Tuesday, September 27, 2022

স্মৃতির উদ্দেশ্যে

 

বাংলায়, খবরের কাগজে, স্মৃতির উদ্দেশ্যে দেখার অভ্যাস আমার অনেকদিনের। যাঁদেরকে চিনিও না, হয়তঃ কোনোদিন চিনবোও না, সেই তাঁদের সঙ্গে দুঃখের ভাগ নেওয়া আমার একটা, কি বলবো, ব্যসন, আসক্তি অর্থে এরকমটাই ধরে নিন।

সন্তানহারা মা-বাবা, অতি ভালোবাসার স্বামীকে অকালে হারানো ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আমি যেন অশ্রু-সজল আঁখিগুলোকে দেখতে পাই। খুব ইচ্ছে করে, কাছে যাই, গিয়ে পিঠে হাত রাখি। হয়ে ওঠে না; পৃথিবীতে সবকিছু তো আর হওয়ার নয়। তবুও, মনে পড়ে –

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়

সন্তানহারা মায়ের বাঁচা

একদিন ভোরে খুলে দেন তিনি

জোড়া মুনিয়ার ছোট্ট খাঁচা।

 

এরপর তো ‘ও আমার ময়না গো’ রইলোই।

 

মনে পড়ে, অনেকদিন আগে দেখা একটা স্মৃতির উদ্দেশ্যের কলাম; এক ভীষণ মিষ্টি দেখতে কিশোরী বা ইয়ং অ্যাডাল্ট, নাম ছিলো তার বাসবদত্তা। পদবী সঠিক মনে নেই, বোধহয়, রিপিট, বোধহয়, দত্ত।

খারাপ লেগেছিলো খুবই; আর তার নীচের লেখাটা যেন লেখা নয়, একটা কালেক্টিভ হাহাকার উঠে আসছিলো সেখান থেকে।

পরে একদিন আমার এক খুব কাছের বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি শিয়ালদহের (আরে বাবা, কাম অন, এটা সেই আদি, অকৃত্রিম শিয়ালদা-ই) এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে, কেননা খুব ক্রিস্পি, গরম গরম চীনেবাদাম নিয়ে দু-জন মানুষ বিক্রি করতে বসতেন; ভালো কথা, এখনো কিন্তু বসেন, তবে একজন।

 

তো, কথায় কথায়, ততক্ষণে আমাদের পায়ের নীচে চীনেবাদামের ছোট গোছের দুটো ঢিপি উঠে গেছে,  আমার সে অন্তরঙ্গ বান্ধবী বলে উঠেছিলোঃ জানো অনিন্দ্য, আমাদের ওখানে, মানে কল্যাণীতে, একটা খুব প্যাথেটিক ইনসিডেন্ট ঘটে গেছে।

জিজ্ঞাসু আমি, বান্ধবীর দিকে চাইলাম। শুরু হলো এক কিশোরীর অথবা ইয়ং অ্যাডাল্টের কিস্যা, যে স্কুটার চালানো শিখতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পায়, তা অমন চোট তো আর অসচরাচর নয়, সুতরাং কেউই, এমনকি, সেই মেয়েটিও পাত্তা দেয়নি। দিন যায়, যেমন কিনা হাওড়া ব্রীজের তলা দিয়ে গঙ্গার জল, মেয়েটি, বেশ উচ্চবিত্ত পরিবারের সেই ইয়ং অ্যাডাল্ট, তদ্দিনে স্কুটার শিখে, চালিয়ে হাত পাকা করে নিয়ে একটা স্কুটি কিনবো-কিনবো করছে, এমন সময় তার ঠাহরে এলো যে, তার স্কুটার চালানো শিখতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পাওয়া সেই চোটের জায়গাটায় কেমন যেন অসাড়-অবশ ভাব। দু –একদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পর মেয়েটি, একরকম বাধ্যতঃ-ই, জানালো বাড়ীর লোকজনেদের। ব্যাপারটা নিয়ে তাঁরা আর কোনোও ডিলে না করে, সোজাসুজি ডাক্তারের কাছে। ৯৩ সালের ঘটনা স্মৃতি থেকে ধার করে নিয়ে লিখতে বসেছি আজ, ২০২২ সালে; মনে নেই এবং জানাও নেই, সেসময় এম আর আই, কমপিউটার টোমোগ্র্যাফি এসবের কোনো সুবিধা ছিলো কিনা। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, ডাক্তার, সেই মেয়েটির পায়ের চোটের জায়গাটা দেখে এক্স রে ইত্যাদির প্রেসক্রাইব করে বলেছিলেন, চিন্তার তেমন কিছু নেই। দু একটা ওষুধও দিয়েছিলেন; আজ বুঝি, ওগুলো স্রেফ দিখাওয়া, একটু ইউফেমিজম করে বললে, সাইকোলজিক্যাল ড্রাগ; - ডাক্তারের কাছে এলাম, ডাক্তার কোনো ওষুধ দিলো না ! টাইপ।

তো, দিন যায়, আকাশ-প্রদীপ জ্বলে শান্ত এ হেমন্ত সন্ধ্যায়, কিন্তু মেয়েটির চোটের জায়গায় অসাড়-অবশতা চলে গিয়ে সাড় আর ফেরে না ! ফলতঃ অন্য ডাক্তার, সপ্তাহখানেক পেরিয়ে  অন্য ডাক্তার – এইরকম ডাক্তার ডাক্তার খেলা খেলতে খেলতে কোনো এক ডাক্তার, সবটা শুনে, ফোর্থউইথ সাজেস্ট করলেন, মেয়েটির চোটের জায়গার বায়োপসি করতে।

বায়োপসি হলো এবং যথাকালে রিপোর্টও। ততদিনে মেয়েটির চোটের জায়গার ক্যানসার অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছে। ইদানীং জানি, প্রায় তিনশো রকমের ক্যানসার আছে; কোনোটা খুবই ফেটাল, কোনোটা বা তুলনামূলক কম আর ক্যানসারের নানারকম ওষুধ বেরিয়েছে যা খুবই উন্নত, এও জানি আমেরিকা কনষ্ট্যান্‌টলি চাপ দিয়ে যাচ্ছে ভারতের ওপর যাতে ভারত ওষুধের দাম বাড়ায় কিন্তু ভারত এখনো সে কথায় কান দেয়নি, কিন্তু, এ দুর্বল দেশ কয়দিনই বা ঠেকিয়ে রাখবে ডলার যাদের কারেন্সি, সেই তাদের?; কিন্তু তখন এসব কিছুই জানা যায়নি, বোঝা যায়নি। যা জানা গিয়েছিলো, মেয়েটি এরপর আর চার মাস বেঁচেছিলো। আমার বান্ধবী যেদিন আমায় এই ঘটনাটা জানালো তার মাসখানেক আগে মেয়েটির শরীর ধূসর আর কালো ছাই হয়ে গেছে। দুঃখের কাহিনী। কিন্তু আমি চুপচাপ। চীনেবাদাম চিবোচ্ছি। একসময় কি একটা মনে হওয়াতে পট করে বলে বসলামঃ আচ্ছা ***, বায় এনি চ্যান্স, মেয়েটির নাম কি বাসবদত্তা? বান্ধবী বিস্মিত নয়নে, তখনো সেখানে জলছাপ, আমায় শুধোলোঃ তুমি কি করে জানলে? আমি, ওই চীনেবাদাম, সাধে কি শালা লোকে আমায় হার্টলেস, কোল্ডষ্টোন এসব বলে, চিবোতে চিবোতে বললামঃ দিন কয়েক আগে নিউজপেপারে স্মৃতির উদ্দেশ্যে কলামে এই নামটা দেখেছিলাম। হঠাৎ কি মনে হওয়াতে জিজ্ঞাসা করলাম। দেখো, কি মনে হলো সেটা যেন আবার জিজ্ঞাসা কোরো না। তবে হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম, ঘটনাটা পুরানো, মানে, বছরপূর্তি হয়েছে। এখন দেখছি টাটকা ঘটনা। খারাপ লাগছে। হুবহু এইরকম বলেছিলাম কিনা জানি না, তবে এইজাতীয় কিছুই, মানে, আমি যেমন। কিন্তু ওই শেষ বাক্যটা এক্কেবারে মিথ্যে কথা ছিলো, আমার খারাপও লাগেনি, ভালোও লাগেনি। শুনলাম। কেউ কিছু বললে, বিশেষ করে, শোকের খবর, শুনে তো যেতে হয়, মাঝে তো আর বলে ওঠা যায় নাঃ থাম তো ভাই, বেকার হ্যাজ নামাস না ! কিন্তু বান্ধবী, আমার দিকে অপলক চেয়েছিলো, যেন আমার বুক ফুঁড়ে পিঠ, পিঠ ফুঁড়ে পিছনদিক অবধি দেখতে পাচ্ছে; তারপর, একসময় বলে উঠেছিলোঃ একেই প্রব্যাব্‌লি ইন্টিউশন বলে, অনিন্দ্য।

 

#

 

আমার দু-নম্বর কেসটা, মানে, ওই স্মৃতির উদ্দেশ্যে কলাম থেকে পাওয়া কেসটা, আবার একটু আলাদা। এটা সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই, আমি, জাস্ট, ন্যারেট করে যাবো। পাঠক-মেধাকে আমি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা করি এবং সেই সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকি, অ্যাব ইনিশিও।

স্মৃতির উদ্দেশ্যে কলামে, আমি, এই স্মৃতি নিয়ে হাহাকার দুবার দেখেছিলাম, পরপর দুবছর। আন্দাজ হয়, এই ঘটনা পাহাড়ে ঘটেছিলো, দুজন সমতলের মানুষকে নিয়ে। এবং আরো মনে হয়েছিলো, কি দেখে তা আজ আর মনে নেই, যে, পাহাড় থেকে নামবার সময় তাদের গাড়ী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং সেই দুজন মারা যান। খুব সম্ভবতঃ অন স্পট। ছেলের মা-বাবা, দুজনের, মানে তারা কিনা কাপল্‌, কপাল চাপড়াচ্ছেন ওই শোকবার্তায়। তো, এই হলো মোদ্দা গল্প; এখন তো আর খবরের কাগজ পড়ি না, কাজেই জানিও না, যে, ওই শোকবার্তা নির্দিষ্ট দিনে আর বের হয় কিনা। কিন্তু এটা জানি, আমি আর জয়িতা, কতই যে করি বৃথা পর্যটন, পর্যটন মানে তো হিমালয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না, এক, তোমার কাছে তো যাই নে ছাড়া। আমরা যতবার হিমালয়ে গিয়েছি, ততবার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি, যে, আমাদের গাড়ীটা কেন খাদে পড়ে না ! হিমালয়ের কোলে মৃত্যু; - সে তো অসীম সৌভাগ্যের।


কিন্তু ছবিটা বদলে গেলো ১৬ ই জানুয়ারী, ২০২১ সালে। হ্যাঁ, এটা একদম কাঁটায় কাঁটায় সত্যি যে, বাবা নেপথ্য থেকে টাকা দিয়ে চুপ করে বসে থাকতো; নিশ্চিত ছিলো যে, বাবি জয়ী ঠিক সামলে নেবে। আমি ২০১৬ সালে আমার মায়ের মাল্টিপল্‌ মাইলোমা, লাস্ট স্টেজে ধরা পড়ার পরের সময়টাকে রেফার করছি। ওই যে বলে না, গুঁতোয় বেড়াল গাছে ওঠে (আচ্ছা, ওটা বেড়াল তো? মাঝে মাঝে এমনসব বেকায়দায় পড়ে যাই; স্মৃতি যদি সাথ না দেয়, তো এই হয়। কি হয়? দিব্যেন্দু পালিতের ত্রাতা গল্প থেকে - (স্ত্রী) মান-সম্মান তো সব গেলো। আর রইলো কি তাহলে? (স্বামী) কেন? মান-সম্মান চলে গেলে যা থাকে, সেটা ! - ধার করে বলতে হয়, স্মৃতি-টিতি তো সব জাহান্নমে গেলো। আর রইলো কি তাহলে? (অনিন্দ্য - ২) কেন? স্মৃতি-টিতি জাহান্নমে চলে গেলে যা থাকে, সেটা ! ইয়ে, মানে, এটাও ওই স্মৃতি থেকেই...
 


গুঁতোয় বেড়াল যদি গাছে উঠতে পারে, তাহলে, বাবা কি আর মায়ের জন্য নার্সিংহোম-ঘর করতে পারবে না? – খুব পারবে। বেশক পারবে। নিশ্চিত পারবে। কিন্তু যার পারা না পারা নিয়ে অ্যাতো কচলাকচলি করেছি আমরা, সে-ই যখন, বলা নেই কওয়া নেই, টুক করে চলে গেলো এবং গন-গনা-গন হয়ে গেলো, তখন, আমাদের গাড়ী খাদে পড়লে মাকে দেখবে কে?
 


এই জায়গাটায় আমরা যাকে বলে, স্টাক অ্যাট ৯৯.৯৯%, হয়ে আছি। মিউচুয়ালি ঠিক করেই রেখেছি, যে, মায়ের পর নেক্সট টাইম আমরা যখন হিমালয়ে যাবো, তখন, ঠিক জায়গা বুঝে, সামনের সিট থেকে উঠে দাঁড়াবো; ড্রাইভার হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই টেনে এক লাথি মেরে ফেলে দেবো গাড়ীর দরজা থেকে বাইরে; অথবা কিছু একটা করবো; যেমন জয়িতা গাড়ী চালাতে জানে। আমি? আমি তো নিবারণের সবকিছুই হেঁ হেঁ; সে যাই হোক, চা খাওয়ার নাম করে এক্কেবারে তক্কেতক্কে ঠিক করে রাখা জায়গায় গাড়ী থামাবো। ড্রাইভার গাড়ী থেকে নামলেই জয়িতা উঠে বসবে ড্রাইভারের জায়গায়, পাশে, ফ্রন্টসিটে আমি। আর যাই হোক, ড্রাইভারকে মারার তো কোনো ইনটেনশন নেই আমাদের। গাড়ী ওদের ইন্সিওর করাই থাকে। তারপর? তার-ও-পর? হয় গাড়ী পড়তে
পড়তে বার্ষ্ট করবে কিংবা একদম খাদের নীচে, কুলকুল বয়ে যাওয়া নদীর কাছে, আমরা দুজন, কাছাকাছি কিংবা একটু দূরে দূরে, তখনো গাড়ীর ভিতর বা বাহিরে বা তার আধা-আধি। 


কুল। চিল।
 


খোলস ছাড়ার পর সাপ কি কখনো শ্যেড স্কিনের দিকে ফিরে তাকায়?

 
 
 
অনিন্দ্য ঘোষ    © 
 

 

ঋণঃ সুমন চট্ট্যোপাধ্যায় AKA কবীর সুমন এবং সলিল চৌধুরী; এছাড়াও, আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ ব্যবহার করে ফেলি এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে


 

 

 

No comments: