Wednesday, December 31, 2025

মা’র কথা

 

 

গোড়ার কথাঃ

 

বোধন যখন হয়, তখন — এবং যে করে, সে, অথবা যারা সেটা দেখে, তাদের প্রত্যেকের মগজের ব্যাকএন্ডে বিসর্জনের কথাটাও থাকে; ভাসানের বাজনার বিমূর্ত রেশ এসে মেশে আগমনীর আনন্দে। বলতে চাইছি — বোধন, এবং বোধনকালে বিসর্জনের যে ভাবনা, তার সঙ্গে একমাত্র ওতোপ্রোতো যে, সে হলো — আসছে বছর আবার হবে। এই আবারও হওয়াটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব কম সময়ের মধ্যে, এই তো, আসছে বছর মানে তো মামুলি একটা বছর পর... কিংবা দিন-পিয়াসী যে, তার তো শুধু সন্ধ্যেটুকু কাটানো এবং রাত্রিটুকুর পোহানোর মামলা।

আবার, এই আবারও হওয়াটা, যদি হওয়ার হয়, আদৌ, তাহলে, কখনো সেটা অনিশ্চিত — ওই শ্রী মান্না দে যেমন গেয়ে গেছেন — আবার হবে তো দেখা, এ দ্যাখাই শেষ দ্যাখা নয় গো, অর্থাৎ দেখা হবে সেটা নিশ্চিত, কিন্তু এক্স্যাটলি কবে হবে, সেটা জানা যাচ্ছে না। আর নির্দিষ্টতার রেল্মে — এই আবারও হওয়াটা, আসছে বছরে নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, আসছে জনমে। মাকে এই দফায় হারানোর পর, ছাইয়ের ওপর জেগে থাকবে যে, সে স্মৃতি এবং সে ক্ষয়িষ্ণু। বর্তমান তাকে বড় ঝামরায়; স্মৃতি, সময় এগোলে, গন্তব্য হিসেবেই বিস্মরণে লাট খেতে থাকে। বাবা’র বেলায় কতকটা তো এমনই হলো।

 

এখন যেমনঃ

 

রোজ রাতে যে জাগি, নিজের কাজই করি, যাতে পয়সা আসে, সুখ আসে; মা’র প্রতি তদ্গত-বিহ্বল কিছু তেমন নয়, তবুও মা’র ঘরে প্রথম ভোরের আগে গিয়ে, বলা যায় ব্রহ্মমূহুর্তের শুরুটা যখন, রক্তচাপ মাপি, ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য ও আর এস এল-এর টেট্রাপ্যাক খাওয়াই; ঘরের অনুজ্জ্বল আলোতেই আর বোধহয় বুঝি, ঊনপঞ্চাশ দিকের সবটুকু ঝাপসা থাকলেও একটা কথা কটকটে গ্রীষ্মের অপলক দাহের মতো স্পষ্ট যে, মা’র আয়ু কমে আসছে। শীত বিকেলে আমি এভাবেই সন্ধ্যা নামতে দেখেছি; - এই আলো ছিল পর্যাপ্ত, যখন কিনা আমি উত্তরে তাকিয়ে, আর সহসাই একপ্রকার, দক্ষিণে ফিরে দেখি, আঁধার নেমে গেছে পরিপূর্ণ।

মা’র বড় ইচ্ছে ছিল, কয়েকটা গান, যা কিনা দোখনো, বিরল, রেকর্ড করে যাবে, আর কিছু অন্যরকমের গান — যার সবকটাই মা’র বড় প্রিয়; ছোট থেকে শুনে শুনে আমারও; আচমকা শুনতে পেয়ে এবং শোনার কান থাকায়, জয়িতারও। এই রেকর্ড করার ইচ্ছেটা আমাদেরও কম কিছু ছিল না নেহাত; কিন্তু মনে হচ্ছে, আর হয়ে উঠল না। কেন যে একটা দামী মোবাইলে চব্বিশ এফ পি এস তে রেকর্ড করার কথা ভেবে রেখেছিলাম — নিজেকে থাবড়াতে ইচ্ছে করে, ফসলের দানা খুঁটে খাওয়া মুক্তির বুড়ো পাখি স্বর্ণপিঞ্জরের দাঁড়ে বসে দামী, স্বাদু, পুষ্টিকর বার্ডসীড খাওয়ার কথা ভেবেছিল! সিনেমা তো আর বানাতাম না, স্ক্রিপ্ট-ই তো হাতে নেই যে মিট জো ব্ল্যাক বিলকে নিয়ে চলে গেলো ঠিকই, কিন্তু জীবন বুঝতে পেরে, মানুষ (নশ্বর?) বুঝতে পেরে, যার শরীরটা সে নিয়েছিল খাঁচা-ধাঁচা হিসেবে, সেই তার আত্মাটাকে তার নিজের খোলসে ফের পুরে দিয়ে গেলো। প্রথমজনের আত্মাটা কী করে জো ব্ল্যাকের কাছে অত দিন বন্দী থাকে? উত্তর হলো, ওটা সিনেমার বাস্তবতা। তা সিনেমা যখন বানাতে পারব-ই না, তাহলে কী ক’রে খালি হাতে এই হার্ডক্যোর রিয়েলিটিকে পাল্টে অল্টার রিয়েলিটি দিতে চেয়েছিলাম! নাকি তাও চাই নি। জাষ্ট টাইম কীল করছিলাম! এই আহাম্মকীপনার জন্যই থাবড়াখানি লাগে।

 

তবে মা যে এখনও বাঁচছে, বেঁচে চলেছে — পাওনা এটাই। বলতে গেলে পরম পাওনা, যা পড়ে পেয়েছি। নিয়মের ওষুধ — নাহ্‌, খাওয়াতে পারি নি, পকেট, সেই যে সেই জায়গাটা, যেখানে ওয়ালেট থাকে, ডাক্তারকে ওভাররাইড করে সে-ই ভ্যালিডেট করে নি প্রয়োজনীয় বলে, অ্যাপ্রুভালও, সুতরাং, মেলে নি। অতএব, যতটা মা বাঁচতে পারত, ডাক্তারদের ভাষায়, ঠিক যতটা লড়াই দিতে পারত, বেশ কিছুটা তার থেকে কমে গেল। তবুও — কোথাও কোনও উল্লেখযোগ্যতা নেই, এবং না থাকা সত্ত্বেও প্রায় সাড়ে নয় বছর, যদি আজ ধরে চলি।

 

মা'র আসন্ন অনুপস্থিতি — ব্যাপারটা ভাবলেই, মাল্টিপল মাইলোমাতে মারা গেছেন, এমন মানুষদের কথা ভাবি আমি, এবং সব কিছুর সাপেক্ষে মা’র জন্য ধার্য ব্যবস্থাটাকেই ইউটোপিয়ান লাগে আমার — অনিবার্য ডিসটোপিয়ান পুত্রের। কত মানুষ কত উন্নত মানের, কত দামী ওষুধ পেলো, ধারাবাহিক পেলো, তবুও নিজের পায়ের ছাপ ফেলতে পারল না আর বেশী দিন। আর বলতে ডায়াগ্‌নোজড হওয়ার পর! আবার তার থেকে আরও কতগুণ বেশী মানুষ মাল্টিপল মাইলোমা’র কী, কেন, কবে, কোথায় জানতে না পেরে, রোগে ধরার কয়েক মাসের মধ্যেই ফুটে গেলো! স্বজনে ভেবে নিলে পক্ষাঘাত হয়েছিল এবং তাতে তারা শান্তিও পেলে। কিন্তু মা’র জন্য দেখি সব কিছু ধূ ধূ করছে;- যে কটা ওর‍্যাল কেমো অ্যাফোর্ডেবল ছিল, তাদের একটাকেও মা সহ্য করতে পারল না, সবচেয়ে চলে যে ওষুধটা, সেই বর্টিজমভিব মা ২ এর জায়গায় ১ নিতে পেরেছে পনেরোটা, ক্যান্ডোস্ক্যান দিনে একটা ক’রে ৩ দিন। তবু মা কিছু মামুলি অ্যান্টি-ক্যানসার টার্গেটেড ড্রাগের ওপর ভর করেই এই সাড়ে নয় বছর পৃথিবীর ওপর দিয়ে চলে বেড়াতে পারল! তাও কিডনি বাগড়া না দিলে লেনালিডোমাইড চালানো যেত আরো কিছুদিন, মা ঝলমলে থাকত। এনিওয়ে, আর স্টেরয়েড, কথায় বলে না, যে পেশেন্টের কেউ নেই, তার স্টেরয়েড আছে। প্রতিটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাকে মা জিতে নিলো স্টেরয়েডের শর সংযোজন করে করে। কিন্তু — কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আঠেরো দিন, আর মা’র কাটিয়ে ফেলা সাড়ে ন’ বছর, জানি না, হাতে আর কতটা সময় ফাউ হিসেবে আছে। কারো ইচ্ছামৃত্যু, কারো ক্রিটিক্যাল থিংকিং, এমনকি, দুর্বাসার অফার করা পায়েসটা পায়ে মাখতে পারলে আরও কিছু দিন হয়তঃ বাড়তে পারত আয়ু। কিন্তু সম্ভবামি হয়েছেন যেকালে, বিদায়গামী হতে তাঁকে হতে হতো-ই। সে যাক, কিন্তু তারপর? দুর্বাসার অফার করা পরমান্নকে এখানে দারাটুমুমাব, বেলানটামাব বলা যেতেই পারে, যা মা পেলো না, টাকার জন্যই পেলো না। কিন্তু পেলেও, শেষ তো হতো-ই, শেষকে আসতেই হতো, শেষকে আসতেই হয়; আর সেখানে কোনও শোক, কোনও ফুঁপিয়ে ওঠা — এসব বিলকুল নিপাত্তা। এক নীরবতা, বোধহয় একে শাদা বলে ডাকে, দিয়ে মাকে আমি আর জয়িতা ভাসান দিতে যাবো। মনে থাকবে আর সেগুলো মনে থাকায় আমরা, কাঁধে যখন মা, শেষযাত্রায়, কুঁকড়ে যেতে থাকব যে, শেষের দিকে এসে, আমার মা কেমন সুন্দর প্যারাসাইট হয়ে গেলো, কী মসৃণভাবে সব চিন্তা করা ছেড়ে দিতে পেরে দিতে পারল নিশ্চিন্তির ঘুম। যে মা আমার তীক্ষ্ণ হিসেবে সংসারকে দেখেছে, মানুষকে বুঝেছে; সেই মাঃ ওসব বাবি-জয়ী ভাববে খন, বলে কেমন আরামে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো! আমাদের কুঁকড়ে দেবে মা’র অবোধ জিজ্ঞাসাগুলোঃ এই ওষুধটা কদিন কয়েক খেলে ঠিক হয়ে যাবো, বল্‌? কিংবা, ওটা আদ্ধেক খাব? আচ্ছা। অথবা, এটাও খেতে হবে? ঠিক আছে, খাচ্ছি...

 

মা যে জীবনটা কাটিয়ে এলো, যার পুঙ্খানুপুঙ্খ আমার শোনা, একাধিকবার — ভাবি আমি। ইস্কুল থেকে একটা গোটা পাকস্থলী-ভর্তি খিদে নিয়ে বাড়ী ফিরে মা একবার নয়, দুবার নয়, বহুবার শুনেছে দিদির (দিদিমা) মুখে যে — বাড়ীতে একটা দানা চালও নেই। মানে, অত্যধিক বেড়ে গেছে আর কি! রাঁধবার সবজি নেই। তবে খানিক মশলা পড়ে আছে। স্কুলের ইউনিফর্ম ছেড়ে, ঘর‍টা ঝাঁট দিয়ে, অর্থাৎ রুটিনের কাজ কমপ্লীট ক’রে, মা, পাশের বাড়ীর আমড়া গাছ থেকে তড়পা খানেক আমড়া আর নুন নিয়ে বসত, খিদের সঙ্গে আমড়াগাছি করবে বলে। বহুবার হয়েছে এমন যে, টাকরার নুন ছাল উঠে গেছে। ছোটমামুর মুখের কষ চিরে গেছে।

 

ইদানীং মাকে টেট্রাপ্যাক খাওয়াতে খাওয়াতে আমি পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিই। কেটে যাওয়া দুধের ওপরের জলের মতো ফ্যাকাশে হাসি হেসে ফ্যালাসি চাপার চেষ্টা করি, মা’র জীবনে নাকি একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো বলে। খালি পেটে ভাতের জায়গা না হওয়া থেকে চয়ন ক’রে ক’রে বানানো টেট্রাপ্যাক। কার ঘরে যে চুরি করতে চাই, নিজেই বুঝি না। তবুও বুঝি, মা চলে গেলে 'পর, মাতৃ-স্মৃতি নয়, এই সব পাংশুটে ভাতের জায়গায় সুঠাম আমড়ার কথাই আমাকে বেশী কাঁদাবে।

 

মনে আছে, যখন বাড়ী থেকে সিনেমা দেখার ঢালাও অনুমতি মিলেছিল, একটা ধ্যাড়ধ্যাড়ে পুরোনো বাংলা ছবি দেখেছিলাম — অসমাপ্ত। টিভিতেই। অসিতবরণের মা মারা গেছেন, অসিতবরণ তাঁকে দাহের উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছেন শ্মশানে। দাহ চলছে। ম্যানুয়াল চুল্লী। ঘি, ঘি’র অভাবে ডালডা (আমি নিজের জীবনে অনেককে সাদা কেরোসিনও ঢালতে দেখেছি, নীল কেরোসিন বাজারে এলে, নীল কেরোসিনও। দগ্ধ শবের ওপর) ঢালায় আগুন ঝকঝকিয়ে ওঠে, তার আঁচে অসিতবরণের সাইড ফেস ভিজিবল হয় পূর্ণ, আর ব্যাক-গ্রাউন্ড থেকে গান ভেসে আসেঃ কান্দো কেনে মন রে, আন্‌ধার-আলোর এই যে খেলা, এই তো জীবন রে... অসিতবরণের এক্সপ্রেশন আমার মনে নেই, থাকার কোথাও নয়, ওখানে তো আমি নিজের মুখ বসাবো — ভাবলেশহীন, নির্বিকার একটা মুখ, যে ভেসে আসা যে কোনও রসিকতায় হেসে উঠতে পারে আন্তরিক। কারণ সে বোঝেই নি তার কী হারিয়েছে, সে বোঝে পরে, যখন শূন্যতার সামনে সে এসে দাঁড়ায় — দাঁড়িয়ে থাকে ভূতগ্রস্ত। আর সেই হলো তার হারানোর উপলব্ধির শুরু।

 

মা এখন অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। কবে যে গেলো, জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব না, কিন্তু ২০১৮ বা ’১৯ — যখন শুধু ক্যানসার যে তিন বছর ধরে বসে আছে তা নয়, ২০১৬ সালে ডিটেকশনের সময়েই মা’র চোদ্দ দিনের টানা কোমা, তারপর বাড়ীতে ফিরলে, কিছুতেই বাড়তে না চাওয়া বেহেড সোডিয়াম, অর্থাৎ, অ্যাকিউট অ্যান্ড প্রলংড হাইপো ন্যাট্রেমিয়া — এসব সামলেও তখনও মা অনেক ঝরঝরে, খুবই টরটরে। সে’ সময়ের ছবি দেখলেই বোঝা যায় যে, দেন অ্যান্ড নাউ কেমন করে ও কতটা আলাদা! আসলে ২০২১ তে ক্যানসারটা রিল্যাপ্স করার পর সেই যে কাপ্পা-ল্যাম্বডার মধ্যে ল্যাম্বডার রেশিও হু হু ক’রে বাড়তে শুরু করল, তাকে আর থামানো গেলো না; ফেরান গেলো না আর ল্যাম্বডার নীল থেকে। মা’কে। মা ল্যাম্বডা লাইট চেইন মাইলোমায় বিছানায় মিশে যেতে থাকল।

 

মা আছে, এখনও, এবং হয়তঃ শিগগিরিই, মা আর থাকবে না — এখান থেকে আমার মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা পাক খায়ঃ কিছু মানুষ কি এভাবেই সবকিছু পেয়ে যেতে থাকবে, আর অন্যদল কি এভাবেই কিছুই পাবে না! যে কটা দিন মা’র জীবনে বাবা ছিল, সেইটুকুই মা’র সুখের দিন, বাদবাকী প্রথম আর শেষ জীবন — সে দুটো সেই সুখের পুরের ওপর স্যান্ডউইচের পেল্লাই আকারের দুটো পাঁউরুটি যথা পড়ে আছে — ক্ষীণ হতে হতে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে মা’র সুখের দিনগুলো। কিংবা এমনও হতে পারে, স্বর্ণপিঞ্জরেই আটকা পড়ে আছে।

 

একটা উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক মানুষদের জীবন কি আন্‌ধার দিয়ে পাঙ্কচুয়েটেড হওয়ার জন্য নিয়তিবদ্ধ? অসিতবরণের মুখে এসে পড়া চিতার আগুনের আঁচ — হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা লক্ষ্যণীয়; কিন্তু আঁধার যে থাকবেই, আঁধার ছাড়া ভারতবর্ষের মতো দরবেশ দেশের পোশাকের হরেক রকম রঙয়ের নীচে ঘাপটি মেরে থাকা মানুষের জীবনের অর্থই যে অসমাপ্ত — এটাই আমাকে বড় অক্ষম করে তোলে। শ্মশানে তো এখন কত না আলো, সোডিয়াম ভেপার, নিওন... ইলেক্ট্রিক ক্রিমেটোরিয়ামের মেঝেতে ডুংরি মার্বেলও আমি দেখেছি, তাছাড়া এমনি কোটা মার্বেল বা টাইলস তো এখন সর্বত্র। তাহলে, আর তো অসিতবরণের চিয়ারসক্যুরো-আদলের প্রয়োজন নেই, সেটা রিডান্ডান্ট, কেননা অবসোলিট, অন্ততঃ এই শহরে, শহরতলীতে। ঘি, ডালডা, কেরোসিনের মামলাও আর নেই, পাঁচতলা মল জুড়ে এখন শুধুই সাড়ে আটশো-ন’শো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে মিনিট পঁয়তাল্লিশ থেকে এক ঘন্টা — লোহার ট্রেতে এসে যাবে সাধের এই দেহটা — যা পুড়ে কয়েকমুঠো শাদা-কালো ছাই, হাতির দাঁতের পালঙ্ক ইত্যাদি সবই তো পিছেই পড়ে রয়ে গেছে। মানুষের লাস্ট রাইটস যদি এত ইক্যুয়ালি আইডেন্টিক্যাল হয়, বেঁচে থাকাতে কেন মিনিমাম স্বাচ্ছন্দ্য পাবে না সব মানুষ? আমি ইক্যুয়ালিটি-ইক্যুয়িটি — এসব প্যাঁচালের চক্করে না হয় গেলামই না। মাল্টিপল মাইলোমার ক্ষেত্রে, ভারতীয় রোগীদের শরীরে দারাটুমুমাব কীভাবে অ্যাডমিনিস্টারড হয়, সেটার এখন রেইকি চলছে, সব সরকারী হাসপাতালে এখন পরীক্ষামূলকভাবে বিনা পয়সায় দেওয়া হচ্ছে এই নতুন টার্গেটেড ড্রাগ, সপ্তাহে একবার করে পাচ্ছেন পেশেন্টরা, কিন্তু আমি আগ্রহী থাকলেও মাকে এই অবস্থায় নিয়ে যাবো কী করে, সেখানে, যেখানে একটা বসবার সুযোগ বড় একটা নেই, আর মা আমার কেবলই শুয়ে পড়তে চায় একটা পরিচ্ছন্ন শয্যায়! বেলানটামাব মাকে দিয়ে দেখার বড় সাধ ছিল আমার, হয়তঃ তাতে, এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা ল্যাম্বডার দাদাগিরির সঙ্গে যোঝা যেত, কিন্তু বিদেশে নিয়ে গিয়ে মা’র চিকিৎসা করাতে পারব — এমন সক্ষম সন্তানের জন্ম আমার মা দিতে পারে নি। আর পারে নি-ই যখন একান্ত, তখন, ওষুধ বেরিয়েছে — এটুকুই শুনে যেতে হবে তাকে; এর বেশী বরাদ্দ মা’র জন্য বোধহয় নেই। তবে মা একটা জিনিস জেনে খুব খুশী হয়েছে — ক্যানসার ডিটেক্টেড হওয়ার পর মা এনাফ বেঁচেছে, এই রোগ ধরা পড়ার পর অ্যাভারেজ আয়ু পড়ে থাকে পাঁচ বছর; আর তাই আমি, স্বেচ্ছায়, নতুন ওষুধের পরীক্ষামূলক ব্যবহারে মাকে এগিয়ে দিতে সজ্ঞানে প্রস্তুত, নিজেকে দিয়ে না হয় মা, পরবর্তী রোগীদের জন্য আশ্বাস নিশ্চিত করে যাক, ব্যাপারটাকে আমি এভাবে ভাবি।

 

মা’র কথা শুরু যখন করেছি, মা’র আয়ুর মতোই অনেকটা, তাকে শেষের দিশাও দেখাতে হয়। তা এভাবে শেষ করি — মা’র আঁশ-নিরামিষ নিয়ে পিটপিটিনি একটা আছে ঠিকই, কিন্তু বাথরুম, ওয়াশরুম, রেস্টরুম, পাউডার-রুম বা ল্যাভরেটরি নিয়ে যেটা আছে, যেটার ভোগান্তি আমাদের, বিশেষ ক’রে আমাকে নেহাত কম ভুগতে হয় নি, তাকে একরকমের ম্যানিয়া বলা যায়। ভাগ্যের পরিহাসটা দেখুন একবার, ২০১৬ সালের পর থেকে মাকে যতবার বিছানায় পটি করতে হয়েছে, খুব কম লোককে তেমন করতে হয়, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অসুস্থতা মা’র মুভমেন্ট করার ক্ষমতাকে এতটাই কোয়ারেন্টাইন ক’রে দিয়েছে। ইদানীং যেটা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে অত্যধিক লো ব্লাড প্রেশার। এই প্রখর শীতে, একটা সুস্থ মানুষের রক্তচাপ একটু বেড়ে থাকার কথা, বিশেষ ক’রে, ভোরের দিকে, আর ঠিক তখন আমি আজ ভোরে যে মেজারমেন্ট পেয়েছি, সেটা আপনাদের জানাই — ৮৭ বাই ৪৮। পরে পরেই আর একবার মাপলে, ৯৪ বাই ৫১। হার্টরেট ১০৯ এর আশেপাশে, অর্থাৎ শরীরের নিজস্ব সিস্টেম কিছুকে অ্যাডজাষ্ট ক’রে নিতে চাইছে। হার্ট মা’র বরাবরই ভালো, বাবাকে ছাড়া আর কাউকে হৃদয় দেয় নি বলেই বোধহয়, কিন্তু ওই বিপি লেভেলটাই সেই ২০১৬ সালের পর থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ল। আমি যা জানতাম, ২০১৬ আফটারওয়ার্ড, মা’র নর্ম্যাল রক্তের চাপ — ১১৫ বাই ৬৮ বা, তার ধারে-কাছের কিছু। ইদানীং কি সেটা আরো নামিয়ে দিলো হাড়ের মজ্জার ক্যানসার? অথচ মাকে আমি প্রায়শঃ জিজ্ঞাসা ক’রে নিই, মা’র কোনও অসুবিধে, যেমন, মাথা ঘোরা, প্রবল শীত ইত্যাদি কিছু হচ্ছে কি না। মা সংক্ষেপে বলে, না। কিন্তু গতকাল রাতে মা বাথরুমে গিয়েছিল, ছোট বাথরুম। জয়িতা নিয়ে গিয়েছিল। বাথরুম থেকে ফিরিয়ে এনে মাকে খাটে শুইয়ে দিতে (কেমন একটা শয়ান দেওয়ার মতো হয়ে গেলো, না? তা গেলো তো গেলো) গিয়ে দেখে, বিছানায় মলিশীটটা প্রপার পজিশনে নেই। মাকে খাটের বাজু ধরে থাকতে ব’লে, জয়িতা মলিশীটটা ঠিক ক’রে দিচ্ছে — মা’র মনে হলো, পায়ের দিকে এত ঠান্ডা লাগছে কেন! আহা তা তো লাগবেই, বাথরুম থেকে ফিরে তো পা মোছা হয় নি, যেটা মা খাটে বসে মোছে; তো মা কী আর করে, বেকার বেকার তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না; যায় না বলেই, বেলার দিকে শরীরটা ঠিক বললে কিচেনের সিঙ্কে গিয়ে যত এঁটো কাপ ডিশ, ছোট ইউটেনসিল আছে, যেগুলো দিয়ে মেইনলি খাবার ঢাকা দেওয়া হয়, সেগুলোকে লিক্যুইড ভীম দিয়ে ধুয়ে দিতে হয়, ছেলের ফাঁকা জলের বোতল, যেগুলো শেষ ক’রে, ছেলেই সিঙ্ক লেভেলের তাকে রেখে গেছে, সেগুলোকে ভরে দিতে হয়; এক্ষেত্রেও মা খাট ছেড়ে দিয়ে হাতে ধরে রাখা নরম টাওয়েল দিয়ে পা দুটোকে মুছতে গেলো... রোগা রোগা, লালচে দাগে ভরে যাওয়া পা জোড়া... দেখতে দেখতেই, সেখানে টাওয়েল ধরে থাকা হাত নিয়ে পৌঁছোনোর আগেই মা, ব্যালেন্সটা হারিয়ে ফেলল, ও ফলতঃ, পড়ে যেতে গেলো। পড়ে যাওয়ার আগেও রিফ্লেক্স কাজ করে, আর খাট ছাড়াও ব্যালেন্স ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অজস্র জিনিস সেখানে, মা সবকটা’র কোনো একটাকে ধরতে চাইল, এবং একটাকেও পারল না, কিন্তু এতে ক’রে খান কয়েক লহমা পেলো জয়িতা, সে ছুটে এসে তার মানিকে ধরার আগেই মা ধপ ক’রে বসে পড়ার বদলে এটাকে ধরে-ছেড়ে, সেটাকে ধরে-ছেড়ে আস্তে ক’রেই মেঝেতে পড়ল। আমি জয়িতার গলার আওয়াজ পেয়ে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে গেলাম, গিয়ে আমার আর কী করার থাকে, পিছন থেকে মা’র বগলের নীচ দিয়ে দু হাত ঢুকিয়ে আবার খাড়া ক’রে দেওয়া ছাড়া — মা’র মুখটা সামান্য কুঁচকে গেছে, আমি জানতে চাইলাম, কোথায় লেগেছে। উত্তর পেলাম, বিশেষ একটা লাগে নি। জয়িতা আমায় ধমকাল, কেন আমি মা’র জন্য ওয়াকার কিনে দিতে দেরী করছি। অধোবদন আমি, কালই কিনে আনব গোছের একটা উত্তর দিতে দিতে মাকে খাটে বসিয়ে দিলাম। মা বসেই বলল, না... কেন আবার...

জয়িতার ধমক দেওয়ার পিছনে তার অক্ষমতা আমার পড়ে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হয়ও নি, মা আর কোনও দিন সুস্থ হবে না, এই অক্ষমতা নিয়ে রোজ বাঁচি আমিও — মা’র এই না আর কেন আমার মগজের মধ্যের বারুদে যেন আগুন ছুঁড়ে দিলো, দুটো ছোট টুকরোর আগুন। মাকে খুব শান্ত গলায় বললামঃ শোনো মা, তুমি জানো, তুমি আর ভালো হবে না। এই অবস্থা থেকে আরও খারাপ হবে তোমার অবস্থা। খুব শোচনীয় মৃত্যু-ই হবে তোমার — এসব তুমি জানো। আর জানোই যখন, একটু কো-অপারেট ক’রে যাওয়া বোধহয় তোমার কর্তব্যে মধ্যেই পড়ে। যতটা পারো, নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করো। কেউ তোমার হয়ে সব ভালো থাকাটা এনশিওর ক’রে দেবে না, যদি তুমি নিজে চেষ্টা না করো। তোমার জন্য অকারণ ভোর পাঁচটা অবধি জাগি, তোমার একবারও মনে হয় না? তোমার জন্য গত দশ বছর কোথাও ঘুরতে যেতে পারি না আমরা, তুমি জানো না? জানি, এরপরে কী বলবে, তারামাকে মনে মনে বলবে, মা, মৃত্যু দাও। কিন্তু জেনে রেখো, মৃত্যু ঠিক অমনটাও নয় যে, চাইলেই পাবে। তাই, কোনও কিছুই যখন তোমার ইচ্ছে মতো হবে না, তখন কো-অপারেট করো। তুমি কো-অপারেট করলে, আমাদের বেঁচে থাকাটা ইজি হবে। তোমার স্পর্ধা কী ক’রে হয় যে, তুমি ওয়াকার কিনতে ডিনাই করো! একটা কথা খুব পরিষ্কার ক’রে বুঝে নাও তুমি আর কখনও, কোনও ভাবেই আগেকার সুস্থতা ফিরে পাবে না। সুতরাং কো-অপারেট করো, যাতে নিজে ভালো থাকো, আর আমরাও ভালো থাকি।

মা চুপ ক’রে শুনল। মাথা নাড়ল, যেন সবটাই বুঝেছে। তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, কম্বলটা টেনে দিবি না আমার ওপর? আমি দিই। মা বালাপোশ, এবং তার ওপরে চাপানো ডবল লেয়ার্ড মিঙ্ক ব্ল্যাঙ্কেটের নীচে শুয়ে পড়তে পেরে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এখন কি শ্রী নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়ের ইউটিউবের পডকাস্ট দেখা তার পক্ষে ঠিক হবে? মা এখন সবই করার আগে একবার করে জেনে নেয়, অনুমতি চায়, এইটা শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগেও করলে মন্দ হয় না। আমি বলি, পডকাস্ট পুরো দেখতে বেশী সময় যাবে, তার চাইতে বরং মা গ্রামের রান্না করা দেখুক। মা তাই করে। বাইরের ভিতর বারান্দায় আমি আর জয়িতা চুপচাপ ডিনার করতে থাকি। একটা সময় হাতের সব কাজ সারা হয়, আমি মার ঘরে যাই মা ঘুমিয়ে পড়েছে, ইউটিউবের গ্রামীণ বৃদ্ধা মহিলা ফুড-ভ্লগারকে বললেন ... আর পালং-কাতলে যে মেথি দিয়েছি সেটা তো বললে না, বাবা। আমি মোবাইল অফ করে দিয়ে মা’র গলা অবধি কম্বল টেনে দিই, সামান্য কাত হয়ে শুয়ে থাকা মা’র মাথার পিছন অবধি বালাপোশটাকে টেনে দিই। কম আলোর একটা সাদা বাল্ব জ্বেলে রেখে, মা’র ঘর থেকে বেরিয়ে, দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে আসি। মাথায় ঘুরতে থাকে, সোডিয়াম ১৪০, সি রিয়্যাক্টিভ প্রোটিন ০.৫, সুগার ইন-কন্ট্রোল, তাহলে মা এখনও মিইয়ে আছে কেন, এটা কি অ্যাকিউট রেনাল ফেলিওরের ইন্ডিকেটর... তাহলে কী মৃত্যুই এসে মাকে চাঙ্গা ক’রে তুলবে — এবং যেটা আমাদের দেখা হবে না?

 

নোট একঃ আমরা ঠিক করেছি, টেট্রাপ্যাক আর খাওয়াবো না মাকে। তার চেয়ে পাউডারগুলো ভালো।

নোট দুইঃ মা’র জন্য ওয়াকার খুব শিগিগিরিই আসছে।

নোট তিনঃ মা বেঁচে থাকতে মাকে নিয়ে আর লিখব না। কোন্‌টা লেখার আর কোন্‌টা না লেখার — দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম বারবার। এর চেয়ে ইম্মিডিয়েট এফেক্টে অবিচুয়ারি লেখা বোধহয় সহজ কাজ।

 

 

 

 

 

 

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ     ©

 

ফটো কার্টসিঃ  

বাড়ীর কেউ, দ্বিতীয় ছবিটা ডাক্তারকে পাঠানোর জন্য, ইনফর্ম্যাল

ঋণ/রেফারেন্সঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে

 

 

 

No comments: