খুলিও কোর্তাজারের গল্পের একটা সংকলন আছে – উই লাভ গ্লেনডা সো মাচ; শিরোনামের গল্পের বাংলা অনুবাদের নামটা বেশ আমরা যারা গ্লেনডাকে খুব ভালবাসতুম।
এই নামটা ধার করলে কথাটা ম্যাডোনার উদ্দেশ্যেও বলা যায়, যে, আর আমরা বাংলার নব্বুইয়ের কিশোরেরা যারা ম্যাডোনাকে বড়ো ভালোবাসতুম। এই ম্যাডোনা মূলতঃ নায়িকা ম্যাডোনা। সেলুলয়েডের পর্দায় শরীরের আগুন দিয়ে যিনি গোটা অনেক কৈশোরকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন বারবার। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে না জানতে চেয়েও যেটুকু জেনে ফেলেছি অপরিসীম, বাছবিচারহীন যৌনতা তাঁর চারপাশকে ওলটপালট করে দিয়েছিল একটা সময়।
কিন্তু এখানেই সবকিছু শেষ নয়। ম্যাডোনার ডোন্ট ক্রাই ফর মী, আর্জেন্তিনা গানটা সবাই শুনেছেন। বোধহয় অনেকেরই কমবেশী ভালো লেগে থাকবে। এইধরনের গান যা মানুষের কথা বলে, মানুষের দুঃখের জন্য নেয় শোকের রঙ, যখন ম্যাডোনার রেন্ডিশনে আসে, তখন একটা কথা আমার মনে হয়, একটা স্পাইরাল পথে অর্থাৎ পাকদন্ডী বেয়ে এই ধরনের মানুষেরা সামিটে পৌঁছতে চাইছেন এবং এই কল বা র্যিজ সাবেক ক্লাইম্বারদের কল-র্যিজের থেকে হয়তঃ আলাদা। আলাদা এই কারণে, একটা বেঁচে থাকা, মানে, নশ্বরের বেঁচে থাকার আওতায় যা যা পড়ে, তার সবটুকু এঁরা ছেনে দেখেন, এমনভাবেই দেখেন যাতে প্রায় পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে হয়ে যায়। অতঃপর পড়ে থাকা মানসিক উচ্ছিষ্টাংশকে দুদ্দাড় ফেলে দিয়ে তাঁরা এগোতে থাকেন, কেননা তাঁরা বুঝে যান, এখানে তাঁদের অভীষ্ট তথা গন্তব্যের হদিশ রাখা নেই।
ম্যাডোনার এই গানটিও পপচার্ট-থ্রোন। রে অফ লাইট অ্যালবামের এই গানটিই ইউ এস পপচার্ট (বিলবোর্ড হট ১০০) তে ২ নম্বর জায়গাতে ছিল এবং ইউ কে সিঙ্গলস চার্টে ১ নম্বরে। দুটো ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, এক সঙ্কীর্ণমনা প্রেমিকের উদ্দেশ্যে এক উদারমনা প্রেমিকার নঞর্থক মাথা নাড়ার আক্ষেপের ব্যালাড এটি।
গানটা শুনে প্রথমেই একটা তুলনা মনে পড়ে। সর্বশ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান আছে, তুলনামূলক কম পরিচিত, ঘুম নেই কেন চোখে। যেটুকু সে গানের পরিচিতি, তার সবটাই প্রমের গান হিসেবে। তার শেষ ভার্সটা এইরকম –
আমি যাব তার কাছে
পায়ে পায়ে জড়ায়ে আঁধার যদি
মানা করে যেতে
চোখ থেকে সব আলো মুছে নিতে চায়
তবু আমি যাব
তার কাছে।
পৃথিবীর যে কোনও সংবিত্তি-সম্ভাষণকে ভেঙে দিলে, সার্থক ভাঙতে পারলে, ভগ্নাংশ থেকেও একটা অর্থ বেরোতে পারে, যেটা, মূল সংবিত্তি থেকে আলাদা হলেও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হয়ও বা মনে হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটা প্রেম বা ভালোবাসার গান কিনা, সে তর্কে আদৌ না গিয়ে যদি বলি, শেষ ভার্সকে আলাদা করে নিলে এটা একজন সাধকের প্রশান্ত প্রতিজ্ঞার কথা, তার আরাধ্যের প্রতি, খুব ভুল বোধহয় বলে ফেলব না। প্রশান্তি এইজন্য গন্তব্যে গিয়ে উঠলে অপার শান্তি আছে, প্রতিজ্ঞা এইজন্য প্রতিটি ফিল্ডেই কীলার ইন্সটিঙ্কট একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রত্যাশিত, কাঙ্ক্ষিত।
সাধক যাঁরা, তাঁরা কতখানি নিঃস্বার্থ আমার সন্দেহ আছে, সামগ্রিক বৈরাগ্য বা যা কিছু পার্থিব তার প্রতি বিমুখতা – এ যদি জাগে, তাহলে সিদ্ধিজাত অভ্রংলিহ পাহাড় মাপের ক্ষমতা দিয়ে কি করবেন তাঁরা! অথচ সিদ্ধির এই ক্ষমতা তাঁরা হ্লাদিত মন-মগজেই গ্রহণ করেন, আর আমরা তাঁদেরকেই মনে রাখি, যাঁরা এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে মানুষের জন্য যা কিছু শুভ, সেসবকে বাঁচান, অশুভকে প্রয়োজনে বিনাশ করেন। এইসব করেই পট করে ভালো মানুষের মতো মুখ করে গেয়ে ওঠেনঃ তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি। অর্থাৎ, মানুষের প্রতি তাঁদের সেই কিছু মায়া রয়ে গেলো ব্যাপার আর কি। পার্থিব সবকিছুকে ঠিক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে, তাঁরা বোধ করি, উঠতে পারেন না; এ প্রসঙ্গে শুধোলেই তাঁদের রেডি অ্যানসারঃ ভুলো না, দক্ষিণা কালী বদ্ধ হয়ে মায়া জালে। কিন্তু সিদ্ধির পথ সোজা নয়, অন্ততঃ চোখ যা দেখায়, শুধু সেটুকুই দেখে গেলে আর যাই হোক সাধক হওয়া যায় না। কেউ বলতেই পারেন, কবিও হওয়া যায় না। আমিও বলছি, যায় না তো, চোখের আলোয় চোখের বাহিরে যা যা, যতখানি এবং যেমন করে দেখার, অন্তরে, আঁধারে তাকে দেখা মানেই কিছু আলাদা দেখা এবং এই পৃথকতার মধ্যেই নিত্য যে উদার এবং সুখে দুখে অবিকার-এর ভূমা ধরা আছে। ‘ভরাও আছে’ বলা যায়; হৃদয় অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং টার-এর ভারে ভরভরন্ত; নশ্বর-মগজে সেই ঈশ্বর-ভূমা এঁটে যায়, গেলে ‘পর ধরাধামেই তাকে ধরাও যাবে। এবং ধরতে পারলেই জীবনটা অন্যরকম; - তখন আর বেলা এইটুকু বা ওইটুকু নয়, কোথাও কোনও খেলাই আর বেপরোয়া নয়, সেখানে কোনও নীতিকথা আর নেই। দোষ? - হেঃ হেঃ, দোষ কে কাকে দেবে, তখন সব কুছ দোষ কারো নয় গো মা। সাধে সাধকেরা সেই জীবনের জন্য গেয়ে ওঠেনঃ জিন্দেগী, আ রাহা হুঁ ম্যায়! কারণ সাধক আর সাধকের জীবন, পারষ্পরিক গিলা, শিকায়্যেত – যা-ই যতটুকু থাকুক না কেন, অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, সাধক তাঁর জীবনকে চুপি চুপি বলেই ফেলেন, ম্যায় ইয়ে একরার করতা হুঁ, ম্যায় তুঝসে প্যায়ার করতা হুঁ। কেন প্যায়ার করেন, সাধক? নাহ, এখানে প্রেম কিসে হয় কেউ কি জানে কোনও উত্তর নয়, এখানে সাধক জীবনটাকে তৈরী করেছেন, যে পুনঃনির্মাণের পিছনে আছে, চোখ যেটুকু দেখায়, তার চাইতে অনেক, অনেক বেশী কিছু নিজের অন্দরে দেখতে পাওয়া ও ফলতঃ, দেখা।
সুতরাং, সাধকের হৃদয়ের কপাট তখন খোলা। অহর্নিশ। তা সে বাহিরে ঝেঁপে বৃষ্টি আসুক বা না আসুক, তাঁর মনে পড়ে হয়তঃ হারিয়ে যাওয়া বালুচরে, তাঁদের ফেলে আসা বনভোজন আর ছেলেখেলা। তখন প্রয়োজন ছিল, পার্থিব যাঞ্চা ছিল, তখন পূর্ণ নিমজ্জন ছিল জাগতিক কাঙ্ক্ষায়। তখন হৃদয়ের, মগজের কপাট খোলা ছিল না। এখন কপাট খোলা, এখন অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে থাকার মতনই তাঁর জীবন। এখানে কাকে ঘেন্না করবে, কে কিসের জন্য খেদের খেউড় গাইবে! এখন আকাশছেঁচা জলে আজানুকেশ ভিজিয়ে নেওয়া কাউকে বাহিরে প্রত্যাশা করলে এবং না পেলে সাধকের অন্তরে মেঘ করে, ভারী ব্যাপক বৃষ্টি সাধকের বুকের ভিতর ঝরে।
বস্তুতঃ আরাধ্য প্রত্যাশায়। এই প্রত্যাশা নিয়ে তিনি অপেক্ষমাণ যে কবে সাধকের উপলব্ধিতে আসবে যে তিনি এবং সাধক পৃথক নন, তাঁরা অবিচ্ছিন্ন। তাঁর সাধনায় বসে সাধক, প্রকৃত প্রস্তাবে, নিজেরই সাধনা করছেন। সমপর্ণের যেটুকু, তার সবটুকুই সাধকের নিজের প্রতি নিজের। সমপর্ণের সবটুকু করে উঠতে পারা সাধকের ইচ্ছা এবং ক্ষমতা; সাধনার মূল চাবিকাঠি সাধকেরই হাতে; আরাধ্য এবং সাধক, এই দুইয়ের মধ্যে সাঁকোর কল্পধারী সাধক নিজেই। সাধক এ আনন্দযজ্ঞ, যেখানে কিনা কারোরই নিমন্ত্রণ নেই বিশেষ, কেনকি, পুজো হলো গিয়ে সর্বজনীন, অর্থাৎ মোচ্ছব, অর্থাৎ ছোটয়-বড়য় মিলে, আর সাধনা ব্যাপারটাই একার সঙ্গে একার, ফলতঃ নির্জনের; সুতরাং, এ আনন্দযজ্ঞের তিনিই হোতা, তিনিই ব্রহ্মা।
সাধনায় সিদ্ধি তথা সাফল্য যদি থাকে, কয়েনের আদার সাইড হিসাবে ব্যর্থতাও নিশ্চয় আছে। এখানে দোষারোপ করে কোনও ফায়দা নেই। অনেক ভুল-চ্যুতি হয় যা অজানিত এবং পারিপার্শ্বিক। সাধককে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তাঁর এই অযথা কষ্টের জন্য আরাধ্য ব্যথিত হন অবশ্যই, কিন্তু ন্যূনতম নিয়মের বাইরে তিনিও নন যে ছাড় দেবেন। কিন্তু তাপস যদি এই ব্যর্থতার জন্য আরাধ্যকে ছেড়ে যান, আরাধ্য চুরমার হয়ে যান। আরাধ্য প্রথমতঃ এবং শেষতঃ সাধকের সিদ্ধিই চান; চান একজন নশ্বর যেন তপশ্রী হতে পারেন।
আরাধ্যের প্রতি সাধকের যে টান, ভালোবাসা তাকে একটা গোটা আকাশ দিতে হবে ওড়ার জন্য। এবং এটিই সাধনার সবচেয়ে সহজ এবং কঠিন পথ; - তাপসের ঠিক সামনে তপস্যকে রাখা, একদম একই উপাদানের নির্মাণ হিসাবে। এটা আসে সেই বিশ্বাস থেকে যে, সাধক এবং আরাধ্য মূলতঃ অবিচ্ছেদ্য। আর যদি সেই ভালোবাসা উড়ান পায় পূর্ণ, সাধকের কোনও ক্লেশ-ক্লিন্নতাই আর দাহের নয়, নিতান্ত মামুলি ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায় সেটা, যেমন ঈষৎ দূরত্বের ওপারে আরাধ্য দাঁড়িয়ে আছেন।
...আর তখন সেই তাপসের এটা জানা হয়ে গেছে, ঐহিকের কি এপারে, কি ওপারে – সব একাঙ্গী।
You only see what your eyes want to see
How can life be what you want it to be?
You're frozen when your heart's not open
You're so consumed with how much you get
You waste your time with hate and regret
You're broken when your heart's not open
If I could melt your heart
We'd never be apart
Give yourself to me
You hold the key
Now there's no point in placing the blame
And you should know I suffer the same
If I lose you, my heart will be broken
Love is a bird, she needs to fly
Let all the hurt inside of you die
You're frozen, when your heart's not open
Song: Frozen.
Album: Ray of Light (1998)
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ ইউটিউব ।
ঋণঃ সব কথা তথা আখ্যানের সটীক ব্যাখ্যান দিতে পারে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য প্রমাণসহ, এমন নশ্বর কই? তাই এটিকেও আপন মনের মাধূরী-জাত কাল্পনিক আখ্যান হিসাবে পড়াই ভালো। প্রথমতঃ আমি কোনও সাধক-ফাধক নই। তবে কিঞ্চিৎ দেখেছি তাঁদের। আসলে-ভেজালে মিশেল প্রচুর সেথায়। দ্বিতীয়তঃ যাঁর গান নিয়ে এত তত্ত্বমসি, তিনি অক্সিদেন্তাল হওয়ায়, খাটনি তাঁর প্রচুর। তাঁর পুসি তাঁর ইচ্ছে বরাবর চলতে পারে কিন্তু সব ধ্যানধারণা তেনার পোষা পুষি নয়। তবুও... চেষ্টার জন্যও তো অভিনন্দন রাখা থাকে; একটা ল্যাংড়া, মানে ডিফারেন্টলি এবল কিশোর গায়ে-হতরে ছেলে-পুলেদের সঙ্গে দৌড়ে জিততে পারবে না ঠিকই কিন্তু অংশগ্রহণ করার সাহস যে সে দেখালো, তার কারনেও একটা প্রশংসা দিনের শেষে তার প্রাপ্য হয়েই যায়।
বাদবাকী রুটিন কথাগুলো বলে নিই - আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।