জীবনে এই প্রথম তর্পণ, আক্ষরিক অর্থে, করলাম। তবে গঙ্গায় নয়, আমাদের রাজপুর - সোনারপুর অঞ্চলে, যেটাকে, আদি-গঙ্গা বলে মানা হয়, সেই করের গঙ্গাতেও নয়, বাবা-মা'র ঘরে। এমনই নিদান ছিলো আমাদের নিতাই কাকুর, যিনি, আমার বাবার শ্রাদ্ধও আদ্যন্ত ফেসিলিটেট করেছিলেন ব্রাহ্মণ হিসাবে।
তো? তো আবার কি? - তর্পণ হলো। অনেক মন্ত্রোচ্চারণ, ফুল, ধূনো-ধুপ (শেষেরটা আমার ইচ্ছায়) আর স্নান সেরে, সাদা পাজামা পরা বিরল আমি, খালি গায়ে মেরে দিলুম।
এইসব বালের কথা বলার জন্য এই লেখার অবতারণা নয়, সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়। নিতাই কাকু, বললেন তিন পুরুষের নাম এবং গোত্র পেটের্নাল সাইড, তিন পুরুষ মেটের্নাল সাইড, বোথ সেক্স, বলে যেতে। আমি তো, শালা, ঠাকুরদার আর ঠাকুমার নাম জানি; আর দিদি (দিদিমা) আর দাদুর নাম ছাড়া পুরো বিশ বাঁও জলে; আর গোত্র? এহ, হেসে ফেলবো। নিতাইকাকু অ্যাজ আ পার্ফেক্ট ফেসিলিটেটর, 'যথানামঃ' বলে পারানির কড়ি দিলেন আমায়। মাতৃকূলের ক্ষেত্রেও একই প্রসিডিওর ফলোড হলো।
আমার অনুরোধে, আমার বাবা এবং আমার দিদি (দিদিমা) এর জন্য এস্পেশ্যালি শিবঠাকুরের উদ্দেশ্যেও মন্ত্র উচ্চারণ হলো।
অবাক হয়ে গেলাম, যখন আমি একই অনুরোধ প্লেস করলাম নিতাইকাকুর কাছে, যে, আমার তারা মার উদ্দেশ্যে মন্ত্র বলতে। তিনি বলে দিলেনঃ 'ওটা তুমি তোমাদের ঠাকুরঘরে গিয়ে মায়ের কাছে বোলো।'
নিতাইকাকু প্রচন্ড মন্ত্র জানা একজন ভীষণ মডার্ন মানুষ। তিনি কেন এরকম বললেন...তিনি তো জানেন তারামা আর শিবঠাকুর ছাড়া, বিশেষ করে, তারামাকে ছাড়া, আমি আর কাউকে বুঝি না, চিনি না। তাহলে কেন? মিনিট খানেক আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ভাবতে ভাবতে উত্তর পেলাম।
উত্তরটা হলো - মন্ত্র নেই।
পিতৃতান্ত্রিক ফিল্দিনেসটা আর একবারের জন্য স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো আমার কাছে।
এই লেখাটার উদ্দেশ্য এটাও নয়। মন্ত্রে, খেয়াল করলাম, বলতে হচ্ছে দাস্যা বা দাস্যী, যেহেতু আমার পিতৃ এবং মাতৃকূলের কেউ ব্রাহ্মণ নন। এইটুকুটা আমি আগে থেকেই জানতাম, আমার মণিমা (বড়ো মাইমা) মারা যাওয়ার পর ভূজ্যি দিতে গিয়ে। ব্রাহ্মণ হলে তাঁরা হতেন দেবঃ / দেবী, নেহাত অব্রাহ্মণ, তাই...
আমি কিন্তু দাস্যা / দাস্যার জায়গায় বারবার পজ নিচ্ছিলাম, নিতাই কাকু প্রথমে বুঝতে পারেননি, তাই দুবার করে বলছিলেন দাস্যা / দাস্যী। তারপর ধরে ফেললেন যে আমি এটা ইন্টেনশানালি করছি। তারপর থেকে উনিও স্মুথ, আমিও তাই। দুজনে দুজনের জায়গায়।
আপনাদের চুপিচুপি বলি, দাস্যা / দাস্যী এর জায়গায়, আমি, মনে মনে বলে গিয়েছি, দেবঃ / দেবী। যাঁদের উদ্দেশ্যে বললাম তাঁদের বেশীরভাগকেই আমি দেখিনি। জানিও না, তাঁরা কেমন মানুষ ছিলেন।
আমি, জাস্ট, “ব্রাহ্মণ – অব্রাহ্মণ” এই ডাইকোটমিটা ভাঙতে চেয়েছিলাম।
ভুল করলাম কি? জানি না, কিন্তু এইটা জানি, যে, আমার তর্পণ অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো। কারণ আমি, আমার তারামাকেই উদ্দেশ্য করে, আমার জন্মদাতা বাবার কথা আর দিদির (দিদিমা) কথা বলতে পারলাম না।
এবং সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি কোনোদিন আর তর্পণ করতে যাবো না।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ কোনো এক কাছেরজন, যে, পাশেই, মানে, সমান্তরালে আছে।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment