হয়েছেটা কি, ওহ্, না, না এ তো পুরানো সেই দিনের কথা, হয়েছিলটা কি, তখন যৌবনের সূর্য এক্কেবারে মাঝ আকাশে ধকধক করছে, সেই যাকে বলে আপনার, এক্স্যাটলি ধকধক করনে লাগা-র দশা, তবে ছেলেদের ভার্সনে। আমার দিন কাটে না, আমার রাত তো আরোই কাটে না; বেলার দিকে একপেট খেয়ে বিড়ি ধরিয়ে... এগারো কেলাস, বাড়ীতেও জানে বিড়ি-ফিড়ি টানি, অতএব ঠিক সেইরকম ধোঁয়া উড়িয়ে, যেরকমটা দেখলে শ্রীময়ী রচনা ব্যানার্জী অবধারিত ভেবে নিতেন মুখে কারখানা বসিয়েছি, অবিকল সেইরকম ধোঁয়া উড়িয়ে ইস্কুলে যাই, গিয়ে তিনশো জর্দা দিয়ে পান চিবোতে চিবোতে, তখন মধু, তলব এইসব গুটখা পাওয়া যেত; আজ্ঞে না, ক্লাসে নয়, মিত্তিরদের বাগানে বসে টোয়েন্টি নাইন খেলি, পাঁড় পেলেয়ার পেলে নভিসদের অকশন ব্রীজ, টিফিনে আসি, বৈশাখীর (পুরুষ কিন্তু) দোকান থেকে ভিড়ের মাঝে হাত গলিয়ে দিয়ে শালপাতায় কচুরি নিই, নিয়েই গঙ্গার (আদি গঙ্গা, সভ্যতা তেরী মা কি, কিঁউকি, আদি গঙ্গা ভি মইলী হয়ে বুজে গেছে কবেই) ধারে সেঁটে, পাঁচ কচুরীর দু’ টাকা গেঁড়িয়ে দিয়ে, কি আশ্চর্য, বিকেলের ঠেকের জন্য বিড়ি-সিগারেট-খৈনী কিনতে হবে না; ক্লাসে যাই, ক্রাশের সঙ্গে কিছু তুচ্ছ কথা বলি, গ্যালারিতে বসে পানু আর চটি, অ্যাল্, যাহ্, সরি সরি, বটতলা, বটতলা... বটতলার বইপত্তর দেখে, পড়ে, আউড়ে বিস্তর জ্ঞান অর্জন করে বাড়ী ফিরে আবার একরাশ খেয়ে বোসপুকুরের ধারে যাই।
ইস্কুল থেকে বাড়ী ফেরাটা আমি এর আগে বারতিনেক লিখেছি, অতএব হ্যাজ মারিয়ে লাভ কি! কিন্তু এই শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’র মাঝে দেখতাম মিছিল যাচ্ছে। শুধু মিছিল যাচ্ছে। বাসও যেত কিন্তু এই অট্টারোহী বাহিনী তখনো এ’র’ম পেখম মেলেনি। সিপিআই (এম)-এর মিছিল। শাসকদল, বাড়ীর সবাইও কি বুঝে কিংবা না বুঝে কম্যুনিস্ট; অতএব আমিও। বামপন্থার একমাত্র বিকল্প হলো উন্নততর বামপন্থা’র আওড়ে লাট খাই হররোজ। এস এফ আই এর পক্ষ থেকে আমায় রোজই ডাকে, সুসি (এস ইউ সি আই) পার্টিও ডাকে, তা ভালোবাসা তো নিশিরাতে ডাক দিয়ে যায়, কত কথা কয়, তাই না? আর আমি সে বাউন্সার ডাক করি, সরাসরি ডি ওয়াই এফ আই করব, মানে, স্টেট না খেলে একদম ন্যাশানাল খেলব বলে দিয়ে। ভজানোর জন্য অবিশ্যি সাঁঝের ক্লাসে মাঝে-সাঝে যেতে হতো, কিন্তু যা দেখতাম, আমি ক্লাস এইটে মার্ক্স বা মার্কড হয়ে ওঠা সিস্ট সম্মন্ধে যা যা বই পড়েছি, এরা সেটুকুও পড়ে নি। না পড়েই মার্ক্সিস্ট। মার্ক্সিস্ট হতে হয় বলে মার্ক্সিস্ট। মার্ক্সিস্ট হলে হিত হয় তাই মার্ক্সিস্ট। এগুলো মার্ক্স বলেন নি আমি শিওর, এঙ্গেলস-এর কথা জানি না, হয়তঃ পরবর্তী এডিশনে অ্যাপেন্ড করে থাকবেন...
এগুলো কোনও কাজের কথা নয়, কোনও প্যাচাল পাড়ার জন্য এ লেখা আমি লিখছি না; আমি আমার সমস্যা জানাতে এ লেখা লিখছি। আমার সমস্যা আমি ছাড়া আর ভালো কে জানবে! ইন্ডিভিজুয়ালের সমস্যা যখন টিপিক্যাল... থাক গে। ইচ অ্যান্ড এভরি ইন্ডিভিজুয়াল ইজ ইউনিক... উরি ফাদার, এ তো ক্যাপিটালিস্ট কথা। ইয়ুং বলে ফেলে প্রচুর খিস্তি খেয়েছেন। অতএব এসব থাক, যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন আমাদের অঞ্চলে দুটো সিনেমা হল ছিল, রুম্পা (মা-বাবার বয়ানে, ছায়াবাণী) আর অন্নপূর্ণা। শেষোক্ত নামের একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল... আরে ধ্যাৎ! মোটকথা হলো, আমাদের পাড়া... ইয়ে, না, না, আমার সমস্যা, আমার লিখন।
সিনেমা প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলে নেওয়া যাক, তখন আমাদের রোল মডেল কে? শচীন? মিঠুন? – আজ্ঞে না, প্রথমতঃ তখনো শচীন, তেন্ডুলকর হয় নি, আর দ্বিতীয়তঃ আমরা বোকা ছিলাম ঠিকই, এবং আজও আছি, একথাও ঠিক, তাই বলে ঠিক অতটাও বোকাচোদা ছিলাম না। তখন আমাদের রোল মডেল আমাদের, ইয়েস, আমাদের, কারণকি, তখন চাড্ডী, তেনু, নেকু, ঢং সব ফুস, জিধার দেখুঁ লাল কি তসবীর হ্যায়, লালই লাল হ্যায়, দুসরা কোঈ নেহী; এল সি এসরা। অনৃত লিখন না করতে কি, এঁরা যে কী করেন, কী করে এঁদের চকমিলান উঠছে, সকালে পূবে, তো, বিকেলে পশ্চিমে, জমি বিক্কিরি হচ্ছে নির্ঝঞ্ঝাটঃ নাহ্, গড়বড় নির্ঘাত আছে, বলেই স্যাট করে তাঁরা ঢুকে যাচ্ছেন আর... আর অদেখা, অধরা পবলেম, এহ্ বানানের কি ছিরি, প্রবলেম সলভ করে দিয়ে চলে আসছেন। এসেই যে থামছেন, তা কিন্তু না, এককাপ দুধ চা, তাও কিনা গুঁড়ো দুধের, মেরে দিয়েই মার্কিন সাম্রাজ্যের কালো হাতত্ (স্ট্রোক), ভেঙে দাওও্ (স্ট্রোক), গুঁড়িয়ে দাওও (স্ট্রোক)। আমি আমার থইথই যৌবন নিয়ে কী আর করব, গুঁড়ো কয়লা, গুল এইসব দেখি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। সেই যে সেই, আমার পূব দিকে হয় পুকুর ভরাট, পশ্চিমে জুহি চাওলা, উত্তরে ঘুঘু গ্রাম প্রধান, দক্ষিণে থাকে হাওলা, ও নবী, আমার কী হবে, আমি যে নূর পালাম না... কেস, একদম খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ। তা সকালবেলায়, যখন কিনা পঁচানব্বই পার্সেন্ট বাঙালী প্রমাদ গোণে, আজ হাগাটা পরিষ্কার হবে তো, এঁরা কিন্তু স্মিত মুখে বাজারে এবং নির্বাক, অবিকল ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের মতো। তখন চাষারাই আসত সবজি বিক্রি করতে, কিংবা দু চারটে ভেন্ডার, সব্বাই এঁদের চিনত, শুধু যে চিনত তা নয়, তা হলে তো হয়েই যেত, অভিজাত আনাজ থেকে অসভ্য পাতা পর্যন্ত কোন্টা এঁদের কোন্দিন, কতটা করে দরকার, বুঝে সুঝে তবে থলে বোঝাই করত। মাছওয়ালা পেটি বা ল্যাজা দেবে... এমন বুকের খাঁচা নিয়ে তখনো কোনও মসীহা হাজির হয় নি। শুধু গাদা আর মুড়ো যাইবেক, অল্যকিহু লহে। মুর্গী বা পাঁঠার কথা খুঁড়ে আর বেদনা জাগালাম না, মোটকথা, পাঁঠার মাংসের দোকানের সামনে ব্যাপক লাইন, আর শামসুদ্দীনের পো নির্বিকার মুখে গর্দান থেকে, রাং থেকে বেছে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, বাকীরাও স্পিকটি নট, পুরোদস্তুর চোপ্, আদালত চলছে। তাহলে সাইডবার্নহীন মিঠুন চক্কোত্তি আমাদের হিরো হবে? আমাদের মুখে জাতীয় বলুন, গণ বলুন, সঙ্গীত তখন একটাইঃ এবার মলে এল সি এস হব, রিয়েল এস্টেটের হোগা ভরব, ছাপ্পা ভোটের ব্যেইট হয়ে দুলব আলিমুদ্দীনের কোমরে, তোমরা নায়ক বোলো আমারে। কেউ আবার দাম-দস্তুর জিগাবেন না যেন; নজ্জা নাগে বড়। শরমের একটা নমুনা এইরকম, এস এফ আইয়ের বার্ষিক দু টাকা দিতে গিয়ে নিজেকে শাহেনশাহ্ মনে হতো। পাশাপাশি একটা গর্বও, আমাদের পার্টি... বছরে দু টাকা... আর তাতেই খুশী –
- দশ টাকা দিচ্ছিস যে বড়! বড়লোক হয়ে গিয়েছিস, নায়ি?
- ছিঃ অনলদা, বড়লোক বলতে নেই; ওতে পাপ হয়। বলো বুর্জোয়া। তবে বুর্জোয়ার পেটি নয় কিন্তু। ওসব পাড়ার বৌদিদের হয়।
- আজকাল পাড়ার বৌদিদের দেখে বেড়াচ্ছিস, নায়ি?
- আরে ধুর, লোকে বলে...
- লোকে তো অনেক কিছু বলে। সব শুনতে হবে, নায়ি?
- তা বলা মুখ, চলা পথ। কথা কানে আসবে না? কি যে বল না মাইরি তোমরা!
- আমরা আল ফাল বলি, নায়ি? ওই জন্য তোকে মীটিঙয়ে আর দেখা যায় না, নায়ি?
- আরে গুরু, খেপছ কেন? পড়াশনার চাপ খুব বেড়েছে, বুঝলে।
- পড়াশনার চাপ খুব বেড়েছে, নায়ি?
- হুম গো। সামনে এইচ এস। পাস না করলে বাড়ী থেকে লাথ মেরে ভাগিয়ে দেবে।
- পাস না করলে বাড়ী থেকে লাথ মেরে ভাগিয়ে দেবে, নায়ি? ওইজন্য বীরেশ মাস্টারমশাইয়ের মেয়েটার সঙে ঘুরে বেড়াস, নায়ি?
- কবে দেখলে?
- গতকাল তুই মন্দার সিনেমা হলে যাস নি, নায়ি?
- ওহ্, ওটা... ইয়ে বচ্চনের পুকার সিনেমাটা আগে দেখি নি তো।
- মেয়েটার সঙে, নায়ি?
- হ্যাঁ। ও-ও বলল যে ওরও নাকি সিনেমাটা দেখা নেই।
- তোর মেয়েটার সঙে ঘুরতে ভালো লাগে, নায়ি? প্রেম করিস ওর সঙে, নায়ি?
- ধ্যেৎ, কি যে বল না, ও আমার খুব ভালো বন্ধু।
- শুধু বন্ধু, নায়ি?
- মা কাল্... ইয়ে, উঘ, আম্ম্, মা-মা-মার্ক্সের দিব্যি। বিশ্বাস করো। ভালো কথা, এস এফ আই কহে পুকার... তোমাদের এই শ্লোগানটা শুনলেই না আমার পুকার সিনেমার গানটা মনে পড়ে, বাঁচকে রহে না রে বাবা, বাঁচকে রহে না রে... শুনেছ গানটা?
- আমাদের থেকে বাঁচতে চাস, নায়ি?
- ওই দেখ, কি বললুম আর কি বুঝল!
- আমরা তো সবসময়ই ভুল বুঝি, নায়ি?
- সরি অনলদা, আমারই ভুল। মাফ করো।
- সরি বললেই সব সমাধান, নায়ি?
- উফফ, টাকাটা ধর, প্লীজ। আর বিল কাটতে হবে না।
- ভিক্ষে দিচ্ছিস, নায়ি?
- মানে?
- তখন বললি মাফ করো, এখন বলছিস বিল কাটতে হবে না... ভিক্ষেই তো, নায়ি?
- অনিন্দ্য, বামপন্থা মানে ভিখিরি নয়।
- হ্যাজাস না। একদম ভাট হ্যাজাস না। তোর সঙ্গে কথা হচ্ছে না। অনলদা, পার্টিটা কিন্তু আমারও। ভালোবেসে আমি পার্টিফান্ডে দশ টাকা কনট্রিবিউট করতে পারি না!
- পথিকৃত ভুল বলল, নায়ি? আমরা তো ভিখিরি, দু’ টাকা করে চেয়ে বেড়াই, নায়ি?
- কাম অন্, অনলদা, হাউ ক্যুড অন আর্থ আ পলিটিক্যাল পার্টি বি কন্সট্রিউড অ্যাজ আ বেগার!
- ইংরেজী ফচকিয়ে পার পেয়ে যাবি ভাবলি, নায়ি?
- তুমি টাকাটা নেবে না? আমার তাহলে পার্টিকে ভালোবাসার অধিকার নেই! ঠিক আছে, সুবীরদা’র সঙ্গে দেখা হলে তোমাদের মনের কথা জানিয়ে দেব ‘খন।
- নাম নিয়ে ভয় দেখাচ্ছিস নাকি বে?
- তুই বেশী চমকাতে যাস না বে, তোর দৌড় জানা আছে। দম থাকলে বিকেলে বোসপুকুরে আসিস, স্কোর লেভেল করে দেব।
- কমরেডকে পেঁদাতে ভাল লাগে, নায়ি? নিজেকে হিরো লাগে, নায়ি?
- চলো তো, অনলদা, এই মালের কাছ থেকে ডোনেশন নেব না আমরা।
- তোর বাপ নেবে বে। বাড়ী এসে নিয়ে যাবে।
- ভদ্রভাবে কথা বল, অনিন্দ্য। অনলদা, ও কিন্তু স্ল্যাং ইউজ করে যাচ্ছে তখন থেকে। বোসপুকুরে ওদের ঠেকে ডাকছেই কাঁওতালি করার জন্য। ওই যে স্কোর লেভেল করে দেবে বলল না, তুমি না থাকলে কিন্তু অন্য শব্দ বলত।
- মেয়েদের মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে ভালো লাগে, নায়ি পথিকৃত?
- তাছাড়া সে তো মাসীর যদি গোঁফ থাকত, তাহলে মামা একটা বাড়ত। তুই ভাটাস না। দ্যাট ডাজন্ট সার্ভ দ্য পারপাস। উল্টে কিচাইন করছিস। ধরিস তো মাকড়া সেই কেরোসিনের ঝান্ডা, জানিসই তো ওতে গান্ডাই মারা যায়। জায়গা চিনতে শেখ কথা বলার জন্য, অন্যের ডায়ালগে নাক গলাচ্ছিস কেন? অনলদা’র সঙ্গে কথা হচ্ছে আমার। তুই কাল কা যোগী মাঝে আসছিস কেন?
- হোয়াট দ্য হেল ডু ইউ মিন বায় দ্যাট...
- পথিকৃত, তুই থামবি, নায়ি? অনিন্দ্য, কমরেডদের সঙে ঝগড়া করতে খুব ভালো লাগে, নায়ি?
- ঝগড়া নয়। কাউন্টার লজিক। নেহাত কম দিন তো দেখছি না; কিছু বললেই লবি বুঝে ইয়েস, উই আর ইন, উল্টো লবি হলেই অ্যাবসলিউট ইম্বেসাইল সেঁটে দিয়ে ভেটো মারা! ছাড়, অনলদা, তুমি তাহলে আমার কন্ট্রিবিউশনটা অ্যাকসেপ্ট করছ না, তাই তো?
- নেব। তুই তাহলে আমাদের সঙে চল। পাড়াটার কালেকশনটা করে দে। পড়ার চাপ আছে, নায়ি?
- বিলকুল না। চলো, তুমি আর আমি কালেকশনটা করে আসি। সিগারেট খাওয়াবে তো? বিড়ি খাব না কিন্তু, আগে থেকে বলে রাখলুম।
- খাওয়াব। কিন্তু এরা কোথায় থাকবে? গাছতলায়, নায়ি?
- বালাই আশি। গাছতলায় কেন অনলদা, এরা ততক্ষণ আমার ঘরে বসুক। ফ্যানের হাওয়া খাক। গরমে ওদের তালু-ঘিলু চটকে গেছে।
- তোরা বোস তাহলে, নায়ি? রাজার শখ হয়েছে ভিখিরিদের সঙে ঘোরার, নায়ি অনিন্দ্য?
- আচ্ছা, আমি না হয় রাজা। রাজছত্র ভেঙে পড়ে... যাক গে যাক। কথা হচ্ছে, ভিখিরিটা তাহলে কারা? ধসে যাওয়া বুর্জোয়ারা? আমরা তাহলে এখন সর্বহারাদের ছেড়ে দিয়ে বুর্জোয়াজিসদের রাইটস নিয়ে লড়ছি? কোন প্লিন্যমে এটা ঠিক হলো, অনলদা?
- কালেকশন করতে যাবি তুই কি নায়ি?
- চলো, আমি তো পা বাড়িয়েই আছি। তোরা আমার ঘরে বোস। (ঘাড় ঘুরিয়ে, চিল্লিয়ে) মা-আ-আ, এদের জন্য একটু চা করে দাও না, প্লীজ। কুকিজ, ইয়ে, বিস্কুটও দিও। নইলে বলবে কিছুই খাওয়ায় নি। চলো, চলো অনলদা। (কয়েক পা এগিয়ে) উল্টোদিকের গলিতে একটা মেয়ে থাকে। আমাদের চেয়ে এক ক্লাস জুনিয়র। দিয়া। চেন তাকে?
- না। কেন, এটাও তোর গার্লফ্রেন্ড, নায়ি?
- নাহ্, তবে তোমার সঙ্গে হেব্বি মানাবে, বিশ্বাস কর, মাইরি বলছি।
আগেই লিখেছি, আমাদের উদিত হয়ে মধ্য গগনে চলে আসা যৌবনাদিত্যের সময়ে সিনেমা হল ছিল দুটি, ঊনপঞ্চাশ দিক ধরলে অনেক, আমরা চষতেও যেতাম দীর্ঘ জমি, তা ফসল স্বাদু হলে যাব না! কিন্তু যৌবনসূর্য গেল অস্তাচলে হওয়ার পর, এই আঁধারে একা লাগলেও মেঘের(ও) খেলা দেখতে গিয়ে দেখছি, আকাশ(ও) পারে সে দুটোরও পুটকি মারা গেছে। আঁধার অবিশ্যি তখনো নামত, এবং সেটা এখনের চেয়ে অনেক বেশী, তবে কিনা তেলেভাজা আর ঢপের যতরকম চপ হয় আর কি, সেসব ছাড়া আর শিল্প তো আর নেই ইদানীং, তায় আবার ঘুগনি-মুড়ি আর চায়ের ব্যবসার দিকে লাতাড়ে অনুপ্রেরণা দেওয়া হচ্ছে, অ্যাজ ইফ জাতীয় খাদ্য ওটা, আর পিয়ারা পাতার চায়ের সাথে প্রোলিতারিয়েতে (এ কি রানী, এ কি শুনি, এখনো নাকি, কাপড়ই খোলো নি!) তা দিয়ে অ্যাপেটাইট বাড়ায়। সে যাক, চাক্কা জ্যাম সেসময়ের হবি হলেও কারখানা গোণাগুণতি বেশ কিছু ছিল তখনো, জ্যান্ত অর্থাৎ উৎপাদনশীল; আর পাওয়ার কাট সেগুলোর দিকেই অ্যাট্রিবিউটেড হতো। আর এখন কোন্সা কারখানায় ইলেক্ট্রিসিটি লাগে তা আপনি-আমি তো কোন্ ছার, স্বয়ং ঈশ্বরও হাপসি কাটবেন উত্তর খুঁজতে গিয়ে, তবুও দিনে দুবার করে মিনিট কুড়ি-পঁচিশের জন্য কারেন্ট বাঁড়া যাবেই। কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্টের স্পিরিট নিয়ে ভাবলে এটাও অবশ্যই সার্ভিস প্রোভাইডিংয়ের ডেফিশিয়েন্সী, কেননা, কারেন্ট অবিচ্ছিন্নভাবে আসবে অ্যাসিউম করে নিয়েই আমি বিদ্যুতের বিল ভরি, তা সে তিনমাসের চক্করে ডব্লু বি এস ই ডি এস এল বিলের অ্যামাউন্টে যতই পাবলিক মানির পিলফ্যরেজ হোক না কেন, আর সি ই এস সি মাসে মাসে ইলেক্ট্রিক কনজাম্পশানের বিল নিয়ে যতই সেই ধাপ্পাবাজিটা চোখে আঙুল গুঁজে দেখিয়ে দিক না কেন! অবশ্য পোঁদে স্পিরিট না পড়লে বেড়ালের চৌপর দৌড় যথা বাঙালী কিছু নিয়েই এখন আর তলিয়ে কিছু ভাবতে চায় না, সে এখন উদাস বাউল ফাউল নয়, জাষ্ট ভোলা মেরে গেছে, সেক্সি শীলার কোকাকোলা আর কি, কম্ফোর্টেবলি নাম্ব।
মাঝেমধ্যেই দেখছি পুরানো সেই দিনের কথার মধ্যে যাত্রার বিবেকের মতো ঘাই মেরে যাচ্ছে সাম্প্রতিক। সততই ক্লান্তিকর। এটি। এনিওয়ে, যৌবনের দিনগুলোতে ফিরি, যেটা কিনা ফেলা আসা, আর গুরেন্দ্রনাথ মেনেই সোনার খাঁচায় ছিল না কখনো; এল সি এসগণেরা ছাড়া বয়স্ক এবং অমলিন, শুভ্র-সমুজ্জ্বল ধুতি-পাঞ্জাবী কিংবা সাদা শার্ট মাস্ট জেঠুদের দেখেছি এইরকম যে, বক্তৃতা দিতে তাঁরা বড় ভালোবাসতেন। এই কথাটা লিখতে গিয়ে মনে হলো, সত্যিই তো, সামনে সস্তা মাউথপিস আর পরনে জিনস আর ঈজিপসিয়ান কটন, কিংবা লিনেন, নিদেনপক্ষে কটন ব্লেন্ড লিনেন একটাও তো মনে পড়ছে না। বরং মনে পড়ছে, আমাদের ইস্কুলের দেববাবু স্যারের কথা, বাংলার শিক্ষক এবং অতি অমোঘেই ধুতি-পাঞ্জাবী, এবং তাঁর ক্লাস মিস যাতে না যায়, সেজন্য সায়েন্সের জয়েন্টমুখী (পরীক্ষা ইঙ্গিত করতে চাইছি) ছেলেরাও নোটবুক দাগিয়ে রাখত; যে কটা পিস তিনি পড়িয়েছিলেন, রসবোধে, সুচারু বিশ্লেষণে প্রত্যেককটা মাস্টারস্ট্রোক।
একদিন বিশ্বজিতদা’, আমার অঙ্কজ্ঞানের নাড়ি সামান্যই, খুবই ক্ষীণ, তবুও সেটুকু শিখেছি যাঁর কাছে; লো ভল্যুমে সমুন্দর সিনেমার গান বাজছে, অ্যায় সাগর কি লঁহরো, হাম ভি আতে হ্যায় ঠ্যাহেরো, আর তিনি আমার ভুল করা অঙ্কটা ঠিক নয়, নিজে সঠিক কষে দিচ্ছেন, নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার দায় আমার, এবং এ ছিল তাঁর প্রাথমিক কড়ার; আচম্বিত অঙ্কটা কষতে গিয়ে থেমে গেলেন। ভাবলাম, আইল্যা, এমন অঙ্কও তাহলে সিলেবাসে আছে যেখানে বিশ্বজিতদাকেও থামতে হয়!
‘বুঝলে অনিন্দ্য, তোমাদের দেববাবু, আহা, তোমাদের দেববাবু স্যার গো, এই *** খানে -,’ বলে যে জায়গাটা বোঝালেন, সেটা আমাদের বাড়ী থেকে মেরে কেটে ফার্লং পঞ্চাশ দূরে, ‘একটা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, বুঝলে - এই আমি আসার সময় দেখে এলাম, বুঝলে। তো তিনি বললেন, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব যাই বলে যান না কেন, উইথ ডিউ রেসপেক্ট, বিপ্লবের পথই একমাত্র পথ, বিপ্লবই হলো মানুষের ভালো থাকার উৎস - বলেই থেমে গিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিলেন। আচ্ছা, এই বিপ্লবটা কিসের বিপ্লব গো?’ উত্তর কি দেবো, ততক্ষণে আমার দুটো বিস্ময় জন্মে গেছে; তবুও ডাউট ক্লীয়ার করার জন্য শুধোলামঃ ‘স্টেজেই বিড়ি ধরালেন?’ বিশ্বজিতদা বললেনঃ ‘তাই তো দেখলাম। আচ্ছা বিড়ির আগুন থেকেই কি বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়বে?’ আমি বললামঃ ‘দেববাবু স্যার তো... স্যার পারেন, বিড়ি কেন বিশ্বজিতদা, মালের গ্লাস হাতে দেববাবু স্যার যা বলবেন, লোকে বেমক্কা-বেমদিনা মুগ্ধ হয়ে শুনবে।’ ‘কিন্তু বিপ্লবটা...?’ বিশ্বজিতদা’র এই কচ্ছপের কামড়-মার্কা প্রশ্নে আমি যার পর নাই দিশেহারা হই, বলেই ফেলিঃ ‘অ্যাদ্দিন তো জানতাম, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।’ তখনো প্রতুল মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত হন নি, ফলে, আমাদেরও কিসের ভয় লাল ফৌজের শোনা হয় নি, শোনা হয় নি মেল টিলিসের সেই বিখ্যাত রুবি কম্পোজিশনও, যেটার প্রসঙ্গ বুঝতেই বছর পাঁচেক লেগেছিল; চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান শুনেছে আমাদের বাপ-কাকারা, গোদার তখনো আলোকবর্ষ দূরে যে ভেবে উঠতে পারব, মাও ভালো রাঁধুনি ছিলেন, গোটা চীনকে তিনি বছরভর খাইয়ে গেছেন। কিন্তু বিশ্বজিতদা এই বন্দুকের অঙ্কটাও কষে ফেলতে উদগ্রীব; ‘কার বা কাদের বন্দুক বলতে পারো, অনিন্দ্য?’ আমি বলিঃ ‘কেন, সোভিয়েত দেশের।’ তখন সাবেক সোভিয়েত দেশ ভেঙে কুচি কুচি হতে শুরু করেছে, ঈস্ট ইওরোপ, বিশেষ করে যুগোশ্লাভিয়া ভাঙছে, বসনিয়া আর সার্বিয়ার মধ্যে যতনে লত্লতিয়ে বাড়ছে এথনিক যুদ্ধের চারাগাছ, আর আমরা তখনো চিত্রহার আর রঙ্গোলি দেখে চলেছি! কিন্তু বিশ্বজিতদা’ কি ছাড়েন, ছাড়তে পারেন, বিশেষ করে অঙ্ক যেখানে অসমাপ্তঃ ‘কিন্তু বন্দুক তো আমেরিকারও আছে!’ আমি স্ট্রেইট চোথা মারিঃ ‘আহা, সেগুলো তো ক্যাপিটালিস্ট বন্দুক!’ বিশ্বজিতদা’ অসমাপ্ত পারম্যুটেশন-কম্বিনেশনের দিকে মন দেনঃ ‘কে জানে ভাই, বন্দুক তো বন্দুকই। বুলেটের গায়ে কম্যুনিস্ট - ক্যাপিটালিস্ট কি লেখা থাকে...’ অ্যাজ ইফ, -
– কিসে মরলি পাঁচুর বাপ?
– এঁজ্ঞে, কম্যুনিস্টদের গুলিতে।
– তাই? উরিসাঁটা! যা যা বেহেশতে যা। আর তুই? তুই কী করে মরলি?
– স্যার, ক্যাপিটালিস্টরা ঝেড়ে দিয়েছে।
– যত্তো ক্যাজড়া... চল, হাওয়া কাটা, সোজ্জা নরকের ফুটন্ত ধারা ধারা বিশুদ্ধ ধারা তেল। একদম গ্যালপ। যা, পাতলা হয়ে যা। গেলি?
– স্যার, ইয়ে, সরি, ভগবন, একটা প্রশ্ন ছিল।
– প্রশ্ন? সে কি রে বানচোত, প্রশ্ন আবার কী রে এখানে?
– স্যার, প্লীজ স্যার, শিট, হে ভগবন, জাষ্ট আ লিটল ক্ল্যারিফিকেশন...
– বল। মনে রাখিস, যত প্রশ্ন তত টগবগে তেল কিন্তু।
– ভগবন, আপনি তো জানেনই, শিশিরে যার জ্যোৎস্না পাতা, আগুন তাহার কী করিবে... ঘুরিয়ে বলব ভগবন?
– বল্ বাবা, বল্।
– সাগরে যার বিছানা মা, শিশিরে তার কী করিবে...
– তুই কিছু একটা জানতে চাইছিলি, না রে ব্যাটা?
– হ্যাঁ স্যার। স্যার, ক্যাপিটালিস্ট বুলেটে ক্ষতিটা কি?
– ও কি রে, অ্যাদ্দিন মর্ত্যলোকে কাটিয়ে এসে এসব কি কোশ্চেন মারাচ্ছিস রে...
– ব্যাখ্যাটা ভগবন...
– আরে ক্যাপিটালিস্ট বুলেট... ক্যাপিটালিস্ট মানে জানিস?
– আজ্ঞে, পুঁজিবাদী।
– তবে? কত রক্ত শুষে ওই বুলেট তৈরী হয় জানিস। পুঁজি শব্দটাকে নিয়ে ভেবেছিস কোনো দিন? শব্দটাই বলছে পুঁজই; - মানে, গোটা ব্যাপারটা জুড়েই পুঁজ, আর কিস্যু নেই। ওই বুলেট খেলে কত পুঁজ ঝরতে পারে বলে কোনও আইডিয়া আছে তোর? দাস ক্যাপিটাল পড়েছিস?
– নাম শুনেছি ভগবন। পড়াটা আর হয়ে ওঠে নি। আচ্ছা ভগবন, বইটার নাম দাস ক্যাপিটাল কেন? আপনি তো ত্রিকালজ্ঞ, যদি কাইন্ডলি বুঝিয়ে দেন...
– মানে, যে পুঁজি মানুষকে দাস বানিয়ে রাখে। এদিকে বন্ডেড লেবার তো কবেই ব্যানড হয়ে গেছে। এগুলো হলো গিয়ে তোর, পরোক্ষ খেলা। এবার বুঝছিস পুঁজি কি? আর কিরকম নোংরা, ফিলদি বুলেটে মরেছিস তুই!
আজ এই লেখা যখন লিখছি সেসব দিনগুলো, কিছু না হোক, চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পিছনে পড়ে আছে। এবং পড়ে আছে অপলক, যে চোখের ভাষা খুঁজতে গেলে বেধড়ক শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। অথচ কথা কিন্তু এমন ছিল না; - দেখা গিয়েছিল, মাটি অপেক্ষায়, কারখানার চিমনী প্রস্তুত, মানুষ দায়িত্ব বুঝে নিয়ে সহকর্মীর সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলে নিচ্ছে, কাজের জায়গায় সামঞ্জস্যের অলিখিত নিয়মাবলী যা প্রত্যেকেরই ঠোঁটের ডগায়, কাজের শেষে বাড়ী; দিদিমণি বউ আগে ফেরে, অনেকটা চা বানাতে হয় তাকে। বাইরের পোশাক বদলে নেওয়ার আগেই, ফ্লাস্কে থাকে বরের জন্য বরাদ্দ চা, চায়ে চুমুক মেরে সাড় ফিরে পাওয়া মাষ্টারের গলায় তখন তেজ ফিরে এসেছে আবার, নিজের চায়ে তরিবতের চুমুক দিতে দিতে বউ সেগুলো শোনে মগ্ন, বুঝে নেয় ছেলে বা মেয়ে লেখাপড়াটা কেমন করছে; আলো-আবছায়ার মধ্যেই রেখে দেওয়া বয়ঃসন্ধি কোনও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না; সোশ্যাল ট্যাবুগুলো, বিশেষতঃ যা যা নারীকেন্দ্রিক, অব্যাখ্যাতই থাকে তার কাছে, তবু সে কিশোর কোনও কিশোরীকে পণ্য হিসেবে দেখে না, মেয়ে তারা তোলে না, পটায় না, মেয়েরা ছেলেদের দিকে শরীরের ঝিলিক টোপ হিসেবে ছুঁড়ে দেয় না, সব মধ্যবিত্ত মনেই বড়ো হয়ে, শিক্ষিত হয়ে সংসার পাতার ইচ্ছে, শান্তি আর ভালোবাসার সংসার; প্রত্যেকের কাছেই প্রত্যেকের এক সার্বিক নিরাপত্তার আশ্বাস; খিদে আছে তো অন্ন আছে, শীত আছে তো গরম কাপড় আছে, বর্ষার ঝরোঝরো ধারা আছে তো মাথার ওপর ফাটলহীন ছাদ আছে। আর আছে শিক্ষার জায়গা, যেখানে সত্যিকারের সময়োপযোগী লেখাপড়া হয়, শরীর আছে অতএব ব্যাধি থাকলেও চিকিৎসাও আছে, যেখানে প্রযুক্তির পাশাপাশি ডাক্তারদের চোখের কোণে ভরসাও আছে, আর কি? হ্যাঁ, বাঙালী আড্ডাবাজ জাত, একটা জীবিকাই তাকে হাঁফ ধরিয়ে দেয়, অতএব দেদার কম্যুনিটি সেন্টার আর কফি হাউজ আছে; আর... সবার মনে সবার জন্য একটা বেসিক ভালোবাসা, যা দিয়ে পাশের মানুষের হাতটা ধরা যায়। আসলে স্বপ্ন, স্বপ্নের পর স্বপ্ন, লাতাড়ে স্বপ্ন এসে জমা হয়ে যাচ্ছিল স্তূপের মতো, ম্যারিনেট করে রাখা, যাতে জানান দেওয়া যায় একটা কোথাও আলো আছে, যেখানে একে অন্যের মুখ, হাত দেখতে পাবে ও দেখবে; যেন ডীপ ফ্রীজারে রাখা কাঁচা মাংস, রান্নাঘরের তাকে রেসিপি বইয়ের তাগাড় জমে গেলেও যা রান্না করা হবে না কোনও দিন; অথচ সেইসব অগণন স্বপ্ন দিয়ে মানুষের কিছুতেই কিছু হলো না, মাঝখান থেকে মানুষ শুধু ক্ষয়ে গেলো। সেই ছায়া-পৃথিবী থেকেই আমি আসছি...
বলতে দ্বিধা নেই, এখনও আমার দু চোখে স্বপ্নগুলো মরে যায় নি, সেগুলোকে সত্যি করে তুলতে আমি যে কোনও দূর অবধি যেতে পারি, আইনের মধ্যে থেকেও যে কোনও ধ্বংস করার ইচ্ছে এবং কলজে এখনও রাখি। কিন্তু পথ? পথে নেমে এ পথ খুঁজতে চাইলে পথ এলোমেলো সিঁথির মতো, আমায় গন্তব্যে নিয়ে যাবে না। পথের জন্যও বিস্তর বই ঘাঁটা লাগে, বিবেচনা লাগে, একাগ্র ভাবনা লাগে, প্রাথমিক ব্যর্থতাকে স্পোর্টিংলি নিতে পারা লাগে। জানি না কেউ পথ বলে দেবে কিনা, যে পথে যাই আমি, যে পথে গেলে মাগো... মানে, পথের শেষে আর কী আছে জানি না, তবে সব মানুষের মুখে নিশ্চিন্তির হাসি আছে অনাবিল, এটুকু নিশ্চিত। আর হ্যাঁ, সে পথ আজও অধরা। শুধু জানি, মানুষের যে কথা বলার সেটা সব্বাইকেই বলতে হবে আন্তরিক। আর সেটাই শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’র মাঝে জেগে থাকবে দ্বীপের মতো, শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা। অশ্রুটা অবশ্যই ব্যক্তিগত। কিছু অভাববোধ, শূন্যতার কিছু ধারণা যেন বেঁচে থাকে, সব পেয়ে গেলে নশ্বর আবার ঈশ্বর হয়ে উঠতে চাইবে। সে আর এক লাফড়ার গল্প।
যে কথা হচ্ছিল, বক্তৃতা... ইয়েস, এভাবেই, জাষ্ট এভাবেই যাবতীয় ডব্লু এইচ প্রশ্নের উত্তর নাকি সেইসব অমর, অপরাজেয় বক্তৃতার মধ্যেই দেওয়া হয়ে যেত। কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গাতেই কিছু আমোদগেঁড়ে, ন্যাকড়াবাজ, হাড়-হারামি ছেলেরা থেকেছে, আছে এবং থাকবেও, যারা বুঝেও সুবিধেজনকভাবেই বোঝে না। বক্তৃতাত্তোর পর্বে তারা সন্দেহ নিরসনে বসত। সেখানে থাকতেন কচি নেতারা, লাক বায় চান্স হলে এল সি এসরাও। সেখানে কী তবু চলে, যদিও কী কী নয় বলতে তাঁরা বেশী উৎসাহী র্যাদার। স্বাভাবিক। আফটার অল, সমাজতন্ত্রের ধর্মই এদিকে যায়, জল যেন বা, জ্যাঠাগিরি যেখানে একটু নীচের দিকে আছে। বস্তুতঃ কোথায় বললে তাঁরা একটু সংকুচিত, কুণ্ঠিত কেনকি, রাশিয়া আর সোভিয়েত নেই, এদিকে চীনও ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। আর লাতিন আমেরিকা ব্রাত্য কারণ সেখানে মার্ক্সিজমের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাস্ত্রো অবশ্য একটু ব্যতিক্রমী হয়ে শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন। তখনো। কেন, আজ আর সেটা মনে নেই। আদার খাড়া সব জায়গাতেই করতে হয়, নইলে, প্রতিবাদ বোধকরি, ফুঁয়ে উড়ে যায়। আসলে, কানপাটায় হ্যান্ডগান ঠেকিয়ে দেশ গড়তে কম্যুনিস্টদের খুব ভালো লাগে। মার্ক্স বলেছেন ধর্ম আফিম; বাস, আর কি? ভূত, ভগবান, পিশাচ, প্রেত, গণ সব লট কে লট ট্যাবুড। পোস্ট-লেকচার সময়ে পাখি পড়ানোর মতো করে শেখানো হতো মানুষের মুক্তি কিসে আছে। একবার কোথায় যেন, আজ আর মনে নেই, আমি বলেছিলাম, ভোগে আছে। আর যায় কোথায়, কেলিয়ে কদমফুল করে দিতে বাকী রেখেছিল। তাওঃ থামবি তুই? -এর উত্তরে আমি রিপিট করেছিলামঃ মানুষের মুক্তি ভোগে গেছে। মায়ের ভোগে। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, মায়ের ভোগে, মা কালীর দিব্যি এসবও নিষিদ্ধ উচ্চারণ, অপশব্দ হয়ে যাচ্ছিল কম্যুনিজমের গুঁতোয়, অনেক কষ্টে, মুক্তির(ও) মন্দির(ও) সোপান(ও) তলে অনেক প্রাণের, না, ঠিক প্রাণের নয়, ফ্লোতে লিখে ফেললাম, অনেক যুক্তি, তক্কো আর গপ্পোর বলিদানে বেঁচেছে। অর্থাৎ সব প্রশ্ন করা যেত, কিন্তু ‘কেন?’ জানতে চাইলেই অনিবার্য আসত যেটা, সেটা হলোঃ বানচোত, তুই রাবণ নাকি? মানে, ধড়ের ওপর একটা মুণ্ডু থাকলে ‘কেন’ পুছোনো যাবে না। এর পরেও আমায় বলতে হবে, সমাজতন্ত্র ইটসেলফ কালেক্টিভ ডিক্টেটরশিপ নয়!
যে কোনও ইস্যুতে লেফট ন্যারেটিভ শুনুন, ভীষণই মিষ্টি লাগবে শুনতে, কিন্তু ভুলেও সেটার বাস্তব প্রয়োগ চাইবেন না; আর একটা জিনিস চাইবেন না; - নিজের মত প্রকাশ করতে। লেফটিস্টরাই এস্ট্যাবলিশ করে ছেড়েছে সেই অমোঘ বাক্যঃ ‘ওপিনিয়ন? ওপিনিয়নস আর লাইক অ্যাসহোলস, এভরি বডি হ্যাজ ওয়ান, অ্যান্ড এভরি ওয়ান থিংকস আদার এলস’স স্টিংকস।’ অতএব, গুচ্ছের পোঙার গন্ধ ছড়িয়ে লাভ নেই, তাতে করে পোঙাই মারা যাবে, তার চেয়ে বেটার অপশন আমরা যে নিদান দিচ্ছি, সেটাই মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় জ্ঞানে মাথায় তুলে নাও এবং রাখো। গাড়লগুলো গণতন্ত্র শুনলেই ক্যাপিটালিস্ট জার্গন ভেবে এসেছে। কখনও ভুল করেও ভেবে দেখল না, কম্যুনিজমকে ডেমোক্র্যাসীর সঙ্গে টানলে কেমন হয়। হ্যাঁ, অবশ্যই একটা ক্রিটিক্যাল মিনিমাম শিক্ষা এবং বেসিক মিনিমাম ভালোবাসা তার জন্য লাগে। তা সলতে পাকানো বলে কোনও শব্দ কি নেই; সলতে কি আকাশ থেকে ঝরে পড়ে যেমন কিনা হিম বা উল্কা? মগজ ভরা ভয় থাকলে এমনই হয়, লাতিন আমেরিকা নাকি ভুল করেছে; রিভিসিনিস্ট মার্ক্সিজম তো সিন। যীশু না দিক, পোপে এসে পাপ দিয়ে যাবে। কিন্তু তারা সব কিংবা শব, অহিফেন! মনে পড়ে, মা-বাবার মুখে শুনেছি, তাদের কাকা-জ্যাঠা গোছের লোকেরা এই আপিংয়ের জন্য সাঁঝবাতি জ্বলে গেলেই কেমন লতপত করত। ভালো কথা, ওপরের সংলাপটা যে সিনেমার, সেটা কিন্তু হলিউডের।
ভাগ্যিস, সিনেমা প্রসঙ্গ উঠল আর আমি বুঝতে পারলাম কোন্ কথা থেকে কি কথায় এলাম! এসব আমি লিখতে চাই নি মোটেও; আমি তো, মাইরি বলছি, নিজের ফেলে আসা এক চিলতে দুঃখের ছোট্ট কথা বলতে চেয়েছিলাম। তাই বলে লিখতে লিখতে এতদূর! বাদ দ্যান, বাদ দ্যান দেহি স্যিউডো ভ্যানগার্ডদের যত ভ্যানতাড়া... তো দু – দুটো সিনেমাহল, যথাক্রমে অন্নপূর্ণা এবং রুম্পা। অন্নপূর্ণা সিনেমাহল ছোট, ভরাট গমগমে সাউন্ড, কিন্তু সেখানে বই, নাহ্, সিনেমা নয়, বই আসে সব ওঁচা, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, বৌদির বোন কৃষ্ণা, ঠাকুরপোর সে কি তৃষ্ণা, আর ঢপ দিস না – টাইপ, তাও কিনা আবার কোনও রিলিজ চ্যেনের হল নয়, চার-পাঁচ মাসের পুরোনো রদ্দি ছবি। এসবে আমাদের জল গরম হয়, বলুন? অঞ্জন চৌধুরীর চোখা চোখা সংলাপের অ্যাকশন ধর্মী ছবি (মানে, ওঁর বউ সিরিজ, গুরুদক্ষিণা ফালানা ফালানাগুলোকে গায়ে উঠে যাওয়া সরা পিঁপড়ের মতো আলতো টোকায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে) ছিল বেশ, মন্দ ছিল না সত্যি কথা লিখতে কি; তায় শ্রী রঞ্জিত মল্লিকের স্ট্যাকাটো – স্নাগল্ড আরটিক্যুলেশন, উফ, খিচুড়ি একদম জমে আব্-এ-জমজম। নাইট শোতে নবাব দেখতে গিয়ে, প্রবল গরমে জামা-টামা খুলে চা ছুঁড়ে দেওয়ার দৃশ্যকে সিটিতে, খিস্তিতে ভরিয়ে দিয়ে হাফ টাইমে আলো জ্বললে দেখি, সামনের সীটে ক্রাশ, তার মা’র সঙ্গে, জামা পরে নেব কি, একে অন্যের মুখ শুঁকছি, কোনো শ্লা ভর সন্ধ্যাবেলায় মাল-গাঁজা টেনে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছে কিনা, আর কোন্ আধলাচোদা নাইট শোতে বাংলা বই দেখার পিন খাইয়েছিল আমাদের, আমরা কিছুটা দেরীই হয়েছিল হলে ঢুকতে, ওই যাব কি যাব না ভেবে ভেবে চলেই গিয়েই কেত্তন, সাধে লোকে কবি-গীতিকারদের অচ্ছেদ্দা করতে বারণ করে!
সাউদার্ন সিনে সেন্ট্রাল ওই অন্নপূর্ণা হলেই রোববার সকালে হল ভাড়া করে আন্তর্জাতিক সিনেমা দেখাত; চার্লি চ্যাপলিনকে ওখানেই অনেকটা মেরেছি। বেশ কিছু সোভিয়েত দেশের, হাঙ্গেরির, ইরানের ছবি আসত, তাই বলে যুগোশ্লাভ বা চেক ছবি? আ বিগ নো নো। বড়ই খোলাখুলি ছবি বানায় তারা। তবুও প্রথম জিরি মেঞ্জেল এবং এমির কুস্তুরিকার ছবি একটা করে দেখা যেতে পারা গিয়েছিল; এবং প্রথমজনে জন্মানো মুগ্ধতা ছিলও অনেকদিন। তুলনায়, রুম্পা যখন ছায়াবাণী ছিল, তখন সেখানে উত্তম-সূচিত্রার পাশাপাশি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ধর্মেন্দরকেও নাকি দেখা যেত; তবে আমরা, আমাদের অক্ষরজ্ঞান হওয়া ইস্তক বাংলা ছবি চলতে বড় একটা দেখি নি। ইয়াব্বড় হল রুম্পা, এতটাই বড় যে, পিছনের দিকে সাউন্ড এসে পৌঁছয় না, থ্যাটার হলে নির্ঘাত লাউডার, লাউডার শোনা যেত; ধ্যাড়ধ্যাড়ে প্রোজেক্টর থেকে আলোও বেরোত না ভালো, এসব সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখলে কল্পনাশক্তি প্রচুর বাড়ে, প্লটের শুরুটুকু বুঝে নিয়ে ভেবে যাও আর ভেবে যাও, শেষে গিয়ে, ...অ্যান্ড দ্যে লিভড হ্যাপিলী এভার আফটার-এর ঠিক আগে উত্তরমালা দেখে আমি ভাবছিলাম, শুধু ভাবছিলামটাকে মিলিয়ে নাও।
আমাদের যৌবনের টগবগে টাট্টু দশায় রাজপুরীয়া রুম্পা সিনেমা হল কিন্তু মার্কেটের পালসটা কট করে ধরে ফেলল। একদম স্ন্যাপ ড্র্যাগনের মতো। আমরা দেখলাম ম্যাটিনি শোতে সাম্প্রতিক হিট বাংলা, ইভিনিং শো তে একটু আধটু যৌনতার ছিটে দেওয়া যতটা-পারা-যায়-কন্টেম্পোরারী হিন্দী ছবি, আর নাইটে মালয়ালম জওয়ানী সিরিজ। ইন্টারনেট এলে উত্তরকাল যাকে, ভালোবেসে, মাল্লু বলে ডেকেছে। তখন ছাদের ঘরে একলা পেলে বাংলা হিসেব বুঝতেও প্যান্টে হেগে ফেলি, ধন্যি সাহস ছিল বটে ব্যাটা হারবার্টের, আমাদের আপন বাপন চৌকি চাপন একলা রাতে জীবন যাপনই সম্বল, এফ টিভি তখনো আসে নি, পরবর্তীতে অবশ্য টিভি সিক্স আর রেন টিভি (আমাদের আদরের রেন্ডী টিভি) এসেছিল, সুতরাং রুম্পা সিনেমাহলই ছিল আমাদের লিবিডো আনলিশড।
কিন্তু হারামীর কপাল – সুখ বেশী দিন সইলে তো! হতোটা কি... শুক্রবার ছিল সিনেমা পাল্টে যাওয়ার দিন, বৃহস্পতিবার নাইট শো-ই ছিল এক্সিস্টিংয়ের অদ্যই শেষ রজনী। রুম্পা হলে কোনও সিনেমাকেই আমি, আমার স্মৃতি যদ্দুর যাচ্ছে, দু হপ্তা চলতে দেখি নি। রুম্পা সিনেমাহলের নাইট শোর যাদু যাদু যাদু কত যাদু’র উইন্ডো আমাদের উদ্দেশ্যে একটি সন্ধ্যার জন্য খুলত, একটু লাইটার নোটে বললে, দুটিবারের জন্য। সপ্তাহে। ফি শুক্কুরবার আর তার পরের দিন - শনিবার। তবে আমরা ঝুঁকতাম শুক্কুরবারে। সেদিন দাঁও মারতে পারলে ভালো, নইলে শনিবার, ট্যাঁক খসিয়ে ওপরের টিকিট কেটে, শো শুরু হওয়ার সামান্য পরে। কারণ হপ্তাভর জমিজিরেত, দোকানের হপ্তা এবং অন্যান্য তোলা তুলে, ইন্ডিভিজুয়াল ডিসপ্যিউট সামলিয়ে, কোন্খানে কংগ্রেস দলের চারাগাছ লতিয়ে উঠেছে মেপে নিয়ে এবং উপযুক্ত গ্লাইফোস্যেটের ব্যবস্থা করে, স্বীয় বাহিনীর সঠিক জায়গাতে ডেপ্লয়মেন্ট নিশ্চিত করে, ক্যাপিটালিস্ট মার্কিনদের বিরুদ্ধে সদা প্রস্তুত কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে, মহামতি লেনিন, মাও, হো চি মিন মারিয়ে অর্থাৎ সাম্যবাদী জনকল্যাণ করে এবং এই প্যাকড স্কেডিউলেরও মধ্যে ডাবরের শক্তি সূরা একদিনের জন্যও একদম না ভুলে, এল সি এসরা শনিবার এসে রিল্যাক্স করতেন রুম্পা হলের রাতের প্রদর্শনীতে। জেনে নিতেন আমেরিক্যান সফটক্যোর সিনেমা টানা হয়েছে নাকি মালয়ালম বই। আমেরিক্যান সফটক্যোর, অর্থাৎ একদম এক্স রেটেড; সেসময়, আমাদের ভাষায়, থ্রি এক্স, সফটক্যোর হলে, টু এক্স; না হলেও বেশ খোলামেলা দিল দরিয়া পরিচালকদের তৈরী সিনেমা হলে ‘পর তাঁরাও যার পর নাই খুশ; মন তাঁদেরও সাত সমুন্দর হয়ে যেত; আর মালয়ালম ছবি হলে মুশকিল, কেননা কে কার বাবা, ওটা নায়কের গার্লফ্রেন্ড নাকি বোন কিছুই বোঝা যেত না, সাবটাইটেলেরও বালাই নেই, সুতরাং আকূল কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যসমূহ কখন ধাঁ করে আবির্ভূত হবে, সেটা স্পেক্যুলেট করা খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে যেত। ইনসেস্ট নিয়ে মাল্লু ছবি ডিল করেছে কিনা - এটা একটা রিসার্চ ওয়র্কের টপিক হতে পারে। আমরা তো প্রদীপ, মহুয়া, আলেয়া প্রভৃতি কুখ্যাত হলে যারা আগে সিনেমাটাকে হজম করে নিয়েছে, তাদের মুখ থেকে শুনে নেওয়া পার্টি। এক উদাহরণ এই রকম, পাপ পেট কা বলে একটা ছবি, হিন্দী ডাবড ভার্সন, ওপেনিং নাইটের টিকিট কাটা কিন্তু আমরা বাইরে, আড্ডা মারছি, কারণ যা যা দেখার তাহা তাহা সবই ইন্টারমিশনের পরে। কিন্তু এল সি এস বা কচি নেতাদের বোধহয় সে সুযোগ হতো না, ফলতঃ প্রায়শঃ রুম্পা সিনেমা হলের সীটের একাধিক ব্যাকরেস্ট তিন রো এগিয়ে গিয়ে লটকে থাকত, ধুলোয় গড়াগড়ি যেত। অক্ষমতার আক্রোশ, আমি বামপন্থী দলের লোকাল কমিটি সেক্রেটারী, আমি বিধায়কের ভাই, আমি জোনাল কমিটির মেম্বার, আর আমার সামনে কিনা নায়িকা বেলাউজ খুলতে, শায়া তুলতে ছেনালী করছে। পর্দার মেয়েদের এই ককেটিশ আচরণ এবং হলের তাঁদের অক্ষম রাগ... ঠিক যেমন চারজোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলী লুটোয় পাপোষে, অনুরূপ লাথিগুলোর এক একটায় এক একটা ব্যাকরেস্ট উড়ে যেত; মেশিনম্যান হল মালিকের প্রাপ্য কৈফিয়ত তৈরী করতে করতে আগে থেকে কেটে পাশের প্রোজেক্টরে লোড করে রাখা মালয়ালম পর্ন চালিয়ে দিত। ওপর থেকে সেই আরামের দৃশ্য... হ্যাঁ, আমরা দেখেছি কয়েকবার। বস্তুতঃ সেই কারণেই আমরা, আমাদের দেখা ছবি হলে, মুখ লুকিয়ে শনিবার দেখতে যেতাম, হলের মধ্যে চলা সিনেমার জন্য; চেনা দিলে অবিশ্যি মার বাইরে পড়ত না একটাও। উপরি পাওনা ছিল এ কোণ, ও কোণ, সে কোণ থেকে উড়ে আসা কমেন্টগুলো। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা ধরে যেত, ব্যথা নিয়েই আমরা বাড়ী ফিরতাম। আর কমরেডরা বাড়ী ফিরে নেড়ে-ঝাঁকিয়ে সপ্তাহের ক্লান্তি থেকে মুক্ত হয়েই সমাজের চিন্তায় এতটাই মশগুল হয়ে পড়তেন যে, যদি সেই শুক্কুরবারের সিনেমা, যেগুলোর বেশীর ভাগ হলিউডের বি মুভি, একটু বেশী খুল্লাম খুল্লা হয়ে যেত, তো, সেগুলোর স্ক্রীনিং বন্ধ করার আদেশ দিয়ে দিতেন। সমাজ উচ্ছন্নে যাবে যে! এমনকি, সোনারপুর, রাজপুর... মানে, গড়িয়ার ব্রীজের পর থেকে হুই বারুইপুর পর্যন্ত সঅঅঅব পোস্টারের বিশেষ জায়গায় আলকাতরা! আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মাঝমধ্যে বলাবলিও করেছি ঘনিষ্ঠ জনেদের কাছে যে সারাটা বিকেল ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যের কালো হাতত্ (স্ট্রোক), ভেঙে দাওও্ (স্ট্রোক), গুঁড়িয়ে দাওও (স্ট্রোক) করে এসে সন্ধ্যায় সেই মার্কিন মেয়েতেই মজে গিয়ে রাতে সেই একই মার্কিন মেয়েকে ভয় পেয়ে যেতেন কী করে! কালেক্টিভ ডিক্টেটরশিপের ফল আউট কদ্দূর যেতে পারে, অ্যাঁ?
কিন্তু কী পেলেন তাঁরা? এখানে তাঁরা মানে সিপিআই(এম) দলের ডাকসাইটে, সিদ্ধান্ত নেওয়া নেতারা। কিন্তু এই প্রশ্ন তাঁদের নয়, এই প্রশ্ন আমায় তাড়িয়ে ফেরে। বাপ-কাকাদের মুখে শুনেছি এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ার প্রতিবাদে বেশ কয়েকটা ট্রাম পোড়ানোর কথা, নিজের অ্যাডোলেসেন্সে দেখেছি কম্পিউটারের তীব্র বিরোধিতা। আজ ট্রামের ভাড়া কত? ওহ, লিমিটেড কয়েকটা রুটে তো ট্রাম চলে এখন, আর এই লেখাটা আমি কাগজ কলমে নয়, কম্পিউটারে লিখছি, তার আগে একটা সিনেমার ব্লু রে ৭২০পি এনকোডিং করে নিয়ে এ আইকে জিজ্ঞাসা করে শিওর হয়ে নিচ্ছিলাম এক একটা স্প্যানিশ শব্দের অ্যাক্যুরেট ইংরেজী সিনোনিম কী কী হতে পারে, তার দেওয়া লিস্টি থেকে বেছে নিচ্ছিলাম; ইংরাজীতে কাষ্টোমাইজড সাবটাইটেল বানাচ্ছিলাম কিনা; তারও আগে বিভিন্ন দেশের সরকারী মেডিকেল সাইট থেকে পড়ছিলাম সেই ওষুধের সাইড এফেক্ট এবং আরও কিছু, যে নতুন ওষুধটা ডাক্তার মায়ের জন্য প্রেসক্রাইব করেছে।
আমার শৈশবের ছবি বলতে ষাট, না, তাও নয়, চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব, পড়ার সময় একশো ওয়াটেরটা জ্বালিয়ে দেওয়া হতো, মরা ছাগলের চোখের তারার মতো হলদেটে ফ্যাকাশে আমার শৈশবের রঙ, আমার রিক্রিয়েশন বলতে বই আর ব্যাটারির একটা রেডিও, ওই দেখুন হে প্রণম্য মহানেতাগণ, আমি রেডিওতে খেলা শুনছি, ইন্ডিয়া’স ট্যুর ইন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আমার এখানে যখন রাত দশটা, তখন ক্রিকেট খেলাটা হচ্ছে কী করে! দেখুন, আমি গ্লোব ঘোরাচ্ছি অর্থহীন, আমার ছটপটানি দেখে আমার ব্যাঙ্কার বাপ, তাস পিটিয়ে বাড়ী ফিরে ক্লান্ত মন-মাথায় তিন কেলাসে পড়া আমায় ল্যাট-লঙয়ের অঙ্ক শেখাতে শুরু করল।
আমার প্রথম যৌবনের রঙ মুছে নিয়েছিল আপনাদের ভাড়াটে সৈন্যরা। কিন্তু তার আগে বলুন তো, চারিদিকে ইতস্ততঃ গজিয়ে ভরে ওঠা ভিডিও ক্যাসেটের পার্লারগুলোয় এত মার্কিন পর্ন ভিডিও’র ক্যাসেট কোথা থেকে এসেছিল? কেন প্রহার সিনেমার মতো ছবিকে আপনারা বলেন নি এন সি ১৭ ট্যাগ মেরে বাজারে ছাড়তে, কেন ইউনিভার্সাল সার্টিফিকেট পেয়ে সেটা ইন্ডিয়ার মার্কেটে রিলিজ করেছিল? আজও জী সিনেমায় সকাল নেই, দুপুর নেই, সন্ধ্যে নেই সিনেমাটা স্ক্রীনড হয়। অমিতাভ বচ্চনের ইন্দ্রজীৎ... সেটার হালও এক।
আমার পিঙ্গল শৈশব, আমার নিবর্ণ যৌবন নিয়ে আমি যখন ভাঙা কোমরে কোনও মতে দাঁড়িয়ে উঠলাম, হে মহামহিম কমরেড, আমাদের জীবনে সব লাক্সারি গুডস বেকার হয়ে গেছে; শুধু বাইরে যাওয়ার আগে আমরা জেনে নিই, নিশ্চিত হয়ে নিই যে, হোটেলের রুম তো এসি বলে মেনশনড কিন্তু সেটা উইন্ডো এসি নয় তো? আর ওয়াই-ফাই ফাঙ্কশনাল কিনা। ঘুম থেকে যখন উঠি, তখন মোবাইল খুলে প্রথমে দেখে নিই, গুগল খুলছে কিনা।
এবার এই প্রৌঢ়কে বলুন, কৈফিয়ত দিন, কেন আপনাদের সহগমনকারী বিদেশী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে সমস্ত টেকনোলজিকে যখন অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, আপনারা হাত গুটিয়ে বসেছিলেন কোন্ যুক্তিতে? কেন আপনারা বিশ্বায়নের নামে একচেটিয়া ইউরোপায়ন হতে দিলেন! অথচ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ আর মিশন ড্রপ-আউট জিরো-র নামে ইংরেজী পড়তে দিলেন না? আবার উচ্চশিক্ষা বাংলায় করার জন্য কোনও উদ্যোগও আপনারা নেন নি! মাজাভাঙা বোবা প্রজন্ম তৈরী করতে চেয়েছিলেন, যারা ‘কেন’ শুধোবে না, তাই তো? মিসেস রবিনসন গানটার শেষ ভার্সটা শুনে নেবেন কমরেডস, আমার হয়ে মার-কিন (কিন টু ব্যাটার?) এক গায়ক জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেবে আপনাদের, নাম তার পল সাইমন। এনিওয়ে, যে ইস্যুগুলো ন্যাশানাল লেভেলের, সেখানে বিরোধী দল হিসেবে কোথায় এবং কী কী ছিল আপনাদের দাঁড়াবার জায়গা? যে মূল প্রশ্নের ভিত্তিতে সিপিআই থেকে আপনারা আলাদা হলেন, সেই আপনারাই কেন পরে পিপিপি মডেলের গলায় জয়মাল্য পরালেন? কেন সি এস আর শব্দটা এ রাজ্যে এলো? পাবলিক ওয়েলফেয়ারের রেস্পন্সিবিলিটি নেবে কর্পোরেটরা, যাঁদের আপনারা বুর্জোয়া বলে স্টিগমাটাইজ করে এসেছেন জীবনভর, তারা করবে সি এস আর আর স্টেট ছিঁড়বে? শুনে নিন কমরেডস, আপনারা হলেন সেই শ্রেণীশত্রু যারা ধর্মের ষাঁড় হয়ে একটা অচলাবস্থা তৈরী করে চলেছিলেন। আজ আপনাদের রক্তেই দেশ বেশী রেড হবে; এবং একেই কৃতকর্মের ফল বলে। আরও বলুন, আপনারা এক বগলে আলিমুদ্দীন, তত্ত্বের কচকচানি আর অন্য বগলে, এল সি এস নামের হুলিগানদের পুষে ভোটের খাত আপনারা পার হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যে মানুষগুলো বামপন্থায় বিশ্বাস রেখে মরে গেলো, আমাদের দেববাবু স্যারের মতো, তাদের মৃত বিশ্বাসকে কী করে আপনারা সম্মাননা দিতে পারেন? শুধু একটা রাজ্যকে ঘুণপোকায় খাইয়ে দেওয়া নয়, সেই রাজ্যের মানুষের কালেক্টিভ ফেইথকে আপনারা খুন করেছেন। এর দায় আপনারা না নিয়ে পালাতে পারবেন ভেবেছেন? আজ আপনাদেরই জন্য এই অসহনীয়, অপদার্থ, চোরেদের নিয়ে গড়া রাজ্য সরকারকে আমাদের ঝেলতে হচ্ছে।
হ্যাঁ, চুরি আপনারা করেন নি ঠিকই, চাকরি বিক্কিরি করেন নি ঠিকই, কিন্তু চিরকূটে চাকরি আপনাদের সময়েও হয়েছে। এমন দু-চারজনকে আমি চিনিও। তবে মরে গেলেও পয়েন্ট আউট করে দেবো না; কারণ সিম্পল, আমি খোঁচড় নই, আর যে ঘুষ খাইয়ে চিরকূট বার করেছে, কিংবা একটা মিয়্যার ফ্রেন্ডলি রিকোয়েস্টে, তার চাইতেও দোষ বেশী তাঁর, যিনি ঘুষটা খেয়েছেন বা রিকোয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করেছেন। এবং আমি তো কারো উপকারে আসতে পারি নি একটা জীবনে, আমার এবং অন্যের অবেলায়, সেই অন্যের অপকার করে আমার কোন্সা পুণ্যি হবে, বলুন। এক কাজ করুন না, আয়নার সামনে নগ্ন দাঁড়ান, আয়না মিথ্যে বলতে শেখে নি। আপনারা মিটার মেপে বর্ডার খুলে বাংলাদেশীদের ঢোকান নি, ভোটব্যাঙ্কের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে? আজ অশিক্ষিত একটা দল আপনাদেরই দেখানো পথ আরও কদর্যভাবে অনুকরণ করেছে; অশিক্ষিত তারা, ভুল তাদের নয়, ভুল আপনাদের, কারণ আপনাদের ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসকে অবশ্য আপনারা মূল্য ধরে শেষ নমস্কার জানিয়ে দিয়েছেন। আর তাই - তাই আমাদের দেখে যেতে হচ্ছে চাকরি চুরি, রোহিঙ্গাদের ডেকে ডেকে ঢোকানো, তাদের ফুল ব্লাড অফস্প্রিংস জ্ঞানে ভোটার, প্যান, আধার কার্ড করে দেওয়া। ঠিক করেছে অ্যাপেক্স কোর্ট, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি হিসেবে রিপ্যিইল করে দিয়ে। এই জিনিসগুলো আপনারাও করেছেন, পথের কাঁটা দূর করার সেই অমোঘ ট্যাকটিক্সঃ ভোটার কার্ডের লিস্ট থেকে প্রয়োজনীয় নামটাকে মুছে দেওয়া। একটা মানুষকে লোপাট করে দিয়েই আপনাদের পোষা হুলিগানেরা ক্ষান্ত হয় নি, তাদের অস্তিত্ব যে এই পৃথিবীতে কোনও দিন ছিল, সেইসব কথা ঝাড়ে-বংশে সাফ করে দিয়েছে।
আমরা আপনাদের আর চাই না, হয় আপনারা নতুন কাঠামোয় আসুন, রেজিমেন্টেশনের ভূত ঘাড় থেকে নামান, নতুবা, প্রত্যেক ভোটে বামপন্থার গাঁড়ে লাথের পর লাথই পড়তে থাকবে। হে রাজরাজেশ্বর, দেশ চালানো কেতাবে লেখা থাকে না; প্রতি মুহূর্তে তার রঙ বদলে যাচ্ছে, আপনারা তো সিঙ্ক শব্দটার মানেই জানেন না। এক রিম সাদা পাতা আপনাদের নামে প্রত্যেকের হাতে, যারা আপনাদের রাজকীয় আচরণে দেখেছে, ছেড়ে দিলে কালো কালো খুদি খুদি অক্ষরে আপনাদের বিরুদ্ধে কথাই লেখা হতে থাকবে শুধু। কী করবেন এত অভিযোগ নিয়ে? কোথায় কার কাছে খরচা করবেন?
ভাবুন কমরেডস, এই দেশের প্রেক্ষিতে মার্ক্সিজমকে সংশোধন করে, রিমাস্টার করে আনুন। যাতে আপনাদের পরিবর্তিত শ্লোগানগুলো ভালো শোনায়, ফাটা রেকর্ডের মতো নয়। কাটা কাটা উচ্চারণ করুন আপনাদের করণীয়সমূহকে। মনে করুন আপনাদের শেষ মুখ্যমন্ত্রীকে। তাঁর চোখজোড়াকে। সে আঁখিদ্বয় অনেক দূর দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু আপনারা সাথ দেন নি। এবার একমত, একপথ হয়ে আসুন। হুলিগান লাগবে না আপনাদের; আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ দিন বর্তমান রাজ্য সরকারের ভূমিকায় থাকা দলটিকে। তাঁদের সৌজন্যেই হয়তঃ আপনারা আর একবার সুযোগ পেতে চলেছেন, যেটা, প্রাপ্য ছিল না আপনাদের। আদৌ।
এখনো ধিক্কার আর করুণা পোষণ করি আপনাদের জন্য। পারলে, এই ঘৃণার রঙটাকে পাল্টান। আপনাদের থেকে যাওয়া সুনিশ্চিত হবে।
হাসতেই চেয়েছিলাম। ওমা, দেখি হাসির দমকে চমকে রক্তের ঝলক উঠছে। তারপর একটা সময় হাসির চাইতে কিংবা হাসি হয়ে রক্তই বেরোচ্ছিল বেশী। তারপর তো শীটলোডস অফ কালারিং শুরু হয়ে গেলো। একে কি আর থামানো যায়? বদরক্ত বার করে দেওয়া নিয়ে একটা প্রবাদ, ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, এখন আর ভালো মনে নেই।
~ অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ গুগল ইমেজেস ।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment