সাধের এই দেহটাও একমুঠো সাদা ছাই হবে, সবই তো পিছে পড়ে রবে, চুকে যাবে সময়ের যত হিসেব-নিকেশ - হয় না এরকম বিরল মাঝেমাঝে, যে, খুবই সাদামাটা কথা, মেঠো বললে যেটা একদমই এক্সাজ্যরেট করা হয় না, যেমন বলত, পাড়ার এক পা বাড়িয়ে রাখা বুড়োরা, বুড়ীরা, আগে, যাদের আমরা অনেকদিন আগেই পুড়িয়ে বিলীন করে দিয়ে এসেছি, যাদের কথাতে অনেক ভুল থাকত, এই যেমন, একটা শরীর পুড়লে কখনও সব ছাই সাদা হয় না, বস্তুতঃ হাড় পুড়ে ছাই হলে সাদা হয়, একেবারে শাদা যাকে বলে, কিন্তু মানুষের শরীর পোড়া, পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ছাইতে অনেক কালো আঙরাও থাকে; তবুও সেসব পুরোনো কথাগুলো তাদের বক্তব্যের সূচাগ্র তীক্ষ্ণতায় এতই অমোঘ, যে বিঁধে যায়; পুরোনো কথা নতুন করে ক্ষত তৈরী করে, করে যায় ও যাবে, স্মৃতি যতদিন। সে ক্ষত থেকে চিরকালের আঁশটানি গন্ধের রক্ত ঝরতে থাকে, যদিও দেখা যায় না, কেননা যার ঝরছে, সে ফিরিয়েছে মুখ, এখন সভ্যতা বড় প্রখর, বড় আলো চারিদিকে, মানুষের সব অনুভব, হয়তঃ যেটা হওয়ার কথা নয়, তবুও সবাইয়ের সামনে উদোম হয়ে যায়, তাই সে লালাভ অশ্রু লুকোতে মুখ লুকোয়। এই ভোর চারটে উনিশে আমার চোখে তেমন অশ্রু না থাক, সামনে উল্লম্ব ঝুলছে এক শ্মশানছবি, বিকেলের। সন্ধ্যের কুয়াশা নামছে। সেটা শীতকাল।
হয় কি, জানি না সবার হয় কিনা, একটার পর একটা পরতে পুরো জীবনের ফেলে আসা খাত ধরে রাখা আছে, প্রথম খাত খুললে মামার বাড়ীর পিছদুয়ার খুলে দিদি (দিদিমা), উনুন ধরাচ্ছে, এই ছবিটা না হয়ে অন্য যে কোনও একটা ছবি হতে পারত, যার রঙ ঈষৎ বিবর্ণ, হতেই পারত তখনও-অনেক-সবুজ এই তল্লাটে এক এগারো ক্লাসে পড়া কিশোর ফিরছে সাইকেল হাঁটাতে হাঁটাতে, স্কুল থেকে, কেননা, পাশে এক কিশোরী তার, সহপাঠিনী। তারা হাঁটছে কারণ সাইকেল চালিয়ে চলে গেলে ফিরতিপথ ফুরোবে তাড়াতাড়ি, আর সেটুকুকে টেনে মেলে দেওয়ার চেষ্টা শুধু, যতটা পারা যায় আর কি, তাদের মধ্যেকার স্বর, গল্প এসব কিছুই রাখা নেই সেখানে। শুধু ধ্বনিহীন চলচ্চিত্রের কিছু ফ্রেম মাত্র, তারা দুজন, তাদের মাঝখানে কিশোরের সাইকেল, কালো পিচের রাস্তায় ধুলোর ঘুর্ণি ফিনকি দিয়ে ছিটকে দুপাশে, তবে নীচুতে, আর সেখানে জংলা গাছের সবুজ। মাথার ওপরে কালশিটে পড়া আকাশ নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে, একটা সময় বিকেলের আলো পানসে মেরে যায়, নেমে আসে অকাল সাঁঝ, আকাশের নীল তখন ভোল পাল্টে খড়ির দাগের আঁজিতে ভরা স্লেট, ক্রমশই সেই স্লেটে জল-কাপড় বুলোতে থাকে আকাশ, আর এক ঝাঁক বক উড়ে যায়, ফিরে যায় বাসায়। অতঃপর ঝড় ওঠে, রাস্তায় ছোট ছোট ধুলোর আওড়গুলো বড় হয়, ঘিরে ফেলে কিশোর-কিশোরীকে, দু একটা ঝিলিকে আকাশে ফাট ধরে যায়, একটা সময় মুখরধারায় বৃষ্টি নেমে আসে, বৃষ্টির সে তীব্রতায় তারা দুজন বোধহয় মজাই পায়, ভিজতে থাকে টইটম্বুর।
এইসব রঙচটা ছবির প্রত্যেকটাতেই কিন্তু একটা করে হাইপারলিঙ্ক থাকে, সেখানে ক্লিক করলেই শ্মশানের বন্ধ ইলেক্ট্রিক ক্রিমেট্যরের সামনে রাখা চাঁচাড়ির আসনে শায়িত দিদি, অপেক্ষা কারণকি শান্তি পারাবার পেরোচ্ছে আগের মৃত। বাইরে বসন্তের বিষণ্ণ দুপুর। দিদির মুখ থেকে কি লালার একটা ছোট বুদবুদ বেরোয়? ঘন্টা সাত - আট আগে, যখন কিনা রাত গলে গলে মিশে যাচ্ছিল দিনে, তখনই তো দিদি শাশ্বত আলোর দিকে পাড়ি জমিয়েছে, তাহলে? সব তাহলের উত্তর হয় না, হতে নেই, বেঁচে থাকায় কিছু অজানা থাকুক, এই ভরসা দিয়ে এবং নিয়ে একটা অস্তিত্ব মুছে যেতে থাকে।
শীতের সন্ধ্যার শ্মশানে অবশ্য নীরবতা ছিল। মরচ্যুয়ারী র্যাপ ইদানীংয়ের শব্দ, সেই শব্দের ব্যাঞ্জনা গ্রহণ করেছে আর এক মৃত, তাকে পৃথিবীর গাড়ী শেষবারের মত চড়ান হয়ে গেছে, মড়া নিয়ে যাওয়া গাড়ীতে চড়ে সে ভ্রমণ অবশ্যই গৌরবের কিছু না, তারও শয়ান এখন চ্যাঁচাড়ির চাটাইতে, গাঢ় হলুদের গরিমার রঙ নিয়ে যে চক্কর কাটছে একটু দূরের সিমেন্টের ক্যিউবিক্লের ভিতর, সে তারই অপেক্ষায়। এই শ্মশান-সংস্করণের আলোকচিত্রের সবকটার ফোকাসে সে, তবুও তার শ্মশানবন্ধু নেই কোনও, তাকে যে ছাড়তে আসা হয়েছে!
আমিও পথের মত হারিয়ে যাব, আসব না ফিরে আর কোনদিন – মনে আছে, খুব ছোটবেলায়, তখনের স্মৃতি এখন আর নেই বিশেষ, আমিও পথের মত হারিয়ে যাব, আসব না ফিরে আর কোনদিন – গানটা শুনে নাকি বেধড়ক কাঁদতাম। বড় হয়ে স্বজন-মুখে যখন এটা শোনা ও হাসতে হাসতে মনে রাখা, তখন এ গান শোনা বন্ধ হয়ে গেছে। খুব সম্ভব, আসব না ফিরে আর কোনদিন - এই বাক্যবন্ধটা, কোনও স্বজনের চিরকেলে ফেরারী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ভেবে কাঁদিয়ে থাকবে, বা অন্য কিছু, যা আজ আর কোনওমতেই জানা সম্ভব না।
কিন্তু, আমিও সুখের মত ফুরিয়ে যাব? বড় হলাম, বুড়ো হলাম, কত তত্ত্বকথা পড়লাম, কিছু মন-মগজে ঢুকল, কিছু ঢুকল না, কিন্তু এই সার বুঝলাম, সব তত্ত্ব, কিসব সুন্দর সুন্দর গালভরা নাম তাদের, কত নতুন নতুন চিরে চৌ-চেরা করে ফেলা ধ্যান-ধারণা... কিন্তু সবের ওপর দিয়ে বহে যায় এক একটা ছোট গ্রাম্য, বলা যায়, দেহাতি কথা, তার কোনও আড়ম্বর নেই, কোনও আলটপকা, অনাবশ্যক আব্রু নেই, ঔদ্ধত্যের কোনও ছিটে-ফোঁটা নেই, বাড়তি কোনও বিনয় নেই, সে তার মত করে ঋজু, যেখানে কোনও দার্ঢ্য ঠাহরে না আসলেও তা আছে একাকী উদাস। কারণ কোনও ব্যাখ্যায় না গিয়ে সেগুলো আদতকথা বলে গেছে; আর যার গায়ে কোনও নাগরিক ঝালর নেই, গেঁয়ো ধূর্ততার উড়নি নেই, এমনকি সহজ সারল্যের বাহারি পাতার পোশাকও নেই; তার ওই হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, খড়ি ওঠা আদুল ধড়, মাথার চুলের এলোমেলো বিন্যাস। গেট মী অ্যাজ আয়্যাম, বলেই সে দম নেওয়ার জন্য পজটুকু দেয় নি, বলে গেছে যা, তা অনেকটা, হ্যাঁ, ওই গীতারই কাছাকাছি।
সুখ, যার যাতে, তা সে যত সামান্য বা যত খাঁইবাজ - যাই হোক না কেন, একদিন সুখ ফুরোয়, তাকে ফুরোতে হয়, নইলে যার সুখ, তার যাওয়ার পথ তৈরী হয় না। তাহলে দুঃখই চিরকালের? ধূস, সুখের উল্টো, একদম উল্টোপিঠে থাকায় দুঃখের ছোট-বড় খন্ডও, যার যেমন, গলে গিয়ে বেঁচে থাকায় মিশে যায়। বেঁচে থাকাও বিলীন হয়। এবং যেখানে বিলীন হয়, সেখান থেকেই অনন্তের জাগা শুরু। সে উদার সুখে-দুখে অবিকার।
সৎ লিখনে এইসব গানগুলো আমার নেহাত একটা-দুটো নয়; আর তারা নানান আরবান ফক্কিকারির মধ্যে আমার অন্দরে নিজস্ব বাজে। সেখানে আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, যদি থাকত, আমি সেসবকে কবেই প্রযুক্তির জলে চুবিয়ে সাম্প্রতিক করে দিতাম। আমি তো স্তোত্রগানে, এমনকি, রবীন্দ্রসঙ্গীতেও প্রযুক্তির পরিমিত ব্যবহারের পক্ষে। আপনারাই বলুন না, শঙ্কর মহাদেবনের শিবতান্ডব স্তোত্র আপনাদের খারাপ লেগেছে? অথচ প্রযুক্তির তো ঢালাও ব্যবহার হয়েছে সেখানে। আরে বস, তান্ডব হবে, অথচ শব্দ দাপাবে না, আওয়াজে ভরে উঠবে না চারপাশ! মেটালিকার দ্য ডে দ্যাট নেভার কামস বা পিঙ্ক ফ্লয়েডের কম্ফোর্টেবলি নাম্ব শুনে দেখুন, একই অনুভূতিই হবে বোধহয়।
কিন্তু দর্শন, সে নশ্বরের খাড়া করা হোক বা ঈশ্বরের, সে তো আসে তান্ডবের পর; নাহ্, বাণি সে দেয় না; সে কিছু একটা বলে দেয়। দিয়ে দাঁড়ায় না। আর আমরা সেটাকে এক্সপার্ট কমেন্ট হিসেবে নিই, নিই কেনকি, আমাদের তাজ্জব লাগে। সেসময় তার গা’য় আপনি আওয়াজের ঝপর চড়ান কিংবা বদলে মৃত্যু চেয়ে নেওয়া যায়, এমন নীরবতার ঘোমটা... তার গা’য় আসলে কিছুই ওঠে না, যেমনটি ছিল, সে ঠিক তেমনটিই থাকে।
ঘটনা হল, বহতা সত্যি বলছে সে, সভ্যতার ছাঁচ চেনাচ্ছে সে; - তার কিছুতেই কিছু যায় আসে না।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ গুগল ইমেজেস ।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment