Sunday, September 21, 2025

যে সাজে তোমায় ভালো লাগে

 

 

বড়ো দেরী হয়ে গেছে

অনেক সময় বয়ে গেছে

যে সাজে তোমায় ভালো লাগে

সেই...

 

পজ মেরে গেলাম। মারাত্মক, বীভৎস, খুনখারাপি রকমের সুন্দরী মেয়েকেও তো আমার চাঁপা রঙের শাড়ীতে প্রেয়সী বলুন বা বন্ধু, কোনও হিসেবে দেখতে মোটেও ভালো লাগে না। তাহলে কিসে ভালো লাগে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখলাম তলিয়ে যাচ্ছি। চোখে লাগার মতন অকওয়ার্ড কিছু না পরলে তো, সে আপনি কাটের দিক থেকে ধরুন কিংবা রঙ; কি ছেলে, কি মেয়ে, কারোরই পোশাকের দিকে তাকাই নি কোনও দিন। মানুষ দেখতে চেয়েছি আমি। মিথ্যে কথা লিখব না, দেখেছিও। কিন্তু পোশাক... সে তো জানি, আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা - এর প্রজন্ম-প্রবাহে পাল্টে যাওয়া শ্লোগান - আপ রুচি খানা অউর আপ রুচি হি পরনা। আমাদের প্রজন্মতেই পাল্টে গিয়েছিল, যার ফায়দা... হ্যাঁ, অনৈতিকভাবে তোলা এদিক-সেদিকে হয়ে থাকে বৈকি, এবং সেটা আজও; তখন জেন জেড-এর কোথায় কি!

 

জেন জেড থাক, ওরা থাক ওধারে মাফিক নিজেদের কথা বলি, এখনও তো নিজস্ব গমনাগমন হয়। একটা বিদেশী ব্যাঙ্কের অফিসই ধরুন, যে সে অফিস নয়, মালিকানা ভাগাভাগির অফিস; তা সেরকমই একটা ঝাঁ চকচকে অফিসে গিয়ে পড়েছি। ঝিন-চ্যাক হবে আন্দাজ করেছিলাম, কিন্তু তা বলে এমনতরটা, সত্যি কথাই লিখছি, ভাবি নি। তিন গজ অন্তর অন্তর সিকিওরিটি, সই করতে হচ্ছে লগবুকে, এসি চলছে ভীষণ চড়া দাগে (এটার আন্দাজ আগে থেকে ছিল, অভিজ্ঞতাও দেখি একই কথা বলে যে, যত উপরে উঠবে তুমি, বাতাস বলো অথবা সম্পর্ক, তত ঠান্ডা হতে থাকবে, এটাই যেন দস্তুর গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার) কাউচ, লাউঞ্জের অনন্য পেলবতার মধ্যেও কেউ কারোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না, দিক হদিশ করতে না পেরে সঙ্গে জয়িতা, তারও অবস্থা তথৈবচ, যে যার মোবাইলে মশগুল। কিন্তু কেউই কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে না, যে যার মতো করে মোবাইল সার্ফ করছে। যথাকালে আমাদের ডাক এলো; উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু শেয়ার ছিল, তারই নামের কিছু পরিবর্তন আর কি...

 

ফ্রন্ট অফিসের ভদ্রমহিলা যথাবিহিত অন্যরকম সাজে সুন্দর, তাঁর ট্রাউজারের কালোর মসৃণে, লাইট লাইম গ্রীন শার্টের গ্লসিতে আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে; কাছে যেতে পেলাম হালকা সুগন্ধ এবং দেখতেও পেলাম কই, সাজি নি তো-এর আড়ালে নিয়ন্ত্রিত প্রসাধন। কথাবার্তা এগোতে থাকল। একটা সময় মায়ের ক্যানসার জেনে তিনি হঠাৎ রোগের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে লাগলেন। এটার জন্য প্রস্তুত যেমন একেবারেই ছিলাম না, তেমনই এটা এখন বোধহয় আমারও মজ্জায় মিশে গেছে যে আমার মতো নন-টেকনিক্যাল মানুষকে মজ্জার ক্যানসার সম্পর্কে কি কি বলতে হয়। একটা সময় তিনি তাঁর ঝোলা খুললেন। তাঁর বাবার ক্যানসার ধরা পড়েছিল দু হাজার দশ সালে। রক্তের ক্যানসার। নন হজকিন লিম্ফোমা। হজকিন লিম্ফোমা এখন হেমাটোলজিস্টদের গড়পড়তা অহমিকার জায়গা, কিন্তু নন হজকিনে তা না; আমাদের এক প্রতিবেশীকে দেখেছি তো, এই নন হজকিনেই, সেটা ম্যান্টল সেল লিম্ফোমা ছিল, কিভাবে, কি মসৃণতায় কত দ্রুত হারিয়ে গেলেন!

 

এই ভদ্রমহিলা... আর এভাবে কেন লিখি, আমার থেকে অনেক তো ছোট তো সে, তার বাবা কিন্তু সারভাইভ করে গিয়েছিলেন, সমস্যা করছিল দাঁতের পাটিজোড়া। যাঁরা এখান থেকে অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স খুঁজতে চাইছেন বা যাঁরা এখান থেকে মেটাস্থেসিসে অপসৃত হতে চাইছেন, দু-পক্ষই কিন্তু ভুল করছেন। পাতি ডেঞ্চারের প্রবলেম, খুব কমন জেরেন্টোলজিক্যাল সমস্যা যেটি, সেটিই হয়েছিল। তা সারভাইভ করে গেছেন মানে, ওষুধপত্র আর লাগে না, এমনটা তো নয়, নশ্বর ঈশ্বর হতে হতেও অতোটাও ঈশ্বর এখনো হয়ে উঠতে পারে নি, ফলতঃ ডেন্টিস্ট কেস হিস্ট্রি শুনে-টুনে বললেন, দুটো দুটো করে দাঁত তুলবেন তিনি। কারণ ক্যানসারের ওষুধও খেয়ে যেতে হয় তাঁকে। তো, সেই মতো চলতে লাগল। শেষ দাঁতজোড়া যেদিন তোলা হলো, সেদিন সে ভদ্রলোক মহা চিন্তিত, উদ্বিগ্নও বলা যেতে পারে; নতুন দাঁতের পাটি ফিট করবে কিনা। আইসক্রিম দিয়ে ডিনার এবং অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে পরদিন লিস্টারিন বা হেক্সিজেলে মাউথ ওয়াশ... মেয়েটি বাবাকে জলখাবার খেতে দেখে অফিসে এলো, দেড়টা নাগাদ ভদ্রলোকের শরীর আনচান করতে শুরু করে; এই বছরের আগস্ট মাসের কোনও এক খর্বুটে দিনের কথা, মেয়েটির কাছে ফোন আসে; কিন্তু একজন ক্যানসার পেশেন্ট...  সবকিছু তো আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না, সাময়িক ব্যাপার ভাবে সে, তবুও হাউজ ফিজিসিয়ানকে একটা কল দেয়, হাউস ফিজিসিয়ান আসেন, এবং ততক্ষণে মেয়েটির বাবার শরীর রীতিমত কেমন কেমন করতে শুরু দিয়েছে। মেয়েটি আবারো একটি ফোন কলে বাড়ী ফেরে, অক্সিমিটার দিয়ে বোঝে তার বাবার শরীরে অক্সিজেনের স্যাচুরেশন খুবই কম, সিলিন্ডার আনায়, সিলিন্ডার চালুও হয়...

 

এইখানে আমি দেখেছিলাম মেয়েটি থেমে গেছে; এ হয়, একটা জায়গায় গিয়ে মানুষ সাড় হারায়, আর এ তো মামুলি শব্দ, পাঁশুটে; তার আঁখিতে চিকচিক করতে থাকে জল, নোনা, আর তার ঘন্টাদুয়েক পর অবিশ্বাস্য কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাওয়া শেষ হয় ভদ্রলোকের। সব কষ্ট থেমে যায় যে দশায়, বাহাত্তর বছর বয়সে তিনি সেই দশায় চলে যান, যেখানে গেলে কোনও আদরের মেয়েই বাপি বলে ডাকলে প্রত্যুত্তরের সাড়া কোনও বাপীদের পক্ষেই দেওয়া আর সম্ভব হয় না।

 

মেয়েটি নিজেকে গুছিয়ে নিতে খুব সময় নেয় না; আমাদের ফিল ইন করা ফর্ম নিজেই ভরে দেয়, আর আশ্বস্ত করে, দশ-বারো দিনের মধ্যে সব আমাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিস আমরা পেয়ে যাব। তাও সে, নিয়মের বাইরে গিয়ে, তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দেয়, কোনও অসুবিধা হলে জানানোর জন্য।

 

এগুলোও কি পাওয়ার ছিল? আমাদের? আদৌ?

 

ফিরতিপথে মেট্রোরেল নিয়মের ঢালাই ব্রীজ পর্যন্ত আসে না, টালিগঞ্জেই থেমে যায়, আমরা ক্ষুব্ধ হই, পরের মেট্রোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে শুনিঃ একটা মেট্রো জ্বালিয়ে দিলেই নাকি সব মেট্রো সুড়সুড় করে ‘ভালো’ হয়ে যাবে। ট্রামভাড়ার লিগ্যাসি বহে নিয়ে যাচ্ছি কিনা; তবে এ শবভার মাঝেসাঝে, ইদানীং, বড়ো পাষাণ ঠেকে; যাই হোক, পরের মেট্রোতে, সেটার ঘোষিত কড়ার শুনলাম ঢালাই ব্রীজ পর্যন্ত যাওয়ার, কিন্তু আমরা ভিড়ের জন্য উঠতে পারি না। আমরা রেগে যাই। খিস্তি করি। পরের মেট্রোও ঢালাই ব্রীজ পর্যন্ত যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আসে, এটা এতটাই ফাঁকা যে আমরা বসার জায়গাও পাই, নিজেদের স্মার্ট ভেবে মুচকি হাসি।

 

এগুলোও কি দেওয়ার ছিল? আমাদের? আদৌ?

 

 

 

গানটি শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া তুমি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছ, মাঝের ভার্সের কিছুটা।

গানটির রচয়িতাঃ শ্রী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

সুরসৃষ্টিঃ শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

 

একটি কথা এই অবেলায় না বলে পারছি না; - কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছ-এর তুমির প্রতি যে মায়া রয়ে যায়, সেটা সামান্য স্থুল; তুলনায় নিশীথ শয়নে জাগে আঁখি উদাসী অনেক বেশী শাণিত। অন্ততঃ আমার মগজে যে ইমেজারি তৈরী হয়, সেই সাপেক্ষে। ঘুমোলে পর সেটা চোখই, কিন্তু জেগে রইলে অরব, অথই অথচ ফাঁকা, সেটা আমার কাছে আঁখি। আঁখিই। আমার ধারণা যেমন যায়, আলো ফেললে আপনি সেখানের জমিতে ব্যথিত সাদাই দেখবেন, আর সে সাদাকে আপনি বোধহয় অনায়াসে শাদাই বলে ডাকতে পারবেন।

এখন মায়া জিনিসটা, যাতে কিনা দক্ষিণা কালী অবধি আবদ্ধ, সেটা স্থুল হবে, নাকি, শাণিত সে বিচারের ভার আপনাদের।

 

 

 

 

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ          ©

 

ফটো কার্টসিঃ  গুগল ইমেজেস 

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে

 

No comments: