, শেষ নেই শুধু মাঝখান আছে। উদাহরণঃ আমার স্বপ্নে দ্যাখা টাকটা।

 

খুব সম্ভবতঃ আমার বেঁচে থাকার খাতটা যেতে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছে, খুঁজছে বাহিরপথ। পাচ্ছে না বলেই অ্যাতো আলোড়ন, উড়ুক্কু স্বপ্ন। কিন্তু তা বলে সে আমায় ছেড়ে চলে কোথাও যায়নি, যাচ্ছেও না। বেচারা সময়। আমার কাঁধে হাত রাখতে সুযোগই পাচ্ছে না। অতএব?  কি দাঁড়ালো তবে? দাঁড়ালো এই যেঃ ভালোবেসে ধুলোয় নেমে সুখে আছি।

 

শেষ বাক্যের জন্য ঋণঃ শ্রী শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয়, সম্পর্ক র‍্যাদার, ঠিক কি, আমি জানি না। তবে এটা জানি, যে, সম্পর্ক একটা আছে। সে বয়সে আমার বাবার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়ো। কিন্তু তার লেখায়, সে, আমার কাঁধে হাতে, আমি তার কাঁধে, অন্যহাতে, দুজনেরই, একটা করে বোতল। শক্তি, আমি খেতে পারি না বলেই, আজ চোলাই খায়নি। তাই দিশী মদ, যাকে ভালোবেসে বলি, বাংলা। আমরা তীরভূমিতে হাঁটছি, বান্ধবযথা, কিছু দূরে, একটা নাম না জানা নদী, জলধারাও বলা যায়, এমনই ক্ষীণ, বহে যাচ্ছে। একা একা।

 

 

 

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ ©

ফটোকার্টসিঃ গুগল ইমেজেস

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে

 

 

 

No comments: