Friday, August 22, 2025

নো উইম্যান নো ক্রাই – মেয়েরা নেই, মানে, কান্নাও মারা গেছে

 

No, woman, no cry
No, woman, no cry
No, woman, no cry
No, woman, no cry

 

'Cause, 'cause, 'cause I remember when we used to sit
In the government yard in Trenchtown
Oba, observing the hypocrites, yeah
Mingle with the good people we meet, yeah
Good friends we have, oh, good friends we've lost
Along the way, yeah
In this great future, you can't forget your past
So dry your tears, I say, yeah

 

No, woman, no cry
No, woman, no cry, eh, yeah
Little darlin', don't shed no tears
No, woman, no cry

 

Eh, said, said, said, I remember when we used to sit
In the government yard in Trenchtown, yeah
And then Georgie would make the fire lights, I say
A log wood burnin' through the night, yeah
Then we would cook cornmeal porridge, I say
Of which I'll share with you, yeah
My feet is my only carriage
And so I've got to push on through
But while I'm gone

 

Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright
Everything's gonna be alright

 

So no, woman, no cry
No, woman, no cry
I say, oh little, oh little, darling, don't shed no tears
No, woman, no cry, eh

 

No, woman, no, woman, no, woman, no cry
No, woman, no cry, one more time I've got to say
Oh little, little darling, please don't shed no tears
No, woman, no cry

No, woman, no, woman no cry

 

 

মেয়েদের সঙ্গে দেখা না হলে অশ্রুদাগ আমার দেখা হতো না। এমন নয় যে জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই আমি পুরুষদের কাঁদতে দেখি নি; শ্মশান চত্বরে এসেও রক্তাক্ত ছেলের মৃতদেহের ওপর লুটিয়ে পড়ে ডুকরে ওঠা বাপের হাহাকার; কিংবা, থুড়থুড়ী মা মরে গিয়ে বেঁচেছে, তবু মায়ের শয়ানের দিকে পিছু ফিরে দেওয়াল আঁকড়ে ছেলের অবিরত কান্না – হ্যাঁ, এ জাতীয় দেখেছি আমি। এবং সেটা নেহাত খুব যে কম, তাও না। তবুও আজ এই পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়েও আমার মনে হয়, কান্নার দালানকোঠা উঠেছে মেয়েদেরকে ভিত বানিয়ে। এক পুরুষ অনেকটা বা সামান্য কেঁদে, নাক ঝেড়ে মিশে যেতে পারে, মিশে যায় বান্ধব বাহুডোরে, কিন্তু কান্নার সীমারেখা পার হয়ে এলে মেয়েরা বড় একা।

 

এমনও হয়েছে মেয়েদের কান্নায় বেধড়ক বিরক্তি ধরেছে আমার; সুর যে কান্নার সঙ্গে ওতপ্রোত যেমন কিনা স্তব্ধতা, সেই সুরহীন বিলাপ শুনে অপরিচিত আমি, বাংলার গেলাস হাতে নিয়ে, নিরাসক্ত নয়, তিতিবিরক্ত উঠে গেছি চিতার পাশ থেকে। চিতার আগুনের মধ্যে এক মারাত্মক টান আছে, ঘুর্ণি আছে, একটা যাদুটোনায় সে চোখ জোড়াকে ধরে রাখে আগুনের শিখার দিকে, মানুষের কন্টেইনারটাকে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেওয়ার দিকে; তবুও সব কিছু টান কাটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও অতঃপর, বনের দিকে গিয়ে পেচ্ছাপ করতে করতে নেশার চাপ হালকা করেছি। ফিরেও তাকাই নি কাঁচা কাঠ ফাটার শব্দে, অথবা, আগুন সশব্দে চড়চড়িয়ে বেড়ে উঠলে ‘পর চিতার দিকে; হ্যাঁ, কান্নার শুধু ওই ক্লান্তিকর ধ্বনির জন্য।

 

কিন্তু মানুষের পৃথিবী তো কান্নার। যতই সুখের দিন ঢাকঢোল, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে দুঃখকে তড়িপার করে মানুষের দোরে এসে দাঁড়াক না কেন, যতই বিজ্ঞান যুদ্ধের অস্ত্র বাদে বাকী সব গবেষণা মানুষের সুখভোগের জন্য উৎসর্গ করে দিক না কেন, মানুষের পৃথিবীতে কোনও এক বা একাধিক কারণে উপুড়-চুপুড় কান্না থইথই করছে।

এত পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারলেই ফোলা ফোলা চেহারার এক ফর্সা মেয়ের আঁচল, কি ওড়না, কি দোপাট্টা কি স্টোল দেখতে পাই আমি; - শরীরে তার কান্নার দমকের চিহ্ন নেই কোনও, কিন্তু চোখ জোড়া অসম্ভব লাল।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে যায়, অশ্রুর যদি কোনও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকে, তবে কি সেটা শুধু মেয়েদের ওপর? যদি না-ই হবে, অসুস্থতার দিনগুলোতে, যে অসুখগুলো কিনা অনারোগ্য নয়, কেন এক পুরুষ তার কপালে এক নারীর হাতের স্পর্শ প্রত্যাশা করে? কেন কি ছেলে, কি মেয়ে – শৈশবকে মনে করতে চাইলে অবধারিত এসে যায় মায়ের আঁচল, যেখানে, অভাবের ছোপ ছোপ রঙ লেগে আছে?

 

আগে, এ আমি একবার নয়, বহুবার লিখেছি, মানে লিখে ফেলেছি আর কি, এসব কথা তো আর সচেতনে বলার নয় যে, বান্ধব-আড্ডার দিন আমরা ফেলে এসেছি। সত্যি কথা লিখতে কি, এখন আমার কোনও শিকড় নেই। মানুষ বাড়ী বলতে শুধু ইঁট, বালি, সিমেন্টের গাঁথনি নয়, তার সঙ্গে তার চারপাশটাকেও বোঝে। আর আমার, আমাদের চারপাশ ছোট থেকে ক্রমশঃ আরও ছোট হয়ে আসছে। যেমন, এই আমাকেই ধরুন না – আমার ঘর বলতে বিছানা আর ডেস্কটপের সামনের চেয়ার। বেডরুমের কথা লিখছি। ট্যাব, কিন্ডল, কিছু বই সটান বিছানাতেই, কারর স্থান চ্যুতি হয়, বিছানা থেকে বুকশেল্ফে যায়, আবার কেউ বা বিগ্রহের মতন অটল, অনড়। বাদবাকীর জন্য ডেস্কটপ। গ সা গু বলতে মোবাইল ফোন, ব্লু-টুথ নেকব্যান্ডস বা ইয়ার বাডস। সারা ঘর জুড়ে ওয়াই ফাই টলটল করছে। কতদিন হয়ে গেলো, গোধূলি হয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে বুঝতে পেরেও, আমি জানলা খুলি নি।

 

কিন্তু কেমন ছিল আমাদের বান্ধব আড্ডা? বিশ্বাস করুন, শুধু খেউড় গান দিয়ে ভরা ছিল না সেসব দিন-সন্ধ্যা, মাঝরাত। হ্যাঁ, যুগ এবং বয়ঃধর্ম মেনে রেড শ্যূ ডায়েরি দিয়েই শুরুটা হয়তঃ হত, কিন্তু কিছুক্ষণ পর অবধারিতভাবেই আমরা চলে যেতাম রেড বুকের দিকে। আমি না বুঝলেও যারা বুঝত, তাদের অনেকেই নিখিল ব্যানার্জী আর আলি আকবর খানকে নিয়ে উত্তপ্ত হতে হতে মারপিট ঘনিয়ে এলে তাদেরকে শুধু ঠান্ডা করার জন্য মল্লিকার্জুন মনসুরের বন্দিশ, কিংবা বিসমিল্লা খানের আমেরিকাকে তুড়ি মেরে হাডসন কি কলোরাডো কি স্নেক নদীতে ফেলে দেওয়ার গল্প ঘনিয়ে আসত। চেনা গল্প, বহুবার শোনা, তবুও আসত, যেমন বারবার শোনা রূপকথার গল্প আবারও শুনতে বসলে ‘পর, পরিচিত পরীরা নামে। আমাদের সেই ঠেক, ঠিকানা পাল্টাতে পাল্টাতে উঠে গেছে কমদিন হলো না, সেসময় যাদেরকে খুব কাছের বন্ধু বলে মনে হত, পরে দেখা গেলো তারা চরম স্বার্থপর, নীচ, ব্যাক-স্ট্যাবার এবং সর্বোপরি, ভন্ড। তারা সেসময় মুখোশের আড়ালে ছিল, পরিশীলিত মুখোশ, এখন তাদের হায়েনা-মুখ দেখা যায়, আমি অন্ততঃ ঘেন্নায় দেখি না। নাহ, ঘেন্নাটা তাদের ওপর নয়, ঘেন্নাটা নিজের ওপর, একদিন পরখ না করেই বন্ধু ভেবেছিলাম বলে। বন্ধু ভেবেই তাদের দয়িতার কাছে তাদের হয়ে বলতে গিয়েছিলাম বলে, তাদের কারোর প্রেম সম্পূর্ণতা পেয়েছে, কারোর বা পায় নি, কিন্তু আজ সেই মেয়েদের সামনে দাঁড়ালে বড়ো কুঁকড়ে যাই; আজ যদি তারা জিজ্ঞাসা করে, যদি হিসাব চায় – কি বলবো তাদের! তারা সেসময় আমাদের সঙ্গে মিশে ছিল প্রখর, আমাদের ত্বক আর তাদের খোলসের মধ্যে ফারাক বুঝতে পারি নি আমরা।

 

মনে পড়ে হাসানের কথা। হাসানের কথা অন্যত্র লিখেছি কিনা মনে নেই, দু-এক কথায় সারি; - লেখাপড়া বলে যে একটা বস্তু পৃথিবীতে আছে, ইচ্ছে করলে সেটা যে করাও যায়, সেকথাটা  কোনও দিনই হাসান ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে নি। তার সম্পত্তি বলতে ছিল মাঠ এবং মাঠের সবুজ ঘাস; কিন্তু শুধু মাঠের কথাই কেন বা বলছি, তাস, দাবা, ক্যারম কিছু না জুটলে লুডো, ব্যাগাডুলি, চাইনীজ চেকার, তাও না হলে বাঘবন্দী খেলা – হাসানের সে উদ্যমকে দমাতে পারে, এমন অবিদ্যা কই। চুপি চুপি বলে রাখি, হাসানকে আমি চূড়ান্ত পারদর্শীতার সাথে চু কিত কিত, বুড়ী বাসন্তী, গজে খেলতেও দেখেছি। দূর্গা, কালী, সরস্বতী – সব পূজাতেই হাসান রোজা দিয়ে নৈবেদ্য সাজাত। কিন্তু ইফতার নেই, নেই কোনও আমিষ গন্ধ, ঐসব দিনগুলোতে হাসান ছিল গরুর মতো নিরামিষ-খোর, আমাদের আমিষভোজের বিবরণ শুনে বেচারা শিউরে উঠত। রইলো পড়ে মেয়ে; - হাসান মেয়ে দেখলেই একশো আশি ডিগ্রী দিকে দৌড়োত দিকবিদিক। মনে আছে, একবার ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে এক স্বল্প পরিচিতা কিন্তু অতীব সুশ্রী মেয়ের সঙ্গে আলাপ করছি, মানে, খেজুর করছি; হাসান সেটা দেখে লুকোবার আর কোনও জায়গা না পেয়ে, ক্যারম বোর্ডের তলার কাঠের ফ্রেমের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলো। দৃশ্যটা ভাবুন একবার, মেয়েটি কিন্তু তাকে সটান দেখতে পাচ্ছে অথচ লুকিয়ে পড়ার ভঙ্গি। সে শুধোলেঃ ‘আপনার ওই বন্ধুটা ও’র’ম করছে কেন?’ আমি মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বললামঃ ‘ও কিছু না, তোমাকে দেখে লুকোচ্ছে। তুমি হিন্দুর ঘরের মেয়ে কিনা। আর হাসান তো মুসলমান।’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে সে জানতে চাইলেঃ ‘আর আপনি?’ আমি আর কি বলিঃ ‘আমি? আমি হলাম গিয়ে ব্লেন্ডার্স প্রাইড (তখন সীগ্রামের ছিল)। তা আজ সন্ধ্যেবেলা কি করছো? ফ্রী আছো তো?’ ঘাড়, নাহ্‌, ভুল লিখছি, গ্রীবা হেলিয়ে, মেয়েটি, পজিটিভ জানিয়েঃ ‘আপনার ওই বন্ধু কিন্তু ছিটিয়াল।’ আমি কখনও এসব আপৎকালীন সময়ে উদারতা দেখাতে ভুলি নাঃ ‘বেশ তো, ওই ছিট থেকেই না হয় তোমার জন্য একটা হ্যাঙ্কি নিয়ে যাব ‘খন। (পাশেই নিউ প্যারাডাইস টেলার্স দেখিয়ে) জব্বরকে (তখনও ওর ছোট ভাই আসগরের প্যাংক্রিয়াসে ক্যানসার ধরা পড়ে নি) বললেই ও ফটাফট বানিয়ে দেবে। এই ফ্রিল দেওয়া ইয়েলোয়িশ স্কার্টটাই পরে এসো কিন্তু। আর এই কালো রঙের টপটা। সাদা কমপ্লেকশনে কন্ট্রাস্ট কালার খুব ভালো যায়।’

 

হাসান তার শেষ জীবনে সত্যিই পাগল হয়ে যায়। তীব্র উইদড্রয়াল। ডীপ ডিপ্রেশন। তবু ছেলের খেলার প্রতি টান মরে নি। যেদিন হাসান সুইসাইড করে, তার আগের দিনও ও ক্লাবে এসেছিল, কথা প্রায় নেই, উদাস, আনমনা চেয়ে থাকা, উদ্দেশ্যহীন; কিন্তু সেদিনও চেস খেলতে বসে, খেলার সময় চিউয়িং গাম চেবানো ছিল ওর প্রিয় ব্যসন, তা হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে, নিজের কোণঠাসা রাজাকে প্যালপেবল চেকমেটের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে, ও নিজের হাওয়াই চটির একটা ধার চেবাচ্ছিল। আমরা সেসবে গুরুত্ব দিই নি, প্রায় ম্যানিক ডিপ্রেসিভ একটা ছেলের টেম্পোরারি নরমালসি দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। হাসান সে ম্যাচ বাঁচাতে পারে নি, হেরে যায় পিন্টুর কাছে। বস্তুতঃ আমি বা আমার বন্ধুরা কেউই কোথাও বিশেষ জিতি নি, জিতবও না, তবুও আমরা মাঠে নামতে দ্বিধা করি নি কোনও দিন।

 

হাসানের মৃত্যুর খবর পেতে আমাদের বেশ কিছুটা দেরী হয়। মিসিং ডায়েরী হয়েছিল। তখন মিসিং এফ আই আর, জিরো এফ আই আর বা ই-এফ আই আর এর চল আসে নি; তিনদিন কি তারও বেশী পরে আমাদের কাছে খবর আসে শিয়ালদা মর্গে, এখন যেখানে, মেট্রোর পরে পরে বিস্তর ফুডস্টল হয়েছে, সোনারপুর জি আর পি’র একটা ইউ ডি কেসের বডি আছে। আমাদের কয়েকজন সেখান থেকেই হাসানকে পায়, ততোক্ষণে ওর বডি ডিকম্পোজড হতে শুরু করেছে। পরে শুনেছিলাম, সোনারপুর থেকে ডাউন ক্যানিং লাইন যেখানে আলাদা হয়েছে, সেখানেই প্রথম সিগনাল পোস্টের সামনে থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল হাসান। অথচ ওখানে ট্রেন কি আস্তে যায়, অন্ততঃ তখন যেত, কেননা, তখন সোনারপুরের পর থেকে বাকী ক্যানিং সিঙ্গল লাইন ছিল, আর বেশীরভাগ ডাউন ক্যানিং লোকাল ছাড়ত দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে। এখন চার নম্বর থেকে ছাড়ে, সোজা লাইন ক্লীয়ার থাকলে ট্রেনের গতি ভালই ওঠে।

 

প্রসঙ্গ এখানে শেষ নয়, হাসানের মৃত্যুর খবর পেয়ে সেই যে সেই সুশ্রী মেয়েটি, ততদিনে জেনে গিয়েছি, তার অপরাপর অনেককিছু সমেত ঠোঁটজোড়াও ভারী নরম; সেই মেয়েটির সে কি কান্না। অথচ হাসানকে সে দেখেছিল একবারই। সে যত না কাঁদছিল হাসানকে ভেবে, তার চেয়ে ঢের বেশী কাঁদছিল হাসানের মায়ের কথা ভেবে। এবং সেই ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার সামনে বেশীক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। কিছু বলা? – সে তো আরও যায় না। পরের দিন যে সন্ধ্যায় দেখা হলো, সেদিনও তার ওই একই, ঝরো ঝরো ধারা। তৃতীয় দিনেও তাই। আমি আর চতুর্থ দিনের রিস্ক নিই নি। ল্যান্ডলাইন ককিয়ে উঠে উঠে থেমে গেছে। ধরি নি। আমি কখনও মৃত্যু বা মৃত্যুশোক বা কান্না – এসবের সামনে দাঁড়াই না। ন্যায্য দূরত্ব থেকে দেখে আসছি তাদের।

 

আমাদের পাড়ার দিয়ার প্রসঙ্গ উঠলে অবশ্য ওসব ন্যায্য দূরত্বে থাকা-টাকা লাগে না। দিয়া আমারই কাছাকাছি বয়সের। একটা সহজাত বন্ধুত্ব সুতরাং ছিলই। কিন্তু যেটা ওর সহজাত এবং আমার নয়, সেটা হলো ছবি আঁকা। আর, আর, আর হলো গিয়ে রবীন্দ্রনাথ। হ্যাঁ, ঠাকুর-দেবতার কথাই বলছি। কিন্তু টেরিটরি টোটালই আলাদা। আমার রবীন্দ্রনাথ মানে কি? – কি-ই বা আর হতে পারে, কিছু বই, কিছু ক্যাসেট, অধুনা, সিডি ছাড়া। দিয়ার আগ্রহ রবীন্দ্রনাথের ছবি। তা না বুঝেও একটা সৃষ্টিকে ভালো বলে লেবেল মেরে দেওয়াই যায়, বিশেষ করে সামনে যখন মোটের ওপর সুশ্রী, গৌরাঙ্গী, দোহারা শেপের ভারী অ্যাট্রাক্টটিভ ফিগারের মেয়ে; কিন্তু কোথায় ব্রাশের স্ট্রোক কেমন, পেনসিলের টাচ কেমন, বা আরও গোড়ায় মারলে পেনসিলটাই কেমন – এসব কি বলা যায় নাকি, বিশেষ করে আমার মতো অশিক্ষিতদের পক্ষে! তবুও মাঝেসাঝেই বাইক থামিয়ে সোডিয়াম ভেপারের নীচে সন্ধ্যের হিম মাখার জন্য আমাকে দাঁড়াতেই হত। আমাদের গোটা বন্ধুদের দলের সঙ্গেই দিয়ার পরিচয় ছিল। যার সঙ্গে ওর প্রথম মাখামাখি হয়, সেই দীপু এই কিছুদিন আগে হ্যাভক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে ফেঁসে গিয়ে, মানে, এক্কেবারে টেঁসে গিয়েই আমাদের জন্য ঘন্টা নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। দীপুর সঙ্গে একসাথে কিছুটা চলার পর আলাদা সাথী খুঁজে নিতে দিয়া খুব একটা দেরী করে নি। পথই নাকি পাল্টে গিয়েছিল। অতঃপর হাতে থাকা হাত বদলে যেতে থাকে ও ফলতঃ, আমাদের ঠেকের আবহাওয়া। মাঝেমাঝেই এতটাই সাফোকেটিং হয়ে উঠত ব্যাপারটা যে আমাকে সংশ্লিষ্ট প্রেমিককে বলতেই হতঃ ‘তুই কি এবার তোর ভাঙা প্রেমের কাঁদুনি গাইবি?’ প্রত্যুত্তর এসব ক্ষেত্রে সোজা আসে না, অন্ততঃ ওই বয়সে, তেড়িমেড়ি উত্তর আসতঃ ‘তাতে তোর বাপের কি বে?’ আমি চটজলদি বলে নিতামঃ না, তা’লে তোর জন্য খান কয়েক রুদালী ধরে আনতাম। আর হিসুও পেয়েছে জোর। বুঝলি না? সেই টিউশন সেরে এসে থেকে ঠায় বসে আছি।’ অতএব বিরহ যন্ত্রণার সবটুকুই আমার অজানা; শেষ বাক্যটা জানতাম – তার দিয়া ছিল, একসময়। তার দিয়া নেই, এখন। একটা ঠেকে আর কটা ছেলে থাকে, গোটা সোনারপুর-রাজপুর অঞ্চলে তার চেয়ে নির্ঘাত ঢের বেশী। একদিন আমায় দিয়ার সামনে নিজে থেকেই বাইক থামাতে হলোঃ ‘কি রে, তোকে নাকি কয়েকদিন আগে ময়লাপোঁতার মাঠে লোকজন সিক্সটিনাইন পজিশনে বামাল ধরেছে। সত্যি?’ দিয়া চুপ। আমি আমোদ পাইঃ ‘তারপর শুনলাম নাকি তোকে ঐ অবস্থাতেই, আই মীন, জামাকাপড় না দিয়েই রিক্সা করে বাড়ী পাঠিয়েছে? তা বাড়ী গেলি কি করে? তোদের গলির সবটাতে তো রিক্সা ঢোকে না। তাহলে বাড়ী ঢুকলি কি করে?’ দিয়া আমার দিকে তাকিয়ে, ছবি, ব্রাশের স্ট্রোক – সব ওই ক্রিসপি চানাচুরের নীচে তলিয়ে গেছে, ওর আইল্যাশ বড়ো বড়ো, যার জন্য বেশ দীঘল লাগে চোখ দুটোকে। দিয়া ওই আঁখিদ্বয়কেই অস্ত্র করে নিয়ে বললোঃ ‘এটা তুই সেদিন বুঝবি যেদিন তোকে আমি একটা ভালো ব্লো জব দেব। ফাঁকা মাঠে। আর এলাকার লোকজন এসে আমাদের পাকড়াবে।’ আমি বাইকে কিক মেরেছিলাম, তার আগে অভ্যাসবশে বাইকটাকে ডানদিকে হেলিয়েও ছিলাম, কারণ আমাদের আগে একটা বাজাজের স্কুটার ছিল, আর বাজাজের গাড়ীর ইউজার ম্যানুয়াল যারা পড়েছেন, তাঁরা তো জানেন যে বাজাজ যদি রকেটও বানায়, তাহলে সেটা ছাড়বার আগে লঞ্চপ্যাড থেকে একবার কি দেড়বার ডানদিকে হেলিয়ে নিতে হবে।

 

এরপরে বিশেষ সংবাদদাতারা অনেকের বুক ভেঙে দিয়ে আমাদের যে লেটেস্ট খবরটা দিয়েছিল, সেটা হলো, প্রদীপ্ত বলে পাশ্চাত্যপাড়ার একটা ঝকঝকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে বাগিয়ে ফেলেছে দিয়া। বিয়ে প্রায় হয়-হয়, তার আগে চাঁদিপুর না জুনপুট কোথাও থেকে প্রি-ওয়েডিং হানিমুন সেরে এসে প্রদীপ্ত প্রোমোশন এবং ট্রান্সফারের গল্প দিয়ে জাষ্ট মিলিয়ে গেলো থিন এয়ারে। ফ্ল্যাট ঠিক করতে গিয়েছিল নাকি, বিয়ের পর দিয়ার সঙ্গে সংসার পাতবে বলে। তারপর সুভাষ ঘরে ফেরে নাই। প্রদীপ্ত’র এক জিগরি দোস্ত থাকত আমাদের পাড়ার পিছনে। ওকে বাচ্চা-বুড়ো সবাই মিস্টার ফাইন বলে খেপাত। তা সে বোধহয় দিয়ার শেষ প্রেমকাহিনীতে পিওন-ফিওনের কাজ করে থাকবে। দিয়ার বাপ-মা সে ছেলেকেই চেপে ধরে দিয়ার সঙ্গে লিগ্যালি জুতে দিল। তা মিস্টার ফাইন সেলস্‌ম্যান, আর সবাই যে আমার মতো সব-জায়গায়-ধ্যাড়ানে হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। ফাইনের সঙ্গে বিয়ের পর দিয়ারা নর্থ বেঙ্গলে শিফট করে। দিয়ার বাবা আস্তে আস্তে আমাদের সামনে মিয়োতে মিয়োতে একটা সময় মরে গেলো, তখন আবার দিয়ার মা দিয়ার কাছে, দিয়ার প্রেগ্ন্যান্সিতে নাকি কমপ্লিকেশন ছিল, ফলতঃ আমাদের পাড়া থেকেই কিছু ছেলে দিয়ার বাপকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আসে। এবং খবর আসে যে, দিয়ার শ্বাশুড়ী আগে থেকেই ছেলের কাছে থাকে, আর দিয়ার মা সেখানে যাওয়ার পর হেব্বি ক্যাচাল লেগেছে, একদিকে দিয়া, দিয়ার বর, দিয়ার মা, অন্যদিকে দিয়ার শ্বাশুড়ী একা কুম্ভ। তবে বুঁদি গড় রক্ষার ভার তাঁর ওপর নয়, এই যা ভাগ্যি। কিছুদিন বাদে, একটা কাজে, আলিপুরে জেলা অফিসে গিয়েছি, দেখি ফাইনের মা। ভদ্রমহিলার মুখ চিনতাম। পারিবারিক নির্যাতন থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়ার অফিসারের ঘরের সামনে বসে আছেন। এই অফিসার আবার আমার সঙ্গে এক ইস্কুলে প্রাথমিক পড়েছে। বিয়ের পর প্রপার কলকাতায় থাকে। আমি আমার কাজ সেরে ভালোমুখে ভালোছেলে হয়ে বেরোতে যাব, এমন সময় আমার সহপাঠিনী অফিসার আমারই সামনেঃ ‘আরে অনিন্দ্য, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো হলো। আমার ঘরে আয় তো একবার।’ যেতে হল। ফাইনের মা। সহপাঠিনী অফিসার বললোঃ তোদের ওদিকে থাকেন। চিনিস? আমি একটু জড়ামড়ি করে বললামঃ ‘ঠিক মনে পড়ছে না। ঠিকানা কি?’ নিজের ঠিকানা বলতে গেলে ভদ্রমহিলার গলা শুনলাম। এত মর্বিড গলা আমি জীবনে খুব কম শুনেছি। বলতেই হলো যে আমি জায়গাটা চিনি। সহপাঠিনী অফিসার ভদ্রমহিলাকে পরের দিন আসতে বলে তাঁর বৃত্তান্ত বলতে শুরু করল। আমি প্রায় চেবানো খাবার আরেক দফা চিবোতে লাগলাম। কাহিনীর শেষ বাক্য ছিলোঃ ‘ভদ্রমহিলা কোনও আইডেনটিটি কার্ড ক্যারি করছেন না। এ অবস্থায় আমি যে কি করি! কিভাবে কোথায় যে ওঁকে একটা সেফ শেল্টার দিই! ওঁর ডটার ইন ল’কে চিনিস? তোদের পাড়ার মেয়ে তো।’ বলতেই হলোঃ ‘হ্যাঁ, মেয়েটা টক্সিক আছে।’ উত্তর এলোঃ টক্সিক মাই অ্যাস। মেয়েটা সাইকো-প্যাথ। বারান্দায় শুতে দিত। যেতে আসতে শ্বাশুড়ীকে লাথি মারত। উনি গত সাতদিন টানা না খেয়ে আছেন। ওঁর বৌমা ওঁকে শুকনো ভাতটুকু দেয় নি, অথচ নিজেরা চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় খেয়ে ওয়েট গেইন করেছে। ফর হেভেন সেক, লেট মী গেট দ্যাট স্লাট। আই উইল সেটল দ্য স্কোর।

 

ওমা, দেখি, সহপাঠিনী অফিসারের চোখে টলটলে জল। কার দুঃখ আর কে কাঁদছে। চা আর খুব সংক্ষেপে কথা সেরে উঠে পড়লাম। দিয়া একটা সময় আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল রীতিমত, আমার সঙ্গেও কম আড্ডা মেরেছে! তখন বুঝি নি, পেনসিল, মোম-পেনসিল, ব্রাশ, প্যালেট, মায় রবীন্দ্রনাথ... এসবের তলায় একটা কাটথ্রোট রেজ্যর ধরে রেখেছিল ও।

 

তারপর যা হয়, আমি তার ঠিকানা রাখি নি। বছর খানেক পরে শুনতে পেলাম, ফাইনের মৃত্যুর কথা। ন্যাচারাল কোর্সে সে মৃত্যু যে আসে নি, এটুকুই কানে এসেছিল। আর এসেছিল আরও একটা খবর – নর্থ বেঙ্গলের এক জবরদস্ত পলিটিক্যাল নেতার সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছে দিয়া। আমার শুধু একটা জায়গাতেই বিস্ময় জেগে উঠেছিল বহতা নদী স্রোতস্বলা না হলে এবং/অথবা পলি পড়ে তার নাব্যতা কমে এলে যেভাবে চর জেগে ওঠে, অনেকটা সেইরকম, গাড়ী, বাড়ী, লোডেড ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স – এসব তো ছিলই দিয়ার, তবে কি ও গোটা কাঞ্চনজঙ্ঘার মালিকানা না পাওয়ার আগে শান্ত হবে না? নাকি, ব্যাপারটা এইরকমঃ আ সিঙ্গল সেনটেন্স উইল সাফিস ফর মর্ডান উইম্যান: শী ফরনিকেটেড অ্যান্ড রেড দ্য পেপারস?

 

 

রাত্রি মধ্যযামের দিকে ছলকালে, আমি তো কারোর নামে মদ খেতাম না, মালের টানে শেষ-সন্ধ্যে থেকে প্রথম প্রহর পর্যন্ত মাল টেনে গিয়েছি, চিতার কাঠে ঢালা ঘিয়ের কণা কণা এসে মুখটাকে গর্জন তেল মাখা প্রতিমার মতো চকচকিয়ে দিত, যদিও খোমাখানি আমার মোটেও প্রতিমার মুখের মতো ঢলঢলে নয়; বেলাগাম ফিরতাম বাড়ীর দিকে। একবার হয়েছি কি, কিছুক্ষণ সাইকেল চালাবার পর ব্ল্যাক আউট, আমি লক্ষ্মণ বুঝেছিলাম, তবুও ভেবেছিলাম পেরে যাব। আসলে হতো কি, ওই বিধ্বস্ত অবস্থাতেও নিজের বিছানার স্পর্শ পেতে চাইতাম আমি ভীষণই। যে রাত্রির কথা লিখছি, কোথায় হুড়মুড়িয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই; বেশ খানিকক্ষণ পরে হুঁশ ফিরতে দেখি আমারই স্কুলে পড়া এক সহপাঠিনীর মুখ। তখন কলেজ ডিঙিয়ে গিয়েছি। অর্থাৎ, সেই সুন্দরী ইউরো-সেন্ট্রিক মেয়ের রূপ ততদিনে আরও খোলতাই হয়েছে, কালিদাস-ফালিদাসে যাকে পূর্ণ যৌবনা বলে গেছেন আর কি... এই কয়েক বছর অদেখার দূরত্ব সে মেয়ে ঘুচিয়ে দিয়েছিল এক জিজ্ঞাসায়ঃ ‘কিছু খাবি, অনিন্দ্য?’ আমি, কনুই আর হাঁটু তখন খবর দিচ্ছে যে সাইকেল থেকে হুমড়ি খেয়েছিলাম; কি আর বলব, পেটের মধ্যে তখন লিটার খানেক বাংলা আর রাশিকৃত কাবাব সাইজ হচ্ছেঃ ‘নাহ, তোদের টয়লেটটা কোথায় রে? তখনও ওয়াশরুম বা রেস্টরুম বলতে শিখি নি, আর লজ্জার মাথা খেয়ে লিখতেই হচ্ছে, সেই মেয়ে আমার হাত ধরে ওয়াশরুমের দরোজা অবধি নিয়ে গিয়েছিল।

 

ফিরে এসে যা হয়, কুশল জিজ্ঞাসার পর  এ কথা, সে কথা, পুরানো দিন... যা সোনার খাঁচায় রয়ে গেছে ও যাবে। আজ জানি না, বা মনে নেই, কেন বা কি করে আমার ছোটবেলাকার প্রসঙ্গ উঠে গিয়েছিল। একটা কিউ এইরকম, সেটা আজও মনে আছে, আর বোধহয় থেকেও যাবে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়া অবধি – সেদিন শ্মশানে এক বুড়ীকে পোড়াতে নিয়ে আসা হয়েছিল যাকে অবিকল আমার দিদি (দিদিমা) ’র মতো দেখতে। ফোকলা হয়ে গেলে, অর্থাৎ ডেনচারবিহীন মুখ শিথিল হলে অনেকটা একরকম দেখতে হয়। কোঁচকানো ত্বক মানুষের মুখকে বহুবিধ বিপর্যয়ের স্টিকার মেরে ছেড়ে দেয়, তাকে অবিভেদ্য মায়াময় করে তোলে। সুতরাং দিদির কথা টুকটাক ওঠা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু কিছুতেই আজ ব্যাখ্যা দিতে পারব না, কেন শৈশব থেকে শুরু করে আমার সেপিয়া বা ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট দুঃখগুলো একে একে উঠে আসছিল। ওয়েট কফের কাশি কাশতে থাকলে বুকে জমা সর্দি যেমন, অবিকল তেমনই। আমি অতীতচর, হতেই পারে এটা, কিন্তু ওইরকম বেহেড অবস্থায় আমার সেই সব অনুভবসমূহ, যার প্রকাশে আমার চোখ শুকনো থাকে ঠিকই, কিন্তু আমার অন্দরে শুধু অশ্রু নয়, বোধ করি, কিছুটা রক্তেরও ক্ষরণ হয়; আমি কেন ওগরাতে শুরু করেছিলাম।

 

তার আগে বাড়ীতে টেলিফোন করে দেওয়া গিয়েছিল যে আমি ফিরছি না; বন্ধুর মা-ই আদেশ করেছিলেন বলা যায়। তারপর থেকে এই দুখের রঙের পেখম মেলা শুরু। তখন কটা হবে... ধরুন, রাত একটা বা দেড়টা। সুতীর লাল নাইটি পরে, বসে, দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে সে মেয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছিল আমায়, মন-মাথায় টেনে নিচ্ছিল আমার দুঃখগুলো। আজ যদি শুধোন এতবার দুঃখ যে বলছি, বলতেটা কি চাইছি আমি; তাহলে, প্রত্যুত্তরে আমি ব্যাখ্যায় না গিয়ে প্রয়াত শ্রী জগজিৎ সিংয়ের উয়ো কাগজ কি কস্তি, উয়ো বারিষ কা পানি গানটা রেফার করে দেব। ওইরকম কাছাকাছি কিছু ওজনদার নগণ্য কিছু অনুভূতিই হবে; নচেৎ আর কি-ই বা পড়ে থাকে শৈশবের দিনগুলোতে।

কথা এটা নয়; দুঃখ এখানে নেই; আগেই বলেছি ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের ভিতর ঝরলেও যা যা বলার, আমি বলে গিয়েছি শুকনো গলায়। বিস্ময়টা হলো, আমার দুঃখগুলো শুনে যেতে যেতে তার চোখ থেকে... কি? রঙে রঙে ভালোবাসা? – না, তার চোখে ঝরো ঝরো ধারা, বেদনা বরিষা। আমি আজও মনে করি, একটা ছেলে এবং মেয়ের, ভারতবর্ষের কথা কথা লিখছি, আপব্রিংগিংয়ের জঁর বা মর্ফ আলাদা, তবুও আজও আমায় অবাক করে, আমার তুচ্ছ দুঃখগুলোকে সেই মেয়ে কি করে অতো রিলেট করতে পারল? স্কুলে থাকাকালীন সে আর্টস, আমি সায়েন্স; সুতরাং খুব যে নিবিড় কথা হতো, তাও না। তার ওপর তার শহরতলীতে আসা সেই বছর যে বছরে আমরা ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হই, অর্থাৎ ছোটবেলা থেকে পরিচয়ও ছিল না; সুদূর দিল্লী থেকে সোনারপুরে এসে সে কেমন করে এত গভীর সেঁধাল, যাতে করে, সোনারপুরে জন্মে বড়ো হওয়া এক ছেলের শৈশব, কৈশোরের দুঃখগাথায় সে কেঁদে দরবিগলিত হয়ে যেতে পারে! জানি না, সে রাতে লগ্ন কি ছিল, তিথি কি ছিল... কিন্তু কোথাও একটা ম্যাজিক রয়ে গিয়েছিল, সেটা অবশ্যই।

 

 

মানুষ দ্বিপদী হলো কেন? এমন যদি প্রশ্নপত্র আসে, তাহলে আমার ধারণা যায়, বেস্ট অ্যানসার হলো – যেটুকু মোট বইবার, মানে ক্রিটিক্যাল মিনিমাম যে ওয়েটটুকু ক্যারি না করলে লোকে খিস্তি করবে, সেটুকুসমেত নিজেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। একটা গোটা বেঁচে থাকার মহাভার, অস্বীকার করে লাভ নেই যে, সেখানে কিছু খুচরো সুখও আছে যেটা কিনা গোটা শরীরের, মনের, মগজের; কিন্তু সেই মহাভারকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের পা দুখানি। যতই পেশল বা পলকা হোক না কেন, এছাড়া আর কোনো চারা নেই। ওই যে বলে না, এভরি ম্যান মাস্ট ক্যারি হিজ ক্রস; যেটুকু জুড়ে আমার নিজের দুনিয়া, তার রণ, রক্ত, সফলতা, সত্য, এবং শেষ সত্য... সারে বোঝ হাম উঠায়েঙ্গে। সময় এখানে কম্পাস; আপনি-আমি মিয়্যার ফলোয়ার মাত্র। ব্যাপারটা বুঝতে বা মানতে অসুবিধে হলে ‘সময়’ শব্দটার জায়গায় ‘নিয়তি’ বসিয়ে নিন। কর্মফল জাতীয় কেতা মারা কেতাবী শব্দ না বসানোই শ্রেয়। সোজা ব্যাপার জটিল করে লাভ কি? যেমন জরুরী-জটিল প্রত্যাশা সাহিত্যিক শ্রী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় করে গেছেন, স্মৃতি থেকে লিখি, কোটেশন না দিয়েঃ বহু বাবুজী’, চুনারের টাঙ্গাওয়ালা লাল্লু আমায় বলেছিল, ‘সব কুছ দেতি হ্যায়। জান ভি দে সকতা। লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।’

নিজের পা জোড়ার দিকে যখনই আমি পলক ফেলি, তখনই আমি একবার করে নিজেকে মনে করিয়ে দিইঃ জীবনের অনেকটা পথ একলা চলে এসেছি। সত্যিই এই হাঁটায় চাওয়া-পাওয়া বিশেষ কাজের কথা না, সে হিসেব রাখা তো, সুতরাং, আরও না; এবং যেটা আরও মজার, সেটা আপনার হলো গিয়ে, চলার পথে দেখা দৃশ্যগুলো, যা বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক, মনে থেকে যায়। এই যে, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ আমি। এখানে। দিয়ে যাচ্ছি। তা স্মৃতি কাকে ধরবে আর কাকেই বা ছাড়বে, সে জেনে আমি কি করে ঠিক করব; বরং আমায় ধমকাতে পারেন, এগুলো লিখে আপনাদের সময় পোড়ালাম কেন।

 

 

গানটি বব মার্লির লেখা, সুরারোপিত এবং গাওয়া হলেও আমি এটা অনেক বেশী শুনেছি জোন বায়েজের কণ্ঠে। ফোক অ্যান্ড কান্ট্রির মিশেলে গানখানি জোন বায়েজের রেন্ডিশনে বেশ আলাদা মূল পরিবেশনার থেকে। বনি এম গানটিকে পপ আর ব্লুজ জঁরের মাঝারি কিছু একটা বানালেও আমার ততটা ভালো লাগে নি। 

 

 

 

 

  

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ    © 

 

 

ফটো কার্টসিঃ  গুগল ইমেজেস 

 

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে

 

 

 

 

 

No comments: