হে ঈশ্বর, ক্ষমা রেখো, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি আজ শ্মশানপাড়ার ধার দিয়েও যাবো না।
২০২৫-শে নাগরিক জীবন মানে কি? আরও সাত-সতেরো হোয়াইট উডসের মাঝখান দিয়ে গুগল চেয়ে আছে হাই স্পীড সার্ফিংয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
আর? আর যখন নব্বইয়ের শেষের শুরু, তখন পাড়ায় পাড়ায় ল্যান্ড-লাইন ফোন ঢুকছে, বি এস এন এল, ছয় থেকে সাত ডিজিট হয়েছে গার্হস্থ্য ফোনের নম্বর। মোবাইলের দেখা কালেভদ্রে মেলে, কমান্ড তাদের সার্ভিস প্রোভাইডারের নাম। তো সেই ল্যান্ড-লাইন, ধরুন, মধ্যরাত। বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে গেলে আপনি ল্যান্ড-লাইনের সামনে, রিসিভার তুলে কানে দিলেই ডায়াল-টোনের একটানা, যেন একটা টান, যেন চোখের সামনে হাজার ভাগে ভেঙে যাচ্ছে রেল-ট্র্যাক, তারপর চলে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আপনি কীভাবে যেন জেনে গেছেন, এই রেলপথের প্রত্যেকটা যেখানে গিয়ে শেষ হবে, সেই আখরি ষ্টেশনের লোকটি আপনার মতোই রাতচরা। জেগে আছে সে অপরিচিত। আপনি ফোনের নম্বরটা ঠিক মতো মিলিয়ে উঠতে পারলেই বন্ধুত্ব; নতু্ন কিছু কথা, যা শুনতে আপনার মন চায়। হ্যাঁ, নব্বইয়ের দশকে অনেকে রাত জাগতো, অফিসে ঢোকা-বেরোনো মাপার বায়োমেট্রি, এইচ আর -এর চাপ, কর্পোরেটের লালচক্ষু - এসব তো ছিলো না তখন। মানুষ বেশ আনন্দিত হয়ে রাত জাগতো; কারোর কারোর বাড়ী থেকে তো ভেসে আসতো রেওয়াজী কন্ঠে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের চর্চ্চন, রাতের সুর মন্থনে বসে হাড়ে ও মজ্জায়, নারীকণ্ঠের নিভৃত বিষাদ আঁধারে জুড়ায়!
২০২৫ অন্যরকম। এখন সব কিছু ধাবমান। যারা যারা গতির সঙ্গে তাল ঠিক রেখে চলতে পারে নি, তারা তারা একে একে মাটি নিয়েছে। আর মাটি নিলে পর, তাদের মাটির তলাতেই ঘর করে শয়ান দেওয়া হয়েছে। এখন রাতচরাদের পেতে হলে আপনাকে নামতে হবে। রাতে। পথে। কি ভাবছেন, নামবেন? দেখবেন নিশা, এডিশন ২০২৫? তাহলে তো নিজেকে তৈরী করে নিতে হয়, অবশ্য বেশী সময় লাগে না তাতে; - প্রথমেই যেটা ধরার, ধরুন। রাত্রি। বেশ তো, মধ্যযামই ধরুন, না হয়। মানে, যেমন ধরলে আপনি একটা একার নির্জন নগর সড়ক পেয়ে যেতে পারেন, তেমন ধরুন। দেখবেন, রাত্রিরঙটা যেন থাকে। আর কিছু বৃষ্টি নিন, হয়ে যাওয়া বৃষ্টি। আর এতোকিছু নিয়ে নিতে পারলে, নিজের জন্য একটা লটারির ছাতাও বরাদ্দ করে নিন। বাস, আর কি, এ তো আর এঁদো মফঃস্বল নয় যে আকাশে চিড় ধরলেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাবে; অতএব, নিওনেশ্বর স্তিমিত চোখে স্থাণু, তাঁর নাগরিক আলোয় গাড়ীর শব্দ সব নতজানু। কালবৈশাখীর মেঘের দায়িত্ববোধ আছে, অনেক জায়গায় তাকে শীতলতা দিতে হয়; আপনার প্রাপ্য বৃষ্টিটুকু দিয়ে সে বাতাসের সঙ্গে সাঁট করে নিয়ে চলে গেছে নিজের পথ করে। নাগরিক হলেও সড়ক মানেই বসন্তের দাগ, যদি পিচের রাস্তা হয়, বৃষ্টির জমা জল বুঝিয়ে দিচ্ছে শহর-সরণীর শিরদাঁড়ায় ওটা জলবসন্তই ছিলো। রাস্তার ওপরে বিক্ষিপ্ত জল, চলন্ত গাড়ীর চাকা পড়ছে, চলকে উঠছে জল, চমকে ঠিকরে যাচ্ছে সেই জলে জমা নিওন আলোর জলছবি। একের পর এক অ্যাপার্টমেন্ট শুয়ে পড়ছে; কারোর কারোর তো কাল কাজের দিন, কালবৈশাখী যেমন ছুটির বিকেল-সন্ধ্যে গুণে আসে না, তেমনই এই শহরের সব চাকুরে তো আসন্ন শিক্ষক নয় যে এই পথেই জীবন, এই পথেই মরণ আমাদের, সব কিছু পথের বুকে গাইবে। আজ সে গান গাইবেন আপনি, আজকের জন্য ঘরের স্বপ্ন আপনার দেখে যেতে নেই।
নাহ্, আজ আমরা কোনো ঘাটে যাবো না। ওসব স্বেচ্ছাচারিতা হররোজ হয়, গরল প্রকৃত পানীয় কিনা কিংবা অমৃতেই বিষ আছে কিনা – এ নিয়ে তর্কের তুফান তুলে আমরা অন্যান্য দিনে রাতে মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়াই; আজ আমরা জীবনের দিকে যাবো। বাম দিকে যে তিনতলা বাড়ীটা ফেলে এলেন, খেয়াল করেছিলেন টঙয়ের ঘরে দরদরিয়ে আলো জ্বলছে? ডেস্কটপের সামনে যে ছেলেটা বসে আছে, আজ তার কোনও কাজ নেই, সিনেমা? – দেখার নেই, গান? – শোনার নেই, তবুও ডেস্কটপটা চালিয়ে রেখে উদাস, সে চেয়ারে বসে আছে। কিন্তু কেন? শুয়ে পড়লেই তো পারে। আমরা কি তার জাগরণের কারণ খুঁজবো? উঁহু, থাক, যে যেখানে যেমন আছে, সে সেখানে তেমন থাক, চলুন আমরা এগোতে থাকি। সামনে হাসপাতাল। আজ আমরা হাসপাতালের পিছদুয়ার দেখবো না, দোতলাটা দেখুন, কতো আলো, তাই না? কি ভাবছেন, সব্বাই ওখানে জেগে আছে? আরে দূর, ওখানে ঘুম-জাগরণ এক একজনের এক একরকম। হাসপাতাল যে দিকে থাকে, তার উল্টোদিকে কিছু পান, সিগারেট, চায়ের গুমটি থাকবেই। আছেও এবং তাদের প্রত্যেকের ঝাঁপ বন্ধ। রাস্তার গর্তগুলোতে জমা জলে কিন্তু এর মধ্যেই বিস্তর গাড়ীর কিংবা গাড়ীর বিস্তর তেল পড়ে গেছে, দেখবেন পরের গাড়ীর চাকা যেন গতির অহঙ্কারে তার খানিকটা আপনার গায়ে উগরিয়ে না দেয়।
এটাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন? সেই যে পাঁচতলার শপিং মল। বিদেশে শপিং মলের নিয়ম কি জানেন? – রাতে, বাড়ী ফিরে যাওয়ার সময় তারা প্রত্যেকে নিজের দোকানের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোটা জ্বালিয়ে রেখে চলে যায়। পাঁচতলার সমগ্র জুড়ে উৎসব জেগে থাকে। শরৎকালে, এ শহরে তো আমরা ইদানীং উৎশব বানান লিখি। সে যাক, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন রোশনাই ফেলে এলে অন্ধকারকে কেমন চেনা চেনা ঠেকে; নিজের হাতকে দেখেও রোমাঞ্চ হয়, যেন আর একটা হাত এ হাতে আসবে।
গাড়ীগুলোর ব্যাকলাইট খেয়াল করুন; আরে বস, এজন্যই তো রাতে শহরপথ। দেখুন সিগনালের রঙ, মার্কুইয়ের চোখ ঝলসানো তীব্রতা থেকে রঙ কেমন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে, সেটা যদি একবার ঠাহর করতে পারেন, তো আপসে বুঝে যাবেন বড়ো রাস্তা থেকে অভিমান করে আজ দুজনায় দুটি পথ ওগো যথা বেঁকে যাওয়া পাড়ার রাস্তার সোডিয়াম ভেপারগুলো খুলে রাখা টিনের মুড়ির মতো ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। থাক, যা কিছু মলিন, সবকিছুকে ঝেড়েঝুড়ে সাফসুতরো করে দেওয়ার কোনও দায় নেই আমাদের। নাহ্, এটা হাসপাতালের কোয়ার্টার নয়, এটা একটা মামুলি একটা ছ’তলা বাড়ী, আগে বিঘৎ শরিকি বাড়ী ছিলো ছোটো একটা পুকুর সমেত, অবশ্য খুব একটা কাছের দিনের কথা বলছি না ঠিকই, কিন্তু ছিলো তো একদিন। উত্তরে আছে হিমালয়, পশ্চিমে আলিয়া ভাট আর দক্ষিণে আই পি এল আর স্ট্যাম্পিড হয়ে যাওয়া মানুষের মুখের ছবি; কিন্তু পুকুর ভরাট? সে যত্রতত্র, যখনতখন।
আমাদের দেশের পতাকা তিন রঙয়ের; আচ্ছা যদি এটা ছয় রঙের হতো? ছ’টা আলাদা রঙ, কল্পনা করতে আপত্তি আছে? আপনার? রামধনুর রঙ পড়ে এলেন, প্রিজমের মধ্যে আলোর যাওয়া দেখে এলেন আর ছয়টা রঙয়ে আপত্তি জানালে চলবে? যদি ছ’টা রঙ ভাবতে পারেন এবং তেমনই যান, তাহলে, নীচের দিক থেকে দ্বিতীয়টাকে বর্ণহীন ভাবতে হবে আপনাকে; - তাকিয়ে দেখুন, এই ছ’তলা বাড়ী, তার প্রত্যেক ফ্লোরে আলো, শুধু দোতলা ছাড়া। ওই দোতলার তুলনায় এই আঁধারি-ঝরা রাস্তাটাও কতো উজ্জ্বল। ওই দোতলায় পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার জমাট বেঁধে থমকে আছে। অথচ কিছুদিন আগেও এমন ছিলো না, কিছুদিন আগেও দোতলাতে ছিলো স্বাভাবিক আলো, তার স্বাভাবিক রঙ; কিছুদিন আগেও মফঃস্বলের ইস্কুলে পড়াতে যাওয়া দোতলার ছেলেটার... নাহ, সংসার ছিলো না তার, বিয়েটা সেরে ফেলতে না পারলেও তার দীর্ঘদিনের কোর্টশিপ বটে, ছেলেটা প্রায় নামিয়েই এনেছিলো তার দয়িতাকে বউ হিসাবে, তখন তার স্বপ্ন কিনতে পারে এমন আমীর কই; আর এখন তার স্বপ্ন দেখার সে নয়নজোড়া যে কখন কোথায় হারালো সত্যিই কেউ তা জানে না; এখন তার নিশীথ শয়ানে জাগে আঁখি উদাসী। নাহ্, কোনো মিছিলে ধর্নায় তার যাওয়ার খবর শুনি নি আমি। হয় না - কিছু কিছু ঘটনা মানুষকে বেদম করে দেয়, জেরবার করে তোলে? চলুন, আমরা এগোতে থাকি। সামনে চৌমাথা, না হয় এক পেয়ালা করে চা-ই খাওয়া যাবে ‘খন।
কি সিগারেট ফেলে এসেছেন বাড়ীতে? কোনও চাপ নেই বস, আমার কাছে এনাফ আছে, আর সে আপনি যতই ব্র্যান্ডভক্ত ধোঁয়া খান হোন না কেন, আমার ব্র্যান্ডটা আপনার ভালো না লেগে যাবে না; তাও তো আপনাকে আমার প্রথম পছন্দটা আপনাকে অফার করতে পারছি না, প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্দেশ্যবিহীন, যেন অন্তবিহীন, কাটে না যেন আর বিরহেরও দিন, রাতের এই ঘোরাঘুরিতে আপনার জ্বালানীটুকু সরবরাহ করতে পেরে আমার নিজের ভালো লাগছে, যেমন ভালো লাগছে এইমাত্র আপনাকে টপকে চলে যাওয়া লরিটার ড্রাইভারের। আর খানিকক্ষণের মধ্যে লরির মাটি আনলোড হলেই সে খুশী, আজ রাতের মতো তার ছুটি মিলবে, তখন ধারেকাছের চেনা রেন্ডীপট্টির ঈষদুষ্ণ বিছানা, পেটভর্তি রুটি-গোশত আর গলা ভর্তি বাংলার পর কিছুটা ধ্বস্ত হলেও একটা গোটা নারী শরীর, চেনা, বা না-চেনা, আর তার খানিকক্ষণ পর, নিশ্চিন্তির ঘুম। আমার এক অনুজপ্রতিম বন্ধু সেদিন বলছিলো, এই বিদেশ-বিভুঁইয়ের মাটির সঙ্গে চলে আসছে নানান্ ভেন্যমাস সাপ, সেসব প্রজাতির তল্পিতল্পা যে এখানে একদমই ছিলো না – এমনটা নয়, কিন্তু ভৌগলিক অঞ্চলভেদের জন্য গঠনের, বিষের তফাত ছিলো। এই তো, চন্দ্রবোড়ার ভেঞ্জ যে কিছুটা পাল্টে গেছে এ আমার নিজের দেখা। বিষ? – স্পেশালিষ্টরা বলছেন, ভেনমেরও মিউটেশন হচ্ছে, সিঙ্গল অ্যান্টিভেনমের সাবেক ডোজে কাজ হচ্ছে না আর, ডায়ালিসিসের সংখ্যাও, নাকি, ভিক্টিমভেদে পাল্টে যাচ্ছে।
নাবাল চাষের জমি উঁচু করে বন কেটে বসত হচ্ছে। রিয়েল এস্টেট। আকাশের প্রায় কাছাকাছি ঠেলে ওঠা উঁচু উঁচু বাড়ীর দম্ভ, স্যুইমিং পুল, জাকুসি, বিউটি পার্লার, মাল্টিপ্লেক্স সিনেমাহল, নিজস্ব সব্জির বাজার, মাছ-মাংসের আড়ত, ক্রিকেটের, ফুটবলের জন্য আলাদা আলাদা মাঠ, পার্সেন্টেজ ধরে মাপা বিস্তীর্ণ সবুজ – কে বলবে বলুন দেখি, এই টাউনশিপের কার্পেটের নীচে একদিন কনকচাঁপা ধান, চম্পাবরণ ধান ছিলো, আমরা ভোরবেলা গাইতে গাইতে যেতাম আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া পড়েছে, আল দিয়ে কে গেছে কোথায় – জানি না, সবুজ ধানের শিষ যে কটি ঝরেছে, শিস দিয়ে কোন্ ময়না কি গায় – জানি না...
এখন তাহলে কি জানি? – এখন জানি, টাউনশিপের দোরগোড়ায় থাকে সিক্যিউরিটি সার্ভিসের লোক, কোনও প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন যে যে কারণে বলে তাদের রাখা হয়েছে, তেমন কোনও একটা প্রয়োজন সত্যিই কখনো এলে এদেরকেই আর যাই হোক, প্রথম অপ্রয়োজন বলে মনে হবে; সিসিটিভি, আর কিছুটা দূরে সংরক্ষণ করা গ্রাম, পোড়া মাটির ভাঙা ঘর। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার তত্ত্বকথা উঠেছিলো না একবার? – সেটারই প্রয়োগ চলছে।
সোজা এলেন? ভেবেছিলাম, ডানদিকে, নয় তো বামদিকে যাবেন। সোজা বড়ো একটা কেউ আসে না, জীবন যেমন আর কি। এদিকটায় আলোগুলো অদ্ভূত প্যাটার্ন ধরেছে, দলা দলা অন্ধকার আর সেই জট পাকানো অন্ধকার গিয়ে গিয়ে গলে যাচ্ছে আলোর ফোয়ারার সামনে। আলোর স্তুপ পেরিয়ে গেলে, অন্ধকার আবারও জমাট বাঁধছে। আলোর যেখানে জড়ো হয়ে ধুনকি তোলা, সেগুলো সব হোটেল। ভাবুন একবার, শহরের পশ্চিমে নদী, স্যিউয়েজ সিষ্টেম এমনই যে শহরটার ঊনপঞ্চাশ দিক থেকে নোংরা জল, কলুষ গিয়ে পড়বে সেই নদীতে, কারখানা... আহ্, কি প্রসঙ্গটাই না উঠলো! একটা শহর, যৌবনকালে ঠাঁই দিত দেশের হরেক কোণের চাকুরিপ্রার্থীদের, আর এখন, যখন কিনা তার বার্ধক্যদশা, দেশের কোণে কোণে পাড়ি জমায় এ শহরের মানুষ, উঞ্ছবৃত্তির সন্ধানে! মাইগ্রেটরি লেবারদের সংখ্যা ধরলে এ শহর এখন তালিকার টপার, এমনকি, প্রকৌশলী বিদ্যের জাহাজ ছেলে-মেয়েরাও এ শহরে থাকে না আর, এ শহর নাকি পয়সা দিতেই ভুলে গেছে, তারা দৌড়োয় বিদেশ এঁচে, বিদেশ ফস্কে গেলে এই দেশের অপরাপর শহর সব, কিন্তু এই শহর – নাহ্ কোনও মতে না। এ শহরের কি তাহলে কোনও গর্ব বেঁচে নেই? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে, হাঙ্গার ইনডেক্সের অন্যতম স্কাইস্ক্রেপার এই দেশের এই শহরে সবচেয়ে কম দামে পেটভর্তি মিল মেলে। হাইজিনিটি? – নাহ্, সেটাও একেবারে যে ফ্যালনা, তাও নয়। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? – আজ্ঞে, কিছুই দাঁড়ালো না, সব কে সব শুয়ে পড়লো, এই শহরের লোকেরা যেমন। এই মুহূর্তে যেমন। মাটি থেকে যা কিছু ফলে আসছে, এই শহর সবচেয়ে কম দাম পায় তার, তাদের প্রস্তুতিপর্বে যারা, সবচেয়ে কম উপার্জন করে তারাও; বস্তুতঃ নিজেদের টিঁকে থাকার তাড়ায় এরা শহরটাকে সবচেয়ে স্বস্তা করে রেখেছে, রাখতে বাধ্য হয়েছে। যে হাসপাতাল ফেলে এসেছেন প্রথমেই, আপনি কি ভাবেন এই শহরে বা এই শহরের ওপর ঠেস দিয়ে যারা বাঁচে, তারা ওই হাসপাতালের সার্ভিস পায়? ওটা কেনবার জিনিস মশাই, আর ওখানেই কান্না রাখা আছে, ওগুলোর কোনও কিছু স্বস্তা নয়। তাহলে যদি জিজ্ঞাসা করেন, সেই লোকগুলো কোথায় যায় যখন তারা অসুস্থ হয়, তাহলে আমায় এটা বলতে দিতে হবে যে তারা হলো গিয়ে এই শহরের নেশাড়ু ছেলে-পিলেদের মতো, তারা জানে হার্ট, লাঙ, লিভার – কোনও কিছু একবার বিগড়োলে, এই যে তাদের অ্যাকোরিয়ামের রঙীন মাছেদের মতো চলাফেরা, সব কিছু এক ঝটকায় থমকে থেমে স্থবির হয়ে যাবে, তবুও তারা নেশা করে, রোজ; এই শহরের ওই লোকগুলোও তেমন, তারা বেঁচে থাকে, বেঁচে যায়, রোজ, অথচ তারাও এটা জানে যে তাদের কিছু হলে তারাও শ্মশানে কিংবা কবরেই যাবে। গ্যালপ।
তো, নদী, স্যিউরেজ... কলুষ, শহরের, সেটা আপনি যেভাবেই হিসেব করেন না কেন, সবটাই গিয়ে পড়ে নদীতে, যে গুটিখানেক কল-কারখানার চাকা ঘোরে এখনো, তাদেরও বর্জ্য তরল গিয়ে মেশে ওই নদীতে, আচ্ছা, পশ্চিম মানেই কি শুধুই আবর্জনা? এ কূট তর্ক থাক, পূবেই বা কি আছে, এই হোটেলগুলোর একতলায় বার, রেস্টুরেন্ট... ঢালাও খাবার, মদ। গান-বাজনাও হয়। ক্যাবারে? – উমমম, বলতে পারেন, পরশ করে দেখো আমায়, রোমাঞ্চ জাগে কি, দূরে থেকো না... এভাবেই পূবের আহ্বানে কাছে আসে শহর, এসে হামলে পড়ে। আলোর গুমোর দেখলে আপনি দরজা খুলে আঁখিয়ো কি ঝরোকে সে একবার দেখে আসতেই পারেন।
ওকি, এবার চললেন কোথায়? হোটেল পত্তর যে সব শেষ হয়ে গেলো! এবার তো সামনে ময়লা ফেলার মাঠ, তার আগে ভুট্টা ক্ষেত। ময়লা ফেলার মাঠের পর পেয়ারা বাগান। জানেন তো, এই গোটা শহরকে পেয়ারা খাওয়ায় এই চত্বর। ভারী ওয়েলমেইড ক্যালকুলেশনে পেয়ার গাছের বুনন হয় এখানে। ইরিগেশনের খাল, যার সঙ্গে নাকি মিলমিশ আছে নোনা জলের খাঁড়ির, অন্ততঃ একটা সময় ছিলো তেমন, সেই খালকে বেড় দিয়ে দিয়ে গাছগুলোকে রোয়া হয়েছে। গাছগুলোর তলার মাটি তকতকে, প্রতিদিন কেউ এসে ঝেঁটিয়ে দিয়ে যায় রোজ, বিকেলের দিকে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলে। আর একটু বড়ো ছেলেরা গাঁজা খায়, আর সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে গেলে ছেলে-মেয়েদের জোড়া হারিয়ে যায় গ্রাম্য অন্ধকারের মধ্যে। কিছু পেয়ারা, ছোটোবেলায় দেখেছি বাইরে উত্তুঙ্গ সবুজ আর ভিতরে গহন লাল। আরে, এই দেখুন, কথায় কথায় তরমুজের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে তরমুজেরও ক্ষেত আছে অনেকগুলো। আর তার পরে, লিচু বাগান। পেয়ারা বাগানের গল্প লিচু বাগানে গেলেও একই, তবে কিনা আরও নিবিড়। তারপর আবার গ্রাম। মানুষের আটপৌরে বেঁচে থাকা যেখানে ঐশ্বর্যের ফিচেল হাসি নেই, সভ্যতার অহং নেই, কিন্তু অপেক্ষা আছে। তারা অপেক্ষায় কবে তারা শহরের আওতায় এসে যাবে, পাল্টে যাবে তাদের বেঁচে থাকা।
তাহলে এই শহরের পথে রাত জেগে আপনি কি বুঝলেন? - কেউই তার বেঁচে থাকা নিয়ে খুশী নয়, তাই তো? আরে, সেজন্যই তো এটা শহর। শহর সেটাই, যেটা আপনাকে সম্পূর্ণ তৃপ্তি কোনও দিন দেবে না, দিলে তো আপনি সব পেয়েছির দেশে চলে যাবেন। তৃপ্তির মধ্যে ঘুলে-ঘেঁটে মিশে থাকা কিছুটা অতৃপ্তি... নইলে, আপনি দৌড়বেন কেমন করে? আর আপনি না দৌড়লে শহরটা দৌড়বে কেমন করে, বলুন।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ গুগল ইমেজেস ।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment