ট্রাম্প ট্রাম্পড হওয়ার মুখে। এমন সময়, যদিও এককালের বন্ধু হিসেবে এমন কথা ছিল না, তবুও ট্রাম্পের ট্রাম্পেট বাজব বাজব করছে, ঠিক এমন সময়, তার হাত ছেড়ে দিয়ে, ভারত, তার সাবেক বন্ধু রাশিয়ার হাত ধরল। তুরুপিত অবস্থায় ট্রাম্পের হুঙ্কার ছাড়া আর কোনও চারা নেই। এরই ফাঁকে যে যার মতো করে শৌর্য দেখাচ্ছে। দেয়ার ইজ নো ফ্রিবি, বাট দ্য ফ্রী শো ইজ গোয়িং অন... অ্যান্ড দ্য পার্টি নেভার এন্ডস।
পার্টি বলতেই মনে পড়ল, চীনও কন্ডিশনাল মৈত্রীর খত পায়রার পায়ে বেঁধে পাঠিয়েছে। ত্রিদেশীয় বন্ধুতা, পরে যা প্রসারিত হবে। সি জিং পিংয়ের ভাবনা তেমনরকম। পিংপং বলের মতোই এই জিও পলিটিক্স, আজ সিদ্ধান্ত এইরকম, তো কাল সেইরকম, পরশু গিয়ে দেখা যাবে, সেটা ওইরকম হয়ে গেছে।
তবে চীন আক্ষরিক অর্থে বেণে হতে শিখেছে। জেনেছে একটাও রণাস্ত্র ব্যবহার না করে কিভাবে মুঠোর মধ্যে পৃথিবীটাকে নিয়ে নেওয়া যায়। বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী, নারায়ণ অ্যান্ড আদার বত্রিশ কোটি নিরানব্বুই লক্ষ নিরানব্বুই হাজার নশো আটানব্বুই গডস আর ড্যেইটিজ়।
ভারত এই নব্য বন্ধুত্বের সময় বিবিধ চোরাস্রোতকে নিশ্চয়ই মাথায় রেখে সাবধানী অথচ ইতিবাচক পা-ই ফেলবে। রাশিয়াকে নিয়ে তেমন শঙ্কার কারণ দেখি না, কারণ রাশিয়া যাই করুক না কেন, সে দেশটা ভীষণই এক্সপোজড দেশ।
আর এক্সপোজড হতে হতে, এক্সপোজড হতে হতে হতে, তারপর একটা সময় রাশিয়া বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সমাজতন্ত্র মানেই, কেতাবে যে যে ভালো কথাই লেখা থাক, বাস্তবে, আমি (কালেক্টিভ) বলব, তুমি (কালেক্টিভ) শুনবে'র গল্প। আমার তো মাঝেমধ্যে বিস্ময় জাগে নেহাত গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিলে মূর্খামির চরম হবে, তাই কোনও কম্যুনিস্ট দেশই গণতন্ত্রকে ডিসকার্ড করে না; করতে পারে না বলেই করে না। বস্তুতঃ অ্যান্টি-ডেমোক্র্যাসী স্ট্যান্ড রিগ্রেসন মাত্র। অতএব কম্যুনিস্ট দেশগুলোর কাছে, আমিও প্রোগ্রেসিভ, অর্থাৎ ডেমোক্র্যাসী হলো মিয়্যার একটা ট্যাগ। তা না হলে তারা সমাজতান্ত্রিক হতে যাবে কেন? আমিই বা একচেটে জ্যাঠামো করতেই যাব কেন, আর মানুষই বা সেটা মানবে কেন; গুটিকয়েক কাসপারভ ছেড়ে রাখা যেতেই পারে, যে চৌষট্টি খোপ ছেড়ে বেরিয়ে এসে তেড়ে খিস্তি করবে। দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে! বলে আলো ফেলবে নিজের মতো করে। তা একটু নিন্দে-মন্দ না হলে প্রেম-পীরিতি জমে নাকি কখনো?
সব মানুষের একটা ন্যূনতম ভালো হতেই হবে - কম্যুনিজমের এই স্কেলিটন স্ট্রাকচারের ভাবনাটা খারাপ নয় কখনও, বরং বলা যেতে পারে মহৎ; তা নোবল একটা কনসেপ্টকে গানপয়েন্টে হ্যান্ডগান ধরে রোল আউট করতে হচ্ছে মানেই সেটা একটা ইন্ডিকেটর যে, সেই সার্টেন অঞ্চলের মানুষ এই ফান্ডার শিঙে ফুঁকে দিয়েছে। অর্থাৎ সব্বার ভালো হোক, এটা আর যাই হোক, সব্বাই চায় না। এটা এও বোঝায়, সে অঞ্চলে সবার আগে শিক্ষার প্রয়োজন যাতে চেতনা আর চৈতন্যের ফারাক কমে।
রাশিয়া, মা কি ছিলেন, মা কি হইয়াছেন, ব্যাপারটাকে কিছুটা দীর্ঘমেয়াদী দেখলে গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকাকেই আপনার কসমেটিক চেঞ্জ মনে হবে; বস্তুতঃ দেশটা অনেককালের স্বৈরতন্ত্রের শিকার। হয়তঃ বা তার ফর্ম বদলেছে, কিন্তু শ্বাস চাপা আবহাওয়া কোনোদিনই বদলায় নি। নিও রাশিয়ান সিনেমাগুলোর দিকে তাকান, কার্গো ২০০ থেকে শুরু হয়েছিল, প্রত্যেক স্বনামধন্য নিউ এরার রুশ সিনেমা পরিচালকদের কাজে একটা জিনিস বারবার ফিরে আসছে গ.সা.গু'র মতন, সাফোকেশন। এমনকি প্রত্যেক সিনেমার মিউজিক্যাল স্কোরও মন-মাথা কামড়ে ধরে। ব্লাডশেড দেখানো হচ্ছে, কিন্তু সব রক্তই জমাট বাঁধা কালচে লাল, হলদেটে কালারিমেট্রির মধ্যে; একফোঁটা তাজা লাল রক্ত আপনি দেখতে পাবেন না।
এমনিতে ইউরোপ খোলামেলা জায়গা এবং রাশিয়াকে তারা চাষার দেশ ধরে চলে। বাস্তবিক, গণতন্ত্রকে রি-ডিফাইন করেছে তারা, কখনো-সখনো এত বেশী করে করেছে, যে, পার্সোনাল স্পেস এবং উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে ধন্দ ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের সিনেমা নানারকম, অন্যদিকে, রাশিয়ার সিনেমার মূল জঁর ক্রাইম, এর সঙ্গে আসে যৌনতা এবং খুব, খুব কদর্য ভায়োলেন্স। পলিটিক্যাল ডিসকোর্স থাকলেই একটা শব্দ আমাদের কানে এসে ঝামরিয়ে গেছেঃ আন্ডারগ্রাউন্ড। আন্ডারগ্রাউন্ড লিটারেচার, আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমা - রাশিয়ায় মাটির নীচে মানুষের বয়ান পোঁতা আছে।
রাশিয়ায় কিন্তু বিদ্রোহ অন্যভাবে শুরু হয়েছিল; জানি না হারবার্ট মার্কিউজ বা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল পর্যবেক্ষণ থেকেই ওই অমোঘ মন্তব্যটা করেছিল কিনা। তবে বিরুদ্ধাচারণের ফুলকির দেখা মিলেছে পর্নতে, এটা ভাবতে অবাক লাগে বৈ কি!
অন্যদিকে, নানজাই রুলসকে কায়েম করে দেওয়া চীনের সিনেমা ভারী অদ্ভূত - ক্যারাটে, কুংফুর কড়চা সেখানে রমরমিয়ে চলে। এ বাদে তাদের সামাজিক ছবিগুলোতে কোমলতার প্রাচুর্য এতটাই যে আপনি বিস্মিত হতে বাধ্য। এক ফুটফুটে কিশোর জীবন শিখছে তার ঠাকুর্দার কাছ থেকে, বাবা-মা তার দূরে, কর্মসূত্রে, আর দৈনন্দিন মিঠে হাওয়ায় সে বড় হচ্ছে পিতামহের কাছে, পুরানো দিনের গল্প শুনতে শুনতে। তার ভিতর জমা পুরানোকে সরাবে, এমন সাধ্য কার। কিংবা, এক মহিলা, যিনি পরামানিকগিরি করে জীবন কাটিয়ে এলেন, তাঁর স্টেটাস কখনোই কেয়া শেঠের মতো নয়, আবার তাই বলে তিনি নাপতেও নন। দীর্ঘ কর্মজীবনের পর, যখন কিনা তাঁর ছেলেপুলেরা ছোটখাটো কামধান্দায় সেটলড, তিনি তাঁর সেকেন্ড হ্যান্ড মোটরগাড়ি নিয়ে চলে যান অনেক দূরে, তাঁর এককালের নিয়মিত খদ্দের বুড়ো হয়ে এখন মৃত্যুশয্যায়, সেই তাঁর চুল কাটতে। যাওয়া আসার ধকল সামলাতে গিয়ে তাঁর মনে হয়ঃ ঢের হয়েছে, এবার অবসর ভালো। কিন্তু তাঁকে প্রবল বাধা দেয় তাঁর খদ্দেররা; - তিনি যদি চুল কাটা বন্ধ করে দেন তাহলে চুল কাটানোর জন্য চেয়ারে বসে নিশ্চিন্তে কি করে চোখ বোজাবেন তাঁরা। ভদ্রমহিলা জীবন খুঁজে পেয়ে যান, তাঁকে চুল কেটে যেতে হবে, চুল কাটার ফাঁকে ফাঁকে খদ্দেরদের সঙ্গে গল্পগাছা করে যেতে হবে।
একটা দেশ, পুরোপুরি পর্দা টেনে প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানেও কিন্তু ওরিয়েন্তাল মূল্যবোধের অভাব তো নেই-ই বরং এই টইটুম্বুর পূর্বীয়ানা আমাকে তো মুগ্ধ করে; কি করে সম্ভব হলো এটা?!
আমদানি করা গণতন্ত্র নিয়ে হলিউডের সিনেমার বাজার, আর সেখানেই থাকেন গল্পদাদুরা। গল্প কিভাবে দর্শককে ঘাড় ধরে টেনে বসিয়ে শোনাতে হয়, সেটা কোই উন লোগোসে শিখে। লার্জার দ্যান লাইফ ব্যাপারটাই এসেছে গল্পের ভেতর দশর্ককূলকে সেঁধিয়ে নেওয়ার জন্য। জিন্দেগী-চর্চা পরের ব্যাপার। প্লাস, হরদিন এক্সপেরিমেন্টাল কাজ হচ্ছে। হলিউড তো তার মতো করে সম্মৃদ্ধ বটেই। কিন্তু সেটা স্পনসরড। যেখানে চীনকে তো কেউ কোনো মাথার দিব্যি দেয় নি! আর বেচারা রাশিয়া, তারা আগে ভালো করে প্রশ্বাস নিক। নিঃশ্বাস ছাড়ুক। সিনেমা পরে বানালেও চলবে ‘খন।
আর জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিতে যাওয়া সেই দেশটার কি খবর? কেন, আপনি যতই ঘুড়ি ওড়ান সে দেশের আকাশে কি রাতে কি দিনে, লাটাই কিন্তু অন্যজনের হাতে। আর সে জানে, কত সুতো সে ছাড়বে। এখানে সবই করা যায়, সবই করতে দেওয়া শুধু নয়, এনকারেজ করা হয় র্যাদার, কিন্তু সবকিছুই মিটারড। এই মিটারের নিদান মেনে চললে আপনার ব্লকবাস্টারের জ্যাকপটও মারা হলো, অন্যদিকে লাটাইধারীরাও নিশ্চিন্তঃ কাকে কি বলার জন্য বাংলাদেশী ট্যাগিয়ে সে দেশে চালান করে দেওয়া হবে কিনা, নেশন বিল্ড যাঁরা করেন, সেই শিক্ষকদের চাকরির বিক্রি-বাট্টা কেমন ও কতটা হবে, অথবা, যতই অন্যদেশের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিরা এসে নিরীহ মানুষদের বুলেটভাসি করে দিক না কেন, ওয়ারটাইম প্রেয়ার হলো, সেই অন্য দেশবাসীদের জল দাও, খাবার দাও। চাষের সুরাহার জন্য বাঁধ খুলে দাও। এটা নাকি পুরোটাই শাসকদলের ক্রিয়েটেড অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ ম্যানিপুলেটেড ন্যারেটিভ। কেউই বাইরে থেকে গুলি মারে নি, যা হয়েছে সব স্বদেশের সীমার মধ্যে, এমনকি, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিরাও ছিনাথ বহুরূপী, ঠিক যেমন এককালে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান আওয়াজ উঠেছিল। লেফটিস্ট বয়ান শুনতে অ্যাত্তো ভালো লাগে না, যে কি বলব। কি রঙীন স্বপ্ন যে দেখায়...
কিন্তু আপনার তাতে কি আসে যায়! আপনাকে তো নিয়ন্ত্রণাধীন একইরকম বা অন্যরকম ঘুড়ি ওড়াতেই বলা হয়েছে। বলেছে খোদ সুতোর মালিকরা। আকাশ তো অন্তবিহীন, অতএব, জাহান্নমে যাক ব্রেশট, আপনি মুভমেন্ট, তার পলিটিক্যালিটি-অ্যাপলিটিক্যালিটির ডায়কোটমি ভাঁজতে ভাঁজতে ঘুড়ি, হ্যাঁ, ওড়াতে থাকুন। আপনি রাত জাগছেন এই না ঢের, রাত নিজে থেকে হেঁটে এসে আপনার দখলের মধ্যে ঢুকে যাবে, কোনও ধকলই পোয়াতে হবে না আপনাকে! আর, আর, আর আফটার অল, দেশটাও তো আপনার, নাকি!
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ গুগল ইমেজেস ।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment