Friday, August 1, 2025

আর আমরা যারা ম্যাডোনাকে এত ভালোবাসতুম

 

খুলিও কোর্তাজারের গল্পের একটা সংকলন আছে – উই লাভ গ্লেনডা সো মাচ; শিরোনামের গল্পের বাংলা অনুবাদের নামটা বেশ আমরা যারা গ্লেনডাকে খুব ভালবাসতুম।

 

এই নামটা ধার করলে কথাটা ম্যাডোনার উদ্দেশ্যেও বলা যায়, যে, আর আমরা বাংলার নব্বুইয়ের কিশোরেরা যারা ম্যাডোনাকে বড়ো ভালোবাসতুম। এই ম্যাডোনা মূলতঃ নায়িকা ম্যাডোনা। সেলুলয়েডের পর্দায় শরীরের আগুন দিয়ে যিনি গোটা অনেক কৈশোরকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন বারবার। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে না জানতে চেয়েও যেটুকু জেনে ফেলেছি অপরিসীম, বাছবিচারহীন যৌনতা তাঁর চারপাশকে ওলটপালট করে দিয়েছিল একটা সময়।

 

কিন্তু এখানেই সবকিছু শেষ নয়। ম্যাডোনার ডোন্ট ক্রাই ফর মী, আর্জেন্তিনা গানটা সবাই শুনেছেন। বোধহয় অনেকেরই কমবেশী ভালো লেগে থাকবে। এইধরনের গান যা মানুষের কথা বলে, মানুষের দুঃখের জন্য নেয় শোকের রঙ, যখন ম্যাডোনার রেন্ডিশনে আসে, তখন একটা কথা আমার মনে হয়, একটা স্পাইরাল পথে অর্থাৎ পাকদন্ডী বেয়ে এই ধরনের মানুষেরা সামিটে পৌঁছতে চাইছেন এবং এই কল বা র‍্যিজ সাবেক ক্লাইম্বারদের কল-র‍্যিজের থেকে হয়তঃ আলাদা। আলাদা এই কারণে, একটা বেঁচে থাকা, মানে, নশ্বরের বেঁচে থাকার আওতায় যা যা পড়ে, তার সবটুকু এঁরা ছেনে দেখেন, এমনভাবেই দেখেন যাতে প্রায় পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে হয়ে যায়। অতঃপর পড়ে থাকা মানসিক উচ্ছিষ্টাংশকে দুদ্দাড় ফেলে দিয়ে তাঁরা এগোতে থাকেন, কেননা তাঁরা বুঝে যান, এখানে তাঁদের অভীষ্ট তথা গন্তব্যের হদিশ রাখা নেই।

 

ম্যাডোনার এই গানটিও পপচার্ট-থ্রোন। রে অফ লাইট অ্যালবামের এই গানটিই ইউ এস পপচার্ট (বিলবোর্ড হট ১০০) তে ২ নম্বর জায়গাতে ছিল এবং ইউ কে সিঙ্গলস চার্টে ১ নম্বরে। দুটো ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, এক সঙ্কীর্ণমনা প্রেমিকের উদ্দেশ্যে এক উদারমনা প্রেমিকার নঞর্থক মাথা নাড়ার আক্ষেপের ব্যালাড এটি।

 

গানটা শুনে প্রথমেই একটা তুলনা মনে পড়ে। সর্বশ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান আছে, তুলনামূলক কম পরিচিত, ঘুম নেই কেন চোখে। যেটুকু সে গানের পরিচিতি, তার সবটাই প্রমের গান হিসেবে। তার শেষ ভার্সটা এইরকম –

আমি যাব তার কাছে

পায়ে পায়ে জড়ায়ে আঁধার যদি

মানা করে যেতে

চোখ থেকে সব আলো মুছে নিতে চায়

তবু আমি যাব

তার কাছে।

 

 

পৃথিবীর যে কোনও সংবিত্তি-সম্ভাষণকে ভেঙে দিলে, সার্থক ভাঙতে পারলে, ভগ্নাংশ থেকেও একটা অর্থ বেরোতে পারে, যেটা, মূল সংবিত্তি থেকে আলাদা হলেও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হয়ও বা মনে হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটা প্রেম বা ভালোবাসার গান কিনা, সে তর্কে আদৌ না গিয়ে যদি বলি, শেষ ভার্সকে আলাদা করে নিলে এটা একজন সাধকের প্রশান্ত প্রতিজ্ঞার কথা, তার আরাধ্যের প্রতি, খুব ভুল বোধহয় বলে ফেলব না। প্রশান্তি এইজন্য গন্তব্যে গিয়ে উঠলে অপার শান্তি আছে, প্রতিজ্ঞা এইজন্য প্রতিটি ফিল্ডেই কীলার ইন্সটিঙ্কট একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রত্যাশিত, কাঙ্ক্ষিত।

 

 

সাধক যাঁরা, তাঁরা কতখানি নিঃস্বার্থ আমার সন্দেহ আছে, সামগ্রিক বৈরাগ্য বা যা কিছু পার্থিব তার প্রতি বিমুখতা – এ যদি জাগে, তাহলে সিদ্ধিজাত অভ্রংলিহ পাহাড় মাপের ক্ষমতা দিয়ে কি করবেন তাঁরা! অথচ সিদ্ধির এই ক্ষমতা তাঁরা হ্লাদিত মন-মগজেই গ্রহণ করেন, আর আমরা তাঁদেরকেই মনে রাখি, যাঁরা এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে মানুষের জন্য যা কিছু শুভ, সেসবকে বাঁচান, অশুভকে প্রয়োজনে বিনাশ করেন। এইসব করেই পট করে ভালো মানুষের মতো মুখ করে গেয়ে ওঠেনঃ তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি। অর্থাৎ, মানুষের প্রতি তাঁদের সেই কিছু মায়া রয়ে গেলো ব্যাপার আর কি। পার্থিব সবকিছুকে ঠিক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে, তাঁরা বোধ করি, উঠতে পারেন না; এ প্রসঙ্গে শুধোলেই তাঁদের রেডি অ্যানসারঃ ভুলো না, দক্ষিণা কালী বদ্ধ হয়ে মায়া জালে। কিন্তু সিদ্ধির পথ সোজা নয়, অন্ততঃ চোখ যা দেখায়, শুধু সেটুকুই দেখে গেলে আর যাই হোক সাধক হওয়া যায় না। কেউ বলতেই পারেন, কবিও হওয়া যায় না। আমিও বলছি, যায় না তো, চোখের আলোয় চোখের বাহিরে যা যা, যতখানি এবং যেমন করে দেখার, অন্তরে, আঁধারে তাকে দেখা মানেই কিছু আলাদা দেখা এবং এই পৃথকতার মধ্যেই নিত্য যে উদার এবং সুখে দুখে অবিকার-এর ভূমা ধরা আছে। ‘ভরাও আছে’ বলা যায়; হৃদয় অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং টার-এর ভারে ভরভরন্ত; নশ্বর-মগজে সেই ঈশ্বর-ভূমা এঁটে যায়, গেলে ‘পর ধরাধামেই তাকে ধরাও যাবে। এবং ধরতে পারলেই জীবনটা অন্যরকম; - তখন আর বেলা এইটুকু বা ওইটুকু নয়, কোথাও কোনও খেলাই আর বেপরোয়া নয়, সেখানে কোনও নীতিকথা আর নেই। দোষ? - হেঃ হেঃ, দোষ কে কাকে দেবে, তখন সব কুছ দোষ কারো নয় গো মা। সাধে সাধকেরা সেই জীবনের জন্য গেয়ে ওঠেনঃ জিন্দেগী, আ রাহা হুঁ ম্যায়! কারণ সাধক আর সাধকের জীবন, পারষ্পরিক গিলা, শিকায়্যেত – যা-ই যতটুকু থাকুক না কেন, অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, সাধক তাঁর জীবনকে চুপি চুপি বলেই ফেলেন, ম্যায় ইয়ে একরার করতা হুঁ, ম্যায় তুঝসে প্যায়ার করতা হুঁ। কেন প্যায়ার করেন, সাধক? নাহ, এখানে প্রেম কিসে হয় কেউ কি জানে কোনও উত্তর নয়, এখানে সাধক জীবনটাকে তৈরী করেছেন, যে পুনঃনির্মাণের পিছনে আছে, চোখ যেটুকু দেখায়, তার চাইতে অনেক, অনেক বেশী কিছু নিজের অন্দরে দেখতে পাওয়া ও ফলতঃ, দেখা।

 

সুতরাং, সাধকের হৃদয়ের কপাট তখন খোলা। অহর্নিশ। তা সে বাহিরে ঝেঁপে বৃষ্টি আসুক বা না আসুক, তাঁর মনে পড়ে হয়তঃ হারিয়ে যাওয়া বালুচরে, তাঁদের ফেলে আসা বনভোজন আর ছেলেখেলা। তখন প্রয়োজন ছিল, পার্থিব যাঞ্চা ছিল, তখন পূর্ণ নিমজ্জন ছিল জাগতিক কাঙ্ক্ষায়। তখন হৃদয়ের, মগজের কপাট খোলা ছিল না। এখন কপাট খোলা, এখন অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে থাকার মতনই তাঁর জীবন। এখানে কাকে ঘেন্না করবে, কে কিসের জন্য খেদের খেউড় গাইবে! এখন আকাশছেঁচা জলে আজানুকেশ ভিজিয়ে নেওয়া কাউকে বাহিরে প্রত্যাশা করলে এবং না পেলে সাধকের অন্তরে মেঘ করে, ভারী ব্যাপক বৃষ্টি সাধকের বুকের ভিতর ঝরে।

 

বস্তুতঃ আরাধ্য প্রত্যাশায়। এই প্রত্যাশা নিয়ে তিনি অপেক্ষমাণ যে কবে সাধকের উপলব্ধিতে আসবে যে তিনি এবং সাধক পৃথক নন, তাঁরা অবিচ্ছিন্ন। তাঁর সাধনায় বসে সাধক, প্রকৃত প্রস্তাবে, নিজেরই সাধনা করছেন। সমপর্ণের যেটুকু, তার সবটুকুই সাধকের নিজের প্রতি নিজের। সমপর্ণের সবটুকু করে উঠতে পারা সাধকের ইচ্ছা এবং ক্ষমতা; সাধনার মূল চাবিকাঠি সাধকেরই হাতে; আরাধ্য এবং সাধক, এই দুইয়ের মধ্যে সাঁকোর কল্পধারী সাধক নিজেই। সাধক এ আনন্দযজ্ঞ, যেখানে কিনা কারোরই নিমন্ত্রণ নেই বিশেষ, কেনকি, পুজো হলো গিয়ে সর্বজনীন, অর্থাৎ মোচ্ছব, অর্থাৎ ছোটয়-বড়য় মিলে, আর সাধনা ব্যাপারটাই একার সঙ্গে একার, ফলতঃ নির্জনের; সুতরাং, এ আনন্দযজ্ঞের তিনিই হোতা, তিনিই ব্রহ্মা।

 

সাধনায় সিদ্ধি তথা সাফল্য যদি থাকে, কয়েনের আদার সাইড হিসাবে ব্যর্থতাও নিশ্চয় আছে। এখানে দোষারোপ করে কোনও ফায়দা নেই। অনেক ভুল-চ্যুতি হয় যা অজানিত এবং পারিপার্শ্বিক। সাধককে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তাঁর এই অযথা কষ্টের জন্য আরাধ্য ব্যথিত হন অবশ্যই, কিন্তু ন্যূনতম নিয়মের বাইরে তিনিও নন যে ছাড় দেবেন। কিন্তু তাপস যদি এই ব্যর্থতার জন্য আরাধ্যকে ছেড়ে যান, আরাধ্য চুরমার হয়ে যান। আরাধ্য প্রথমতঃ এবং শেষতঃ সাধকের সিদ্ধিই চান; চান একজন নশ্বর যেন তপশ্রী হতে পারেন।

 

আরাধ্যের প্রতি সাধকের যে টান, ভালোবাসা তাকে একটা গোটা আকাশ দিতে হবে ওড়ার জন্য। এবং এটিই সাধনার সবচেয়ে সহজ এবং কঠিন পথ; - তাপসের ঠিক সামনে তপস্যকে রাখা, একদম একই উপাদানের নির্মাণ হিসাবে। এটা আসে সেই বিশ্বাস থেকে যে, সাধক এবং আরাধ্য মূলতঃ অবিচ্ছেদ্য। আর যদি সেই ভালোবাসা উড়ান পায় পূর্ণ, সাধকের কোনও ক্লেশ-ক্লিন্নতাই আর দাহের নয়, নিতান্ত মামুলি ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায় সেটা, যেমন ঈষৎ দূরত্বের ওপারে আরাধ্য দাঁড়িয়ে আছেন।

 

...আর তখন সেই তাপসের এটা জানা হয়ে গেছে, ঐহিকের কি এপারে, কি ওপারে – সব একাঙ্গী।

 

 

You only see what your eyes want to see

How can life be what you want it to be?

You're frozen when your heart's not open

You're so consumed with how much you get

You waste your time with hate and regret

You're broken when your heart's not open


 If I could melt your heart 

We'd never be apart 

Give yourself to me 

You hold the key




Now there's no point in placing the blame 

And you should know I suffer the same 

If I lose you, my heart will be broken 

Love is a bird, she needs to fly 

Let all the hurt inside of you die

You're frozen, when your heart's not open

 

Song: Frozen.

Album: Ray of Light (1998)

 

 

 

 

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ    © 

 

 

ফটো কার্টসিঃ  ইউটিউব 


 

ঋণঃ সব কথা তথা আখ্যানের সটীক ব্যাখ্যান দিতে পারে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য প্রমাণসহ, এমন নশ্বর কই? তাই এটিকেও আপন মনের মাধূরী-জাত কাল্পনিক আখ্যান হিসাবে পড়াই ভালো। প্রথমতঃ আমি কোনও সাধক-ফাধক নই। তবে কিঞ্চিৎ দেখেছি তাঁদের। আসলে-ভেজালে মিশেল প্রচুর সেথায়। দ্বিতীয়তঃ যাঁর গান নিয়ে এত তত্ত্বমসি, তিনি অক্সিদেন্তাল হওয়ায়, খাটনি তাঁর প্রচুর। তাঁর পুসি তাঁর ইচ্ছে বরাবর চলতে পারে কিন্তু সব ধ্যানধারণা তেনার পোষা পুষি নয়। তবুও... চেষ্টার জন্যও তো অভিনন্দন রাখা থাকে; একটা ল্যাংড়া, মানে ডিফারেন্টলি এবল কিশোর গায়ে-হতরে ছেলে-পুলেদের সঙ্গে দৌড়ে জিততে পারবে না ঠিকই কিন্তু অংশগ্রহণ করার সাহস যে সে দেখালো, তার কারনেও একটা প্রশংসা দিনের শেষে তার প্রাপ্য হয়েই যায়। 

বাদবাকী রুটিন কথাগুলো বলে নিই - আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে

 

Sunday, June 15, 2025

অথঃ দুর্বাসা-কৃষ্ণ উবাচ

 

দুর্বাসা মুনি, নামটা শুনলেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, তিনি নেই, ঊনপঞ্চাশ দিকের কোথাও নেই, তবু যে কাজটা করছিলাম, তার প্রতি কনসেন্ট্রেশন বেড়ে যায়!

কাজটা শেষ হলে 'পর ধাঁধাঁ লাগে, শাস্ত্রমতে, ঈশ্বরসাধনার পথের কাঁটা, যদিও ব্যোমকেশ তো সেই ৭০ সালে চলে গেছে, তবুও প্রাজ্ঞজনেরা খুঁজে পেয়েছেন কাঁটাগুলোকে; আর কিছুই নয়, সেই বীভৎস বানচোত ষড়রিপু। আমি তার মধ্যে নিজের মতো করে একটা প্রায়োরেট্রাইজ করেছিলাম; কাম হলো গিয়ে সবচেয়ে খতরনাক, তারপর হচ্ছে গিয়ে লোভ... কিন্তু আমাকে অবাক করে, প্রাজ্ঞজনেরা বলেছিলেন, সবচেয়ে মারাত্মক রিপু হলো ক্রোধ।

আমার সেই কথাটা ঘ্যাঁচ করে মনে করলেই ক্ষোভ জাগে; ক্রোধের চলমান বিজ্ঞাপন হয়ে কিনা দুর্বাসা ঋষি মহর্ষি! ইয়ারকি পায়া হ্যায়?

স্থান, কাল, পাত্র দেখে একদিন ধাঁ করে প্রশ্নটা চড়িয়ে দিলাম। প্রশ্ন পেশের পর একটা গল্প শুনলাম, সেটাই আপনাদের বলি শুনুন; আরে ভাই, গপ্পো মনে করেই শুনুন না, আমি কি গলবস্ত্র হতে বলেছি!

 

...তো কৃষ্ণ তখন দ্বারকায় রয়েছেন, বুঝলেন। এমনসময় গৃহে গৃহে বার্তা রটি গেলো ক্রমে, যে, ওই যে, দুর্বাসা আসছেন। বাস, গব্বর সিং তো কাল কা যোগী, ধুমধাড়াক্কা সমস্ত দরজা জানলা, ভেন্টিলেটর, মানে যেখানে যা ফুটো ছিলো, সব বেধড়ক বন্ধ হয়ে গেলো। 

 

মূল নগরের মাঝমধ্যিখানে এসে মুন্যোত্তম ঈষৎ  ফাঁপরে পড়ে গেলেন। রাস্তা ভুল করে কোনো মৃত্যুপুরীতে এসে পড়েননি তো? কিন্তু তিনি দুর্বাসা মুনি, তাঁর এমত ভুল হবে? সন্দেহ নিরসনের জন্য কাঁধের ঝোলা থেকে স্মার্ট ফোনটা বের করলে, হ্যাঁ, এই গুগল ম্যাপ শো করছে, দ্বারকা। অবিশ্যি দ্বারকা না হলেও গুগল ম্যাপ দ্বারকাই ডিসপ্লেতে রাখত, দুর্বাসা খচে গিয়ে গুগলে কর্মরত সব্বাইকে শাপ দিয়ে দিলে সে ম্যাও সামলাবে কে! পরের স্টেপটা ফেলার আগে রোবোভয়েসটা অফ করে দিতে ভুললেন না মুনিবর। তিনি নিজেও বোঝেন না যে কখন তিনি, এক্স্যাক্টলি কি কারণে রেগে যাবেন। তারপর দ্বারকা নগরোর ল্যাজা, মুড়ো, পেটি, গাদা, দাগা, ব্রেস্ট পিস, লেগ পিস যেদিকেই ধান না কেন, সব খিড়কি বাতায়ন বন্ধ; ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দুর্বাসার মগজে সর্বাগ্রে এলো সেটা, সেই তিলেখচ্চর ক্রোধ। ব্যারিটোন বজায় রেখে, যতটা চেল্লানো যায়, ততটাই চিল্লে দুর্বাসা বলে উঠলেনঃ ও, আমি আসছি বলে সব আগে থেকে দরজা জানলা বন্ধ করে রেখেছে! এদিকে আ'য়্যাম গ'না বার্স্ট। আমার, আমার পিপাসায় ব্রহ্মতালু অবধি শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। আমি দশ গুনছি, এর মধ্যে যদি কোনো দ্বার না খোলে, তাহলে আমার অভিশাপে দ্বারকাবাসীদের লাইফ হেল হয়ে যাবে।

মুনিপ্রবরের কাউন্ট ডাউন শুরু হলো। সাত অবধি শুনে আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না বাসুদেব। এ তাঁর দায়; দরজা খুলে, হেঁটে তাপসসারের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে প্রত্যালীঢ় যেন বা, করজোড়ে বসলেন যখন, তখন দুর্বাসার চোখ বন্ধ, মুখ দিয়ে বেরোলোঃ তিন। তারপরই তিনি চোখ খুলে কৃষ্ণকে দেখতে পেয়েই প্রশমিত। বললেনঃ আরে কৃষ্ণ যে! তুমি দ্বারকায় রয়েছ দেখে বড়োই প্রীত হলাম।

কৃষ্ণ অবিকল সেই হাসিটা হাসলেন, যে হাসির জন্য বর্তমান মানচিত্রানুযায়ী উত্তর পশ্চিম ভারতবর্ষের সব মেয়েরা মরেছে; বললেনঃ হে ঋষি উত্তম, আমার অসীম সৌভাগ্য যে আপনি আজ দ্বারকায় পদঃরজ দিয়েছেন। কাইন্ডলি, সরি স্যার, আহ, হে ঋষিনাথ, অনুগ্রহ করে আমার গৃহে পদধূলি দিন। আমি ধন্য হই। দুর্বাসা খুশী মনে বললেনঃ চলো, তাই চলো। ভালো কথা, তুমি ওগুলো কি সব শব্দ বললে? কৃষ্ণ, বিগলিত স্বরে বললেনঃ আজ্ঞে ঋষিশ্রেষ্ঠ, আজ সকাল থেকে এই ভাষাটাকে মগজায়ন করার প্রয়াস পাচ্ছিলাম। কলিকালে যে দেশ এই দেশের মালিক হয়ে চড়ে বসবে, তাদের মাতৃভাষা এইটি। সহজ নয় বটে এই ভাষা। কৃষ্ণের কথাগুলো বলার সময় দুর্বাসা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন; এবার আয়ত নয়ন মেলে চাইলেন বাসুদেবের দিকে। এ কি দেখলাম কৃষ্ণ, সে বড়ো সুখের কথা নয়। হাঁটা বন্ধ না রেখে, মাধব বললেনঃ সে আর বলতে। কালের বিধান। খন্ডাবে কে, বলুন। দুর্বাসাও চেহারায় কম লম্বা-চওড়া নন, কৃষ্ণের পদঃক্ষেপের সঙ্গে তাল রেখেই বললেনঃ কিন্তু সে দেশ শাসন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তো দেখলাম এই ভারতবর্ষ, অবশ্য সে ভারত অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির, কিন্তু সেখানে তো শুধুই অন্ধকার। তোমাকে না আবার আসতে হয়। কৃষ্ণ এবার দাঁড়িয়ে পড়লেন, বললেনঃ নাহ, মুনিপ্রবর, তখন আমি আর সম্ভবামি হবো না। আমি ততদিন সম্ভবামি হতে পারি, দুস্কৃতামকে বিনাশ করতে পারি ততদিন, যতদিন তারা মানুষ। আপনি যাঁদের মনশ্চক্ষে এইমাত্র নয়নগোচর করলেন, তাঁরা কেউ মানব নয়, অবমানব। এদের বিনাশ আমার, এমনকি অনাদি হরেরও পক্ষেও অসম্ভব; কিছু কল্যাণ হতে পারে এক যদি মাতৃশক্তি অস্ত্রধারণ করেন। দুর্বাসা মুনি মুচকি হেসে বললেনঃ মহাদেবও পারবেন না, বলছো? বাসুদেব হাঁটতে হাঁটতে, তখন মাথার ওপরে চাঁদিফাটা রোদ, বললেনঃ দেখুন ঋষিবর, হর যদি ক্রোধান্বিত হন, তাহলে তিনি সর্বপাপহর। কিন্তু ধ্বংস দিয়ে। কিন্তু মুশকিলটা হলো নীলকন্ঠ আর রাগেন না। নাহ, ডম্বরুর বদলে অন্য কোনো নতুন বাদ্যযন্ত্র পেয়েছেন বা তন্ত্রের আরো সহজ কোনো পথ পেয়েছেন বলে নয়; নারী যব শঙ্কা ছোড় দেতি হ্যায় তো শংকর বন জাতি হ্যায় বলে সেই যে সেই কলকে আর ভাঙ পর্যায়ক্রমে চালাচ্ছেন তাতে মনে হয়না আর কিছু তিনি করবেন; মোরওভার, অ্যাতো ক্যানাবিস, অপিয়াম এদের সাইড এফেক্ট কিনা জানি না, কিন্তু এ আমি লক্ষ্য করেছি, তাঁর সদাশিব সাজ এবং দায়িত্বটাকে তিনি আমার মধ্যে পুরোপুরিই অর্পণ করে দিয়ে তিনি যেন দিনদিন আরো স্টুপর হয়ে যাচ্ছেন। একটা গ্রস উইথড্রয়াল ওনাকে পেড়ে ফেলছে। আমি একদিন অভিয়াদকে জিজ্ঞাসাই করে বসেছিলাম যে তিনি আমার মধ্যে সদাশিবের প্রোজেকশন কেন করতে গেলেন। আমি তো প্রতিপালক। দুর্বাসা দাঁড়িয়ে গেলেন, যেন মহা আমোদ পেয়েছেন এমন স্বরে জানতে চাইলেনঃ বটে? তা অনিকেত কি বললেন? কৃষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেনঃ কিই বা বলার আছে, কিন্তু তিনি মৃত্যুঞ্জয়, বললেন যে, প্রকৃত পালক তিনিই, যিনি পালন শেষে কোলে তুলে নিতে জানেন, মাতা যেমন জানেন, কখন সন্তানকে বক্ষের দুগ্ধ ছাড়াতে হবে। দুর্বাসা পরের কথাটা পাড়বার আগে, বেশ চওড়া হাসি হাসলেনঃ তা তুমি অবশ্য মেয়েদের বক্ষ্যাদি সম্পর্কে ভালো জানো। আচ্ছা কৃষ্ণ, তুমি একা অক্ষৌহিণী গোপিকার সঙ্গে রতিক্রীড়া করতে কি করে? মানে, আমি, ইয়ে জানতে চাইছি তুমি তো একা একজন মানুষ, ওতো কৃষ্ণ তৈরী হতো কি করে? এটা কি সেই কি যেন বলে ওরা, ল্যাটিন, গ্রীক আর আলেফ আর জার্মান শব্দ মিশিয়ে, কি যেন বেশ, ওহ হ্যাঁ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফাজিলজি, ক্লোন এসব হাবিজাবি জিনিস তুমি বোঝ? এক থেকে বহু কৃষ্ণে ছড়িয়ে যেতে কি এসবেরই ব্যবহার করো? কৃষ্ণ বললেনঃ নাহ, ঋষিপতি। আসলে এ রমণ, এ রতি সম্পূর্ণতঃ আত্মিক। দেহ নামক স্থুল জিনিসটাই নেই এখানে। আলোকবর্তিকাকে সামনে রেখে দাঁড়ালে পিছনের দেওয়ালে তো সে চেহারা বিম্বিত হয়। এই আত্মিক মিলনটা অনেকটা সেই রকম; আত্মার তেজরাশি থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো থেকে কুঞ্জবনে মৈথুনের ছায়াটুকু পড়ে। আর মানুষ সেটা দেখেই নারায়ণ দর্শন হয়েছে বলতে বলতে উন্মাদ হয়ে যায়। এ অনেকদিন চলবে; একদিকে মানুষ লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বায় সিম্যুলেটেড এমিসন অফ রেডিয়েশন দিয়ে আলো এবং শব্দের মাধ্যমে গল্প বলে কোটি কোটি টাকা কামাবে আর ঠিক একই জিনিস কুঞ্জবনে দেখলে আমার লীলা বললে মূর্চ্ছা যাবে। মাতারা জানেন, বোঝেন যে এবার তাঁর সন্তানের মায়ের দুধ পান শেষ করার সময় অবগত, তবুও তারা নেশা ছাড়তে পারে না বলে, মাতারাও, জেনে বুঝে দুগ্ধদান চালিয়ে যেতে থাকেন... দুর্বাসার চোখ, ভ্রু ঈষৎ কুঞ্চিত হলো, বাসুদেবকে থামিয়ে দিয়ে বললেনঃ মাতারা এখনো কিছুই জানেন না। মায়ের বক্ষে দুগ্ধ আসার আগে এক বর্ণহীন, স্বাধহীন, গন্ধহীন তরল আসে। কোলোস্ট্রাম নাম তার, সন্তানের জন্য এটিই অমূল্য। কিন্তু স্বর্গধামের আর বাকীরা? কৃষ্ণ বল্লেনঃ বিনায়ক পারতো, স্ব্যয়ং মাতৃশক্তি তার গুরু, কিন্তু সে ভীষণ উইজ্যেট-স্যাভি। আর এই পৃথিবীর ভবিষ্যত মানুষ কি বানাবে, বিশ্বকর্মার হেল্প নিয়ে সে অনেককিছু বানিয়েছে। সেখান থেকে সে নড়েই না। কেউ সিদ্ধি চাইলেই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ করে দিচ্ছে! দুর্বাসা সচরাচর এতো কথা বলেনও না, শোনেনও না। নেহাত বাসুদেব বলছিলেন বলে পরমশূন্যের প্রতি আস্থা রেখে শুনে যাচ্ছিলেন। বাসুদেবের কথা শেষ হতেই, লহমাপাতে কৈলাসটা একঝলক দেখে নিয়ে বললেনঃ হ্যাঁ কৃষ্ণ, বিনায়ক সম্পর্কে তুমি যা যা বললে সবই কর্কশ হলেও সত্যি। বিনাবিচারে সিদ্ধিদান একধরনের অনাচার। আমি বুঝি না, মাতা পার্বতী কেন কিছু বলেন না, তাঁর মানসপুত্রকে। তবে কার্তিক... কৃষ্ণ দুর্বাসাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, কার্তিক এখন কার্তিক নামটাই বর্জন করেছে, নিজেকে মুরুগান নামে নিজেকে অভিহিত করে। বিনায়কের প্রতি ওর অসূয়া যে অনপনেয় সেটা তখন বোঝা যায়নি, ঋষিরাজ। কার্তিককে আপনি হিসাবের বাইরে রাখতে পারেন। দুর্বাসা মুচকি হেসে বললেনঃ কিন্তু কান্নান, মাতৃশক্তি যদি আবির্ভুতা হন, তবে যে অনেক ব্লাডশেড আর গ্যোর হবে। কৃষ্ণ বলেই ফেললেনঃ মুনিবর আপনিও! দুর্বাসাকে হাসতে বড়ো একটা কেউ দেখেনি, কিন্তু, কৃষ্ণ তিনি, তাঁর কথা আলাদা। দুর্বাসা বললেনঃ ভীষণ বাওয়ালি হবে, কৃষ্ণ। জানি না, তুমি সেসব ঝেলতে পারবে কিনা। আর হর? হরের রাগটা এবং সেই সুতীব্র ক্ষমতাটা অনেকটা চিতাবাঘের মতো। তিন সেকেন্ডের বেশী থাকে না। অবশ্য জানি, ওই তিন সেকেন্ডই যথেষ্ট। কিন্তু... তাতে তো। কৃষ্ণ বললেনঃ জানি ঋষিশ্রী, কিন্তু সামলাতে না পারলে ধ্বংস ছাড়া আর উপায় কি। মাতৃশক্তি যদি রাজী হন তো ভালো; নইলে হরের সঙ্গে আমিও থাকবো, পরমশূন্যের মধ্যে বিলীন করে দেবো। দিতে হবে, এদের মূল্য বোধ অ্যাতোটাই পচে গেছে যে... দুর্বাসা কথা কেড়ে নিয়ে বললেনঃ মূল্যবোধ? আরে, তুমি জানো, তোমার প্রেম পর্যায় নিয়ে এরা গান বাঁধবেঃ কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা।  ভাবতে পারছো, কৃষ্ণ, তোমার প্রেমটা যে আত্মিক, আদপে দৈহিক নয়, সেটাই এরা বুঝবে না! কৃষ্ণ প্রথমে একটু লাজুকঃ এমা, ঋষিরাজ, আপনিও আমার, ধ্যেৎ, কি করেছি যৌবনে... পরে সটান বললেনঃ এরা আত্মিক ব্যাপারটাকেই ধারণ করতে পারবে না, মুনিবর। এক আত্মা যে বহুতে বিকীর্ণ হতে পারে, সেটাই এরা, এদের ভাষায়, ফিগার আউট করতে পারবে না। দুর্বাসা এবার বললেনঃ এরা একটা জিনিস তৈরী করবে, পর্নোগ্রাফি। পর্ণতে পংক্তি যৌনতা দেখানো হবে, ওরা বলবে গ্যাং ব্যাং। কিন্তু আত্মিক মিলন দিয়ে যে উৎকৃষ্ট মনুষ্য যোনি অপিচ উৎকৃষ্ট মানবের জন্ম দেওয়া যায়, সেটাই জানবে না, বুঝবে না এরা। চলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময়েই তাঁরা কৃষ্ণের প্রাসাদের মূল তোরণের সামনে। কৃষ্ণ তোরণ ঠেলতে যাবেন, দুর্বাসা বললেনঃ তোমার নগরবাসীরা সব আমার জন্য অর্গল বন্ধ করে আছে? কৃষ্ণ, তোরণ তাঁর খোলা হয়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে, স্মিত হাসলেন, যে হাসিতে বিশ্বপ্রপঞ্চ নত হয়, সেই হাসি, তারপর বললেনঃ শুধু অর্গল বন্ধ করে বসে নেই মহাত্মা, এরা আপনার ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। আসুন। দুর্বাসা ঢুকতে ঢুকতে বললেনঃ সবাই আমার শাপের ভয়ে মরলো। আমার অভিশাপ ওপরে ওপরে; নীচে তার যে সৃস্টির কল্যাণ বহমান সেটা কেউ তলিয়ে ভাবলো না! 

 

ঘরে ঢুকেই দুর্বাসার রূপ পাল্টে গেলো। জলদগম্ভীর স্বরে তিনি বললেনঃ শোনো কৃষ্ণ, আমি এই দ্বারকায় কিছু প্রয়োজনে কয়েকদিন থাকবো বলে স্থির করেছি। তুমি কি আমায় অতিথি হিসাবে বরণ করতে প্রস্তুত? কৃষ্ণ হ্যাঁ বলার আগেই, দুর্বাসা মুনি ফের বললেনঃ কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। আমার যখন যে খাদ্য, যে পানীয় গ্রহণ করতে আগ্রহ জাগবে, আমায় যত শীঘ্র সম্ভব, সেগুলোই পরিবেশন করতে হবে। এছাড়াও, আমি ইতোমধ্যেই তোমাকে বলেছি যে, আমি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছি। আমি আমার যখন প্রয়োজন তখন বেরোব, যখন খুশী তখন ঢুকবো, এবং এইসব ব্যাপারে আমায় কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। এবার বলো, তুমি কি অতিথি সৎকারে প্রস্তুত? কৃষ্ণ অরবে শুনতে শুনতে হাসছিলেন অলক্ষ্যে, দুর্বাসার। দেব প্রতিম এই মুনি এক্কেবারে এক, এমনকি বক্তব্য পেশ করার ভাষাও, কথা বলেছিলেন কুন্তী-পিতাকে। শুধুমাত্র কুন্তী পারবেন, এই আশা বুকে বেঁধে, অবিকল কাঁচুলির মতন, নরপতি শূরসেন দুর্বাসা মুনিকে থাকতে দিয়েছিলেন। তার পরের চার কৌন্তেয়র গল্প। কৃষ্ণ তখনো হস্তিনাপুর যাননি, নামগুলোই শুনেছেন শুধু, কারোর মুখ চেনেন না; কিন্তু এদিকে দুর্বাসা মুনি, তাঁর অভিপ্রায়ে অসম্মতি জানালেও শাপ, আবার মেনে নিলে, কোথাও কোনো সামান্য চ্যুতি হলেও শাপ। লোকটা সত্যিই সরেস, আসতে কাটে, যেতেও কাটে। মুখে বললেনঃ তাঁর সর্বশর্ত মেনে নিয়ে আসন্ন অতিথি সৎকারে তিনি যে শুধু প্রস্তুত, তা নয়, উন্মুখও বটে। দুর্বাসা ঋষিকে তাঁর লিভিং রুম, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম, ওয়াশ রুম দেখিয়ে, তাঁকে বিবিধ ব-কাল যোগে তৈরী শরবৎ আর যৎসামান্য মিস্টান্ন দিয়ে, বলেও দিলেন, বেশী মিস্টান্ন দিলে তাঁর দ্বিপ্রাহরিক ক্ষুধা নষ্ট হবে, এবং লাঞ্চে কি খেতে তাঁর সাধ যায় জেনে নিয়ে, তিনি পাকশালে গিয়ে প্রথমেই দুজনকে পাঠালেন ব্ল্যাক পমফ্রেট আনার জন্য, দুজনকে বললেন একদম কচি পাঁঠর মাংস আনার জন্য, অতঃপর দুজনকে বললেন সরু কিন্তু সিদ্ধচালের ভাত, পূর্বীরা যেমন খায় তেমনটি রাঁধার জন্য কারণ হিমালয়ের ফল মূল খেয়ে তৈরী হওয়া শরীর দুর্বাসার, লুজ মোশন শুরু হলে দেখবেটা কে'র থেকেও বড়ো কথা হলো অভিশাপটাও সেই এক্সটেন্ট আর ম্যাগ্নিটিউডেরই (শেষোক্ত উচ্চারণ আবার আগামীতে শাসন করতে আসা দেশের লোকেদের নয়, তাদের ম্লেচ্ছাচারের ফল হিসাবে তৈরী হওয়া আর এক দেশের) হবে, সেটা সামলাবে কে; কৃষ্ণ তো জানেন এবং মনকে প্রস্তুতও করছিলেন হস্তিনাপুর যাওয়ার জন্য, বাবার আর্যক শূর কথা মনে পড়ছিলো তাঁর বাই হুক অর ক্রুক, ধর্মরাজ্য স্থাপন করে দিয়ে আসতেই হবে সেখানে, যে কোনও ছল, যে কোনও চাতুরী সব, সব অ্যাডমিসেবল সেই কারণে, চটকা ভাঙতেই, কৃষ্ণ আর দু'জনকে ধরলেন, বললেনঃ একদম পূর্বীদের মতো হিমশীতল মিষ্টি দই তৈরী করো। এটাতেই তিনি মুনিবরের অ্যাটেনশন এবং স্যাটিসফেকশন দুইই মেরে দেবেন জানতেন; কেননা প্রথম দিন দুর্বাসা, কৃষ্ণের পছন্দের আমিষ  আহার গ্রহণ করার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। প্রেফারেন্স রিভিল্ড, কৃষ্ণ মিষ্টির ভ্যারিয়েশন বাদে পদ বেশী বাড়াননি। কোনো ডিশই যেন বেশী স্পাইসি না হয়, সেই শেষ নির্দেশ দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি, পথিমধ্যে থমকে গিয়ে দুর্বাসার স্নানের জন্য সবকিছু যেন প্রস্তুত থাকে, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিলেন। গরমের দুপুর এসে গেছে, তাঁর নিজের শরীরটাও জল চাইছিলো। অফুরন্ত জল।

 

দুর্বাসা ঋষি আহারে বসেই একটু নাক কুঁচকালেন, তারপর মিঠে হেসে, সব কটা পদ তারিয়ে তারিয়ে খেলেন; - ষ্টাফড ব্ল্যাক পমফ্রেট, পূর্বীদের কাছ থেকে শেখা সর্ষে দিয়ে ঝাল, কচি পাঁঠার পাতলা ঝোল সামান্য আলু দিয়ে, কাঁচা মিঠে অম্বলের পর, দইতে এসে বাহ্যজ্ঞান লোপ পেলো তাঁর, অন্যান্য সব মিষ্টিকে না বলে হিমশীতল দধিতে এসে তিনি প্রায় সমাধিস্থ হওয়ার জোগাড়। কৃষ্ণ হাতের ইশারায় জানিয়ে দিলেন, প্রতিদিন এই দধি যেন অফুরান বরাদ্দ থাকে তাঁর জন্য। খাওয়া শেষ করে একটা কিং সাইজের বার্পিং করে, দুর্বাসা ঘরোয়া স্বরে হাঁকলেনঃ কৃষ্ণ? কৃষ্ণ সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেনঃ আদেশ করুন, মুনিপতি। দুর্বাসা বললেনঃ এই রন্ধনের বেশীর ভাগটাই তো পূর্বীদের কাছ থেকে নেওয়া, তাই না? কৃষ্ণ বললেনঃ যথার্থ, মুনিবর। দুর্বাসা বললেনঃ মাংসে পিঁয়াজের গন্ধটা সামান্য নাকে লাগলো। আসলে অভ্যাস তো তেমন নেই। তোমার তো সবই জানা। কিন্তু বাকী রান্নাগুলো? - অসামান্য স্বর্গীয় স্বাদের। যাকে ওই পূর্বীদের উত্তরসূরিরা একদিন বলবেঃ ফ্যাবিউল্যশ, ডিলিইশ্যস। কে জানে, আমি আবার সবার খাওয়া খেয়ে ফেললাম না তো? মুনি-ঋষিদের নিয়ে এই এক বাওয়ালি। কৃষ্ণ মধুর হেসে, তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেনঃ আপনি বিশ্রাম নিন, ঋষি প্রবর। আজ আপনার গুরুপাক হয়েছে। দুর্বাসা আবারও হাসলেন। এই নিয়ে তিনবার; আর কৃষ্ণের চোখে পড়লো, তাঁর হাসি ক্রমশঃ চওড়া হচ্ছে। 

 

দিন যায়। কৃষ্ণ লক্ষ্য করেছিলেন, দুর্বাসার চাহিদা খুব বেশী নয়। খালি মিষ্টি দধি পেলেই যেন তিনি পরমপ্রীত। বাদবাকী প্রেফারেন্স যা, সবই শাকান্নের দিকে। কোনোদিন একটু সোনামুগের ডাল। কৃষ্ণ ভালো-মন্দ সব খাদ্যের লোভ দেখালেও তিনি নিজের জায়গা থেকে নড়েন না; একদিন বলেই ফেললেনঃ কৃষ্ণ, তুমি যতই লোভ দেখাও না কেন, আমি যে ঋষি, সেটা প্লীজ ভুলো না।

 

তা একদিন, তখন সায়াহ্ন, দুপুরের দিকে বৃষ্টির নামে জলছড়া দিয়ে আকাশ সেসময় তকতকে, এক অলীক সুন্দর গোধূলি তৈরী হচ্ছে। দুর্বাসা ঋষি তার হাঁটার গতি বাড়ালেন। কিছুক্ষণ পর তিনি যখন দ্বারকা নগরের টেরিট্যরিতে ঢুকে এসেছেন, শুনতে পেলেন অস্ফুট এক ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। বামাকন্ঠে। কৌতুহলী তিনি সে গৃহের অন্দরে পা রাখলেন; বিশেষ কেউ নেই বারান্দায়; সুতরাং সেই তাঁকে হাঁকতেই হলোঃ কোই হ্যায়? পূর্বদিকের ঘর থেকে এক পুরুষের চেহারা দেখতে পেলেন তিনি। মুনি বিলক্ষণ জানতেন, তাঁর মুখে তাঁর নামটা শুনলেই শম্বুক যথা খোলের ভেতর সেঁধিয়ে যাবে সে লোকটি। তাঁর পক্ষে যতটা মোলায়েম হওয়া সম্ভব, তেমনটি হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ আমি ঋষি দুর্বাসা। আমার নাম শুনে ভয় পেও না। আমি এই রাস্তা ধরে কৃষ্ণের গৃহে যাচ্ছিলাম; পথমধ্যে বামাকন্ঠের কান্না শুনে ব্যাপারটা কি জানতে এলাম। দুর্বাসা নামটা উচ্চারিত হতে যে আলোড়ন পড়েছিলো, সেটা ক্রমশঃ থিতিয়ে এলে একটা চিন্তাক্লিষ্ট পিতার আদল ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠলো তাঁর কাছে, এক সম্পন্ন গৃ্হস্ত, তার অপরূপা সুন্দরী এবং কিছুটা শিক্ষিতা, গৃহুকর্মনিপুণা কন্যা, শুধু সে গৌরবর্ণা নয় বলে কোনো পাত্রপক্ষেরই পছন্দ হচ্ছে না। তা এ'সব কথা তুমি কৃষ্ণকে বলোনি? করজোড়ে বললেঃ হ্যাঁ ঋষিবাবা, তিনি সবই অবহিত আছেন। দুর্বাসা ঋষির স্বর ঈষৎ চিন্তাচ্ছন্ন শোনালোঃ শুধু অবহিত হলেই চলবে না। বিহিত তো একটা করতে হবে। মেয়ের বাবা, তখনো তার করজোড় বদ্ধ, অবস্থায় বললেঃ আজ্ঞে ভগবন, তিনি সব শোনার পর নিদান দিয়েছেন তুলাদন্ডের একদিকে কন্যাকে রেখে অপরদিকে সমভারের স্বর্ণমুদ্রা দিতে এবং সেই স্বর্ণমুদ্রার সমস্ত ব্যয়ভার তিনিই বহন করবেন। দুর্বাসা, তখনো তাঁর কুঞ্চিত ললাট, স্বগতোক্তি করলেনঃ শুধু সোনা দিয়ে কি সমস্যার সমাধান হবে? কন্যার পিতা বললেঃ আমারও অভিজ্ঞতা তদনুরূপ ভগবন। এখানে সবাই সচ্ছল। স্বর্ণ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। দুর্বাসা কিয়দক্ষণ ভেবে বললেনঃ তোমার কন্যাকে ডাকো তো, দেখি? অতঃপর কন্যা এসে দাঁড়ালে, দুর্বাসা বুঝতে পারলেন যে নেহাত গায়ের রঙটা সামান্য চাপা। এ মেয়ে গৌরী হলে তার রূপের ছটায় এই প্রাঙ্গণ আলোকিত হয়ে উঠত। দুর্বাসা এক অদ্ভূত স্নিগ্ধ স্বরে বললেনঃ কিরে মেয়ে, এই গরমকাল… আমার তো দরবিগলিত অবস্থা। তোর ইচ্ছা করছে না, কালোদীঘির টলটলে জলে অবগাহন করতে? মেয়েটির চোখেমুখে তখনো পরাজয়ের গ্লানি লেপ্টে রয়েছে। দুর্বাসা সেটা অনুধাবন করে বললেনঃ বোকা মেয়ে, পৃথিবীতে কি ছেলের অভাব? আজ যারা তোকে দেখতে এসেছিলো, তাদের কথা ভাবা বন্ধ কর। যা, ওই দীঘিতে ভরাট হয়ে অবগাহন করে আয়। আমি বলছি, ওই তড়াগে প্রথম অবগাহনেই তোর সব গ্লানি দূর হয়ে যাবে। যা মা, যা। মেয়েটি পিছদুয়ারের দিকে যাওয়ার উপক্রম করলে, দুর্বাসা মুনি বলে উঠলেনঃ দাঁড়া মা। বলে ঝোলা থেকে হাতড়ে-হাঁটকে এক টুকরো হলদি বার করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললেনঃ স্নান করার সময় শরীর সম্পূর্ণ ভিজে গেলে এই হরিদ্রাখন্ডটুকু সারা শরীরে মেখে নিস। দেখিস মা, ভুলে যাস নে যেন।

 

সেই কন্যা সান্ধ্য গাত্রস্খালনের পরিবর্তে আভাঙ করে স্নান করল দীঘির জলে, মুনির দেওয়া হলুদ খন্ড সে তার সর্বাঙ্গে মাখল, অন্ধকার ঘনিয়ে না এলে সে দেখতে পেত, দীঘির সে ঘাট তার গা-ধোওয়া জলে পিঙ্গল হয়ে গেছে। অতঃপর ক্ষারে গা ঘষে সে স্নান সারা করে পিছদুয়ার দিয়ে গৃহপ্রাঙ্গনে প্রবেশ করে দেখতে পেলো ঋষি তখনো প্রাঙ্গনে দন্ডায়মান। সাধু তাকে কি দেখবে, সে-ই বা সাধুকে কি দেখবে, বাড়ীর বারান্দায় দাঁড়ানো মা আর প্রাঙ্গণে দাঁড়ানো বাবা, তাকে দেখে চমকে উঠলো। মায়ের মুখ দিয়ে তো বেরিয়েই গেলোঃ হে ঈশ্বর, এ আমি কি দেখছি। মেয়ের গায়ের রঙয়ে তখন সারা প্রাঙ্গন ঝলসে উঠছে। মেয়ের বাবা  দুর্বাসা ঋষির পায়ের ওপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে বলে যাচ্ছেঃ ভগবন, এ কি করুণা তোমার।  ভগবন। দুর্বাসা যাওয়ার আগে বললেনঃ আমি বেশীদিন এখানে থাকবো না। দেখো, তার মধ্যে যদি এ মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে উঠতে পারো। আমি অনেকদিন মানুষের পাশে বসে ভোজবাড়ীর খাওয়া খাইনি। 

 

কৃষ্ণের অট্টালিকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে কৃষ্ণ। হেসে বললেনঃ তবে যে সবাই বলে ঋষি দুর্বাসা শুধু শাপই দিতে জানেন! দুর্বাসা পরিপূর্ণ চোখ মেলে চাইলেন কৃষ্ণের মুখমন্ডলের দিকে, সেখানে তখনো, স্মিত হাসি। তিনিও পাল্টা স্মিত হেসে বললেনঃ যে শাপ দিতে জানে; শাপ অব্যর্থ দেওয়া শেখার আগে আশীর্বাদকে সফলভাবে দেওয়ার শিক্ষা তাকে শিখতে হয়, বাসুদেব। বাসুদেবের সুদীর্ঘ দেহের মাপসই মুখে আবারও হাসি ফুটে উঠল, তবে কিনা, বড়ো ম্লান সে হাসি, সেই মলিন হাসি জিইয়ে রেখে মাধব বললেনঃ হে ঋষি কূলতিলক, আপনাকে কিছু শেখানোর ধৃষ্টতা আমার নেই, তবু, প্রত্যেককেই তার আগের জন্মের কর্মের ভার সামলাতে হয়। এ নিয়ম কালের নিয়ম। এর ব্যত্যয় করতে পারেন যিনি, তিনিই দশ মহাবিদ্যা হিসাবে পরিচিত। এই কন্যাও তার কর্মফল ভোগ করছিলো এই জন্মে, আপনি, মানে, মুনিপ্রবর, আপনারই আশীর্বাদে তার এই সহসা ভাগ্যোদ্ধার, এটা তো হওয়ার কথা নয়। দুর্বাসা বললেনঃ আমার, নাহ, শুধু আমার কেন, প্রত্যেক ঋষিরই শাপে বা বরে একটা গুঢ় অভিপ্রায় থাকে, আর সে অভিপ্রায় সম্বল করে, সৃষ্টি তার পথে সঠিক চলে। তোমার তো এটা অজানা নয়, দ্বারকাধিপতি। নয়ন নীমিলিত করেও নয়, তুমি তো ইচ্ছা করলেই সুদূর অদূর, সবই তো দেখতে পাও!

 

কিছুকাল আরো অতিবাহিত হল। দুর্বাসার স্বল্পাহার আরো কমে এলো, কৃষ্ণের গৃহের আতিথ্য গ্রহণের থেকে বেড়ে গেলো তাঁর বাইরে থাকা। একদিন সকালে, বেরোনোর আগে তিনি কৃষ্ণকে ডেকে পাঠালেন, এতোদিন একটা ছোট্ট ট্রিক করতেন কৃষ্ণ; দুর্বাসা ঋষি, সকালে, ডেকে পাঠানোর আগেই তিনি দুর্বাসার কাছে উপস্থিত হয়ে জেনে নিতেন তাঁর সেদিনের রুচি, অভিপ্রায়; - অর্থাৎ কিনা রুটিনটা, যাতে তিনি ঋষির সব অভিপ্রায় তিনি পূর্ণ করতে পারেন। সামোন্-এর তলব পেয়ে কৃষ্ণ তড়িঘড়ি ছুটে এলেন দুর্বাসা-সমীপে। দুর্বাসা তাঁকে ডেকে ভীষণ সমাহিত স্বরে বললেনঃ শোনো কৃষ্ণ, আজ আমার বেশ কিছু শিষ্য তোমার এখানে রাতে খেতে পারে। আবার নাও পারে। আমি তো ঠিক গুণে রাখিনি তারা সংখ্যায় কজন। তোমার রন্ধনশালার পাচকেরা তো রান্নায় খুবই পটু। তারা যেন আর কিছু নয়, খুব যত্ন করে পরমান্ন রাঁধে। আর তুমি দেখো, যদি তারা আসে, আসলে সংখ্যায় নেহাত কম হবে না, তাহলেও তাদের পরমান্নতে যেন সংকুলান হয়। কৃষ্ণ চকিতে ভেবে নিয়ে ঘাড় নেড়ে বললেনঃ তাই হবে, মুনিকূলভূষণ। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ঋষি দুর্বাসা তার খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে গেলে, কৃষ্ণ (কোথায় যে রোজ যান!) পাকশালে এলেন, ব্রিফ অ্যান্ড প্রিসাইজড বক্তব্য তাঁর, অনেকটা ক্ষীর তৈরী করতে বললেন তিনি, আর তারপর বললেনঃ আজ তিনি সব দ্বারকাবাসীদের পায়েস খাওয়াবেন কিন্তু রাত্রে, সাপারে। সুতরাং রন্ধনশালা এখন যেন স্পিকটি নট। বলরামের সঙ্গে দরকারী কিছু কথা ছিলো তাঁর, সেগুলো সেরে নিয়ে, বিছানায় আলগোছে শুয়ে কি একটা কথা যেন ভাবতে ভাবতে, অল অফ আ সাডেন, পৃথার কথা মনে পড়লো তাঁর। ঋষিশ্রেষ্ঠ দুর্বাসা, কৃষ্ণ নিশ্চিত, তাঁর আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট, প্রীত, তাহলে কি আশীর্বাদী বর দিতে পারেন তাঁকে, যেখানে তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ।  পরমুহূর্তেই নিজেকে তিরস্কার করে উঠলেন তিনিঃ তাঁর কাজ কর্মটুকু করা, কারণ, এখন তিনি মনুষ্য যোনিতে। যখন প্রয়োজন হবে, তখন, শুধুমাত্র তখন তিনি এই মনুষ্য যোনির স্কিন স্যেড করবেন আর এখন সে ক্ষণ দূরাগত, যেমন অনেকদূর চলে গেলো তাঁর  বাল্যকাল, বালগোপাল। চোখে সামান্য ঝিম লেগে থাকবে তাঁর, উঠে বাইরে এলেন। কে বলবে এঁরা তাঁর প্রজা! প্রতিবেশীজ্ঞানেই তিনি আলাপে রত হয়ে গেলেন। দ্বারুক এলে 'পর গল্প জমে উঠলো। 

 

সব দাহের শেষ আছে, এমনকি শৈত্যদাহেরও। দুর্বাসা মুনি কৃষ্ণের অট্টালিকায় ফিরলেন। একা। কৃষ্ণ তাঁর শিষ্যদের কথা শুধোতে গিয়েও সামলে নিলেন। কাল কি সে তো তাঁর অজানা নয়। দুর্বাসা এই দিন কয়েকের মধ্যে একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন তাঁর  ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার (উনি সাপার বলেও পাল্টে নিয়ে ডিনার বলেছিলেন), কারণ ভবিষ্যত প্রজন্ম ডিনারই বলবে, সাপার নয়, সাপার শব্দটা কোনো এক ছবির নামকরণেই চিরজীবিত থাকবে। 

 

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ডিনার এলো।  দুর্বাসাপ্রদত্ত মেনু যথা, শুধুমাত্র পরমান্ন। তবে কোয়ান্টিটিতে প্রচুর। ক্রোধের সিন্যোনেম দুর্বাসা মিটিমিটি হাসছিলেন পরিমাণ দেখে। তারপর বলেই ফেললেনঃ এ কি করেছ, কৃষ্ণ। আর জন্য এই পরিমাণের আয়োজন। এ ভোজন কি একা আমার পক্ষে সম্ভব? কৃষ্ণ মুখ টিপে হেসে বললেনঃ আসলে মুনিবর, আপনার সম্ভাব্য শিষ্যদের কথা ভেবেই... কৃষ্ণকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দুর্বাসা বলে উঠলেনঃ দেখেছো, কাজের কথাটাই বলতে ভুলে গিয়েছি। ওরা কেউই আসতে পারবে না। তুমি পারলে ওদের ক্ষমা...  এবার দুর্বাসার বাক্যকে খেয়ে নিলেন বাসুদেবঃ হে ঋষি কূল তিলক, তাঁরা আপনার শিষ্য। তাঁদের আমি ক্ষমা করার কে? আর সর্বোপরি, আমি পাপের ভাগী হতে যাবো কেন? দুর্বাসা কৃষ্ণের দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থেকে আনমনা স্বরে বললেনঃ আজ আমরা একসঙ্গে খাবো, কৃষ্ণ। তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো। কৃষ্ণ রেস্টরুমে যেতে যেতে ভাবলেন, দুর্বাসা ঋষির আজ হলোটা কি, তিনি সহজ বোধগম্য ভাষাই বলেন কিন্তু এতো চলিত ভাষায় তিনি তো আগে কোনোদিন কথা বলেননি। হস্ত-মুখমন্ডলাদি প্রক্ষালন করে, মাধব, বেশ চটপটই চলে এলেন দুর্বাসা মুনির জন্য অ্যালোটেড আউট হাউসে।

 

দুর্বাসা ঋষি এক টেবল স্পুন পরমান্ন মুখে দিয়েই বলে উঠলেনঃ আহা, বড়ো দিব্য বানিয়েছে। চালগুলোকে তো দুধে নয়, ক্ষিরে ঘিরে রেখেছে। খাও, কৃষ্ণ খাও। বলে তিন চামচ খেয়ে বললেনঃ বাস, আমার উদর, আত্মা সব তৃপ্ত। বহুদিন এমন তৃপ্ত হইনি আজ যেমন হলাম। ও কি কৃষ্ণ, তুমি থেমে কেন! খাও, প্রাণভরে খাও। স্বয়ং নারায়ণকেই যেন দেখতে পাচ্ছি তোমার পরমান্ন গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। কৃষ্ণ এটা বুঝতে পারছিলেন যে দুর্বাসার অভিপ্রায় কিছু একটা আছে; কিন্তু সেটা ঠিক কি সেটা মেপে উঠতে পারছিলেন না। যতটা সম্ভব খেলেন তিনি। পায়েস। দুর্বাসার আদেশমতো। অবশেষে একটা সময় ক্ষান্ত দিলে দুর্বাসা বলে উঠলেনঃ বাস! ওইটুকু মাত্র। ইয়াং ছেলে, চেহেরাতেও আমার থেকে লম্বা চওড়া তুমি, আর ওইটুকু তোমার পায়েস খাওয়ার সাধ্য! বাসুদেব বললেনঃ আমিও এবার আপনার মতো অন্তরাত্মায় তৃপ্ত মুন্যোত্তম। দুর্বাসা ফিক করে হাসলেনঃ বেশ, এবার তুমি তোমার মুখমন্ডলে পায়েসটা মাখাও। কৃষ্ণ মাখলেন। এরপর দুর্বাসা বললেনঃ এবার মাথার চুলে এমনভাবে ওই পায়েস মাখাও যেন শিরের ত্বকের প্রতিটি কোণায়, কোণায় ওই পায়েস পৌঁছে যায়। 

কৃষ্ণ বাক্যব্যয় না করে মূক মুখে, অরবে আদেশ পালন করতে থাকলেন। মাথায় মাখা শেষ হলে দুর্বাসা বললেনঃ এবার তুমি অচ্যুত, ওই পরমান্ন সারা শরীরে মাখো। কৃষ্ণ বাকখরচ না করে সারা শরীরে মাখলেন, কিন্তু, হাঁটুর কাছে এসে শ্লথ হয়ে গেলো তাঁর গতি; দুর্বাসা ঋষি আক্ষরিক অর্থেই মহাজ্ঞানী, পার্থিব জ্ঞান এবং ব্রহ্মজ্ঞান পূর্ণ মগজায়ত্ত তাঁর। কৃষ্ণের একটু খটকা লাগছিলো, বুড়ো ঋষি কি শাপে বর দিচ্ছেন, না, বরে শাপ! এদিকে সাত পাঁচ ভেবে যে একখানা ভালো কৌশল তৈরী করবেন যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে, তারও জো নেই। দুর্বাসা সেই যে গ্যাঁট বসেছেন, ওঠার নামই নেন না। বরং একফাঁকে হেঁকে উঠলেনঃ কই হে দেবকীনন্দন, জানুতে গিয়ে থেমে গেলে যে বড়ো। মাখো, মাখো। আমার হাতে বেশী সময় আর নেই। কৃষ্ণ সে হুকুম মতো পায়েস মাখলেন গোড়ালি অবধি। কিন্তু দুর্বাসা আবার ধমকান, চমকানঃ আরে এ ছেলে তো বড়োই ঢ্যাঁটা। কি হলো মুরারি, তুমি বারবার থামছো কেন? তোমার সমস্যাটা কোথায়? কৃষ্ণ বচনব্যয় না করে পায়ের ওপর ইতঃস্তত মাখতে মাখতে ভাবলেন, দুর্বাসাকে ঋষিদের ঋষি বলা হয়। তাঁর উচ্ছিষ্ট প্রসাদ বই আর কিছু নয় এবং অতঃপর ঘোষণা করলেন যে তাঁর পরমান্ন প্রক্ষালন সম্পূর্ণ।  

 

দুর্বাসা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর অস্ফুটে বললেনঃ ভুল করলে কৃষ্ণ, মহাভুল করলে। তুমি কি জানো তুমি কি ভুল করেছো? কৃষ্ণ বললেনঃ তখন বুঝিনি মুনিরাজন, তবে এই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম, যে আপনি আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদটা করে গেলেন। আমার এক্সিট ওয়ে তৈরী হয়ে গেলো। আপনি তো ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের একজন, আপনার তো অজানা থাকার কথা নয় যে, এই মর্ত্যধামে যে যত এক্সেটেন্টে অমর সে ততটাই দুঃখী। আমার কাছ থেকেও এই অভিশাপ পাবে একজন। দ্রোণনন্দন অশ্বত্থামা। দুর্বাসা চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলেনঃ একি দেখছি! ব্রাহ্মণের হাতে গান্ডীব, তিনি শরযোজনা করছেন। তারপর একটু থেমে হাহাকার করে উঠলেনঃ আহা কৃষ্ণ। এ বালক দুগ্ধের স্বাদ জানে না, সে পিটুলিগোলাকে দুগ্ধজ্ঞানে পান করছে, আর তাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে প্রকৃত দুগ্ধপায়ী শিশুরা। এ বালক তো ওই শরসন্ধান করা ব্রাহ্মণের সন্তান। এ ব্রাহ্মণকে কেউ গোদান করেনি। কৃষ্ণ বললেনঃ নাহ, এ ব্রাহ্মণ অতিরথ। সর্বোপরি অস্ত্রগুরু হওয়ার সবকটা গুণ এঁর মধ্যে বিদ্যমান, যার ফলে ওঁর ব্রাহ্মণ্যগুণের চাইতে ক্ষত্রিয়গুণ বেশী। কোনো গোত্রের কেউ ওঁর যজমান হতে পারার গুণসম্পন্ন নয়। আর যজমানি না করলে গোদান করবে কে বলুন? দুর্বাসার হাহাকার তখনো থামেনি, তা বলে এই ভাগ্যাহত বালক যে সকল সুহৃদের ব্যঙ্গের শিকার, সে তোমার ওই মোক্ষম অভিশাপ পাবে? কৃষ্ণ প্রত্যুত্তর না করে প্রতিপ্রশ্ন করলেনঃ এই বললেন সুহৃদ, তার পরেই উচ্চারণ করলেন ব্যঙ্গ। ব্যাপারটা তো ঠিক বুঝলাম না, ঋষিপতি। দুর্বাসা বললেনঃ এরা ওই বালকের সুহৃদই থাকবে কিন্তু... 

কৃষ্ণ মধ্যপথে দুর্বাসাকে থামিয়ে বললেনঃ কিন্তু আজ ওই সুহৃদরা যে কাজ করছে, তার ফল ওই বালকের প্রতি চিরপ্রোথিত থাকবে। ভবিষ্যতে এই বালকের এক প্রকৃত সুহৃদ হবে। আর সেই সুহৃদই হবে ধর্মরাজ্য স্থাপনের যুদ্ধের কারণ। দুর্বাসা চোখ বন্ধ করে, কয়েক লহমা পর বললেনঃ আরে এতো ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের জেষ্ঠ্য জন, দুর্যোধন। কৃষ্ণ বললেনঃ হ্যাঁ ঋষিকূলতিলক, আর এই দুর্যোধনের জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুর্দিনে, যখন কিনা আর অধর্মের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নেই, তখন এই অশ্বত্থামা সুহৃদের মনে সামান্য স্বস্তি আনার জন্য দুটি মারাত্মক অধর্ম করবে। মনশ্চক্ষে ব্যাপারটা অনুধাবন করার জন্য আঁখিদ্বয় বন্ধ করেই দুর্বাসা বলে ফেললেনঃ আরে আরে, কতদিন বাদে দেখতে পেলাম ভীষ্মকে। বড়ো আনন্দ লাগলো। কৃষ্ণ একদম আবেগহীন স্বরে বললেনঃ তাই? কিন্তু ধর্মযুদ্ধের অন্যতম কারণ পিতামহ ভীষ্ম। দুর্বাসা একটু বিস্মিত স্বরে বললেনঃ সে কি! ভীষ্ম আবার কি করলেন? কৃষ্ণের উত্তর যেন আগে থেকে তৈরী করা ছিলোঃ পিতামহ কিছুই করেননি। ধর্মও না, অধর্মও না এবং এইটাই তাঁর অধর্ম। দুর্বাসা একটু ক্ষান্ত দিয়ে বললেনঃ ঠিক বুঝলাম না। কৃষ্ণ মুচকি হেসে বললেনঃ যাঁর একটা হ্যাঁ তে হস্তিনাপুর হ্যাঁ, যাঁর একটা না তে হস্তিনাপুর না; তিনি কোনোদিন হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিলো হস্তিনাপুরকে সুরক্ষিত করার, তিনি সেটা করেছেন, কিন্তু হস্তিনাপুরে যে ধর্ম সুরক্ষিত নেই, এটা তিনি বুঝেও বোঝেননি, রাজধর্মের অংশ হিসাবে চিরটাকাল নীরব থেকে গেছেন। দুর্বাসা একটু আনমনে জানতে চাইলেনঃ তুমি এতো কথা কোথা জানলে, বাসুদেব? কৃষ্ণ, মুখের সে মুচকি হাসি ম্লান হয়ে এসেছে, বললেনঃ মহর্ষি ব্যাসদেবই বলেছেন। তিনি আমার কাছ থেকে শপথ নিয়ে গেছেন, শঠতায়, প্রবঞ্চনায়, উপস্থিত বুদ্ধিতে, শয়তানি যেন তেন প্রকারেণ ধর্মের জয় আমায় নিশ্চিত করতে হবে। দুর্বাসা সদর্থক মাথা নেড়ে বললেনঃ মহর্ষি ব্যাসদেবের এই এক মজা। নিজের জন্মবৃত্তান্ত থেকে বারংবার তিনি, তাঁরই লিখিত কাব্যে, স্বনামে এসেছেন, অথচ তাতে কাব্যের ধর্মগুণ তো দূর, কাব্যগুণ বা কাব্যরস একতিলও কমেনি। কৃষ্ণ হেসে বললেনঃ এটা তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছেন, যাতে এই কাব্যের ভবিষ্যতের পাঠক এটা যেন না ভাবে তার প্রিয় চরিত্রের কি হবে, সে যেন ধর্মের দিকে, ন্যায়ের দিকে থাকতে পারে। অর্থাৎ - আচমকা থেমে যাওয়ায়, দুর্বাসা, কৃষ্ণের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধোলেনঃ অর্থাৎ কি? থামলে কেন বাসুদেব? বলো। আমার শুনতে আগ্রহ যাচ্ছে।  কৃষ্ণ এবার ফিক করে হেসে ফেলায়, ঝলকের জন্য দেখা যায় তাঁর গজদাঁতঃ আপনাকে আমি কেন যে এসব বলছি! একজন ত্রিকালজ্ঞ মহা ঋষি... দুর্বাসাও এবার স্মিত হেসে বললেনঃ বেশ, আমি না হয় ত্রিকালজ্ঞ। আমি না হয় মহা ঋষি। ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কে, বাসুদেব? কোনও কাল কি এমন আছে যেটা তুমি দেখতে পাচ্ছো না? কৃষ্ণ যথাবিহিত ব্রীড়াপুরঃসর বললেনঃ আসলে মহর্ষি ব্যাসদেব এটা ইচ্ছাকৃতই একপ্রকার করেছেন এবং করবেন একটাই কারণে ; - ভবিষ্যতের পাঠকের মননকে মহাভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তাঁর উদ্দেশ্য ভবিষ্যতের পাঠকের মননের মধ্যে মহাভারতকে অন্তর্গত করে দেওয়া। আর তারপর চরিত্রগুলোকে স্বাধীন করে ছেড়ে দেওয়া অর্থাৎ ভবিষ্যতের পাঠকের ওপর মহাভারতের উত্তর দায়িত্বকে ন্যস্ত করা। যেমন মুনিবর যদি অভিলাষ করে দেখতে চান, জেষ্ঠ্য কৌন্তেয় কর্ণ... কৃষ্ণকে বলবার আগ্রহ ছেঁকে ধরে, দুর্বাসাও মনোযোগের পরমাতিশয্যে কৃষ্ণকে অবলোকন ও শ্রবণ – দুই-ই করতে থাকেন, চটকা ভাঙতেই বলে ওঠেনঃ কানে আবার কি হলো হে? মাখো নি তুমি, পরমান্ন, কানে? তোমাকে যে পইপই করে – কৃষ্ণ থামিয়ে দেন দুর্বাসাকেঃ উফ, ঋষিপ্রবর... কলির যে কোনো মহৎ আশয়ের মতোই আপনার দশা দেখি! আরে এ কর্ণ সে কর্ণ নয়। বিপন্ন দুর্বাসা শুধিয়েই ফেলেনঃ তাহলে? কৃষ্ণ গোপন কথা ভাঙবার সুরে বলে দেনঃ এ কর্ণ কুন্তীর প্রথম সন্তান। উপস্‌, সরি, কুন্তী বললে তো আপনি আবার বুঝবেন না, দেখুন দিকি, পৃথা নামটা কি চেনা চেনা লাগে? দুর্বাসা প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসেন, তারপর চোখ বুজে তল্লাশ করতে থাকেন। কয়েক লহমা পরে, চোখ খুলে বলেনঃ বুঝেছি। তা কর্ণের কি দোষ? এবার কৃষ্ণের মুচকি হাসির পালাঃ অ্যাপারেন্টলি কর্ণের অ্যাজ সাচ কোনো দোষ-ই নেই – দুর্বাসা থামিয়ে দেন কৃষ্ণকেঃ দাঁড়াও হে, দেবকীনন্দন... অতঃপর স্বগোতক্তি করেন, অ্যাপা... অ্যাপারেন্টলি, অ্যাজ... অ্যাজ সাচ। হুম, বলো এবার। কৃষ্ণ মুখস্থ করে রাখা কবিতার মতো বলে যেতে থাকেনঃ কর্ণের সবই গুণ। কিন্তু সেই গুণগুলির প্রত্যেকটার জন্য লিমিটলেস, আনলিশড অহংকার – এ-ই হলো তার একমাত্র মহাদোষ। এর দন্ড তাকে নিতেই হবে। দুর্বাসা আবারও চোখ বোজেন এবং বুজেই আঁতকে ওঠেনঃ তাই বলে এভাবে? এভাবে নিয়তি আসবে তার! আর সে নিয়তি তো তোমারই আনা দেখতে পাচ্ছি! এরকম ফাকড অ্যান্ড ফার ফর হোম করে মারবে তুমি ছেলেটাকে! মনে রেখো, ও কিন্তু অরুণ-পুত্র। কৃষ্ণ আনমনা হয়ে যানঃ পুত্র সে যার-ই হোক, হি উইল বি ফাকড অ্যান্ড দ্যাট টু ফার ফ্রম হোম। ওর অহংবোধ অনেক, অনেক জটিলতা তৈরী করবে।

 

কিছুটা সময় নীরব যায়। সহসা কৃষ্ণ বলে ওঠেনঃ কিন্তু মুনি শিরোমণি, এই অ্যাত্তো জটিলতার মূল কারণ কিন্তু আপনি। দুর্বাসা হাসতে থাকেনঃ কি রকম? কিরকম? কৃষ্ণ অতি বিষাদগ্রস্ত স্বরে বলেনঃ কি প্রয়োজন ছিলো কুন্তীকে ওই অমোঘ মন্ত্র শেখানোর? আমি এটা এখনই জানলাম। রাজা শূরসেন তো কুটো ভেঙে দুটো করেন নি, সব করেছিলেন পৃথা। তাঁর সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে আপনি তাঁকে এমন একটা মন্ত্র শেখালেন যে... হে উত্তম, আপনি কি করে ভুলে গেলেন তাঁর বয়স! ওই বয়সে অমন একটা লিওরিং চ্যান্টিং ভার্স... তাঁর তো কে এল পি ডি হবেই। হাসেন দুর্বাসা। মুখের হাসিটাকে জিইয়ে রেখেই বলেনঃ গোটা মহাভারতটাই কি কে এল পি ডি নয়? কে এল পি ডি বলেই তো তুমি আর একবার সম্ভবামি যুগে যুগে হয়েছো। তাছাড়া যদি একটু অন্যভাবে দেখো – কৃষ্ণ প্রস্তুত হনঃ হ্যাঁ, অন্য ভাবে যদি দেখি... দুর্বাসা বলে চলেনঃ লুক অ্যাট দ্য হিমালয়া। অল ইটস এইট থাউজান্ডারস। অ্যাভাঁল্যশ হচ্ছে, ব্লিজার্ড হচ্ছে, চোদ্দখানা আট হাজারি তে সারাক্ষণই মরণকূপ চলছে। যে কলির কথা মাঝেমধ্যেই আমাদের আলোচনায় আসছে, সে কলি, কল্‌কেতে অজস্র লোক মারা পড়বে এই এইট থাউজান্ডার অ্যাসেন্ড করতে গিয়ে। তবুও... তবুও সেগুলো কি তাদের মতো করে সুন্দর নয়? এই তো ভীষ্মকেই দেখো, ভীষ্মই একমাত্র জানবে কর্ণের পরিচয়, ফ্রম দ্য ভেরি অনসেট। তখন দুর্যোধনের অঙ্গরাজ্য-ফাজ্য দেওয়ার ঢের দেরী। সেই সময় থেকে ভীষ্ম কর্ণকে স্পট করে রাখবে। কুরুক্ষেত্রে, এ-এটা তুমি দেখতে পাবে কৃষ্ণ, কর্ণের ওপর ভীষ্মের কি স্নেহ! ফল্গুর মতো সে অন্তঃসলিলা, কিন্তু তার খরস্রোত, তার বহে যাওয়া – এসব তুমি টের পাবে। কারণ দূরত্বে থাকবে তুমি। কাছে থাকায় যে অনুভব কর্ণের পেতে অনেক সময় লাগবে। কৃষ্ণ সম্মতির মাথা নাড়েনঃ এ আমি অনুমান করতে পারি, ঋষিরাজ। প্রয়োজনের কাজের চাইতে, দরকারী সিদ্ধান্তের চাইতে আবশ্যক রাষ্ট্রধর্মের চাইতে অপ্রয়োজনীয় স্নেহ দিয়েই পিতামহ ভীষ্মকে মার্ক করা যায়। আর তাঁর অনমনীয় প্রতিজ্ঞা। ওইজন্যই তিনি নিজেও মজবেন, লঙ্কাকেও মজাবেন।  

 

সময়ের চলার শব্দ হয় না। সুতরাং নীরবতা নেমে আসে কৃষ্ণ-দুর্বাসার মধ্যে। সে নৈঃশব্দ্য ভাঙেন দুর্বাসাঃ যাক গে, আর কিছু কাল পরেই যেটা ঘটাবে তুমি, সে আজ জেনে আর লাভ কি! আমি তো হিমালয়ে বসেই সব জানতে পারবো। তার চেয়ে তুমি কলি, কল্‌কের কিছু কথা বলো, শুনি। আমি তো অতো দূর অবধি স্পষ্ট দেখতে পাই না, ঝাপসা লাগে। প্রত্যুত্তরে, সামান্য হাসেন কৃষ্ণঃ আজ আপনি আমার ভবন থেকে, এই দ্বারকা থেকে বিদায় নেবেন, তাই না, মুন্যৈশ্বর্য? দুর্বাসা হাসেন। কৃষ্ণ ম্লান স্বরে বলেনঃ বলুন, কি জানতে চান?

দুর্বাসা সাগ্রহে জানতে চানঃ কেমন থাকবে এই দেশ?

-     তখন এই দেশটার পুরো নাম হবে ভারতবর্ষ। যাদের কথা বলেছিলাম, সেই যারা এই দেশকে শাসন করবে প্রায় দুশো বছর ধরে...

-      ইংরেজরা?

-      হ্যাঁ, ইংরেজরা। তাদের কাছ থেকে একদিন এই দেশ স্বাধীন হবে।

-      কবে?

-      কবে? উমমম ধরুন, কল্‌কে শুরু হওয়ার পঁয়ষট্টি বছর আগে।

-      তারপর?

-      তারপর আর কি… তখন অবশ্য দেশটা এখনকারের মতো থাকবে না, অনেককটা টুকরো হবে এই ভূ-খন্ডের।

-      বলো কি!

-      হ্যাঁ, ঋষিভূষণ, তবে আর বলছি কি। এক অদ্ভূত দল তৈরী হবে বিদেশে, ওই ইংরেজরা যেদিকের, সেই অঞ্চল থেকে। তাদের ধারণা, আদর্শ খুবই মহান হবে।

-      কিরকম শুনি?

-     এই, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার রোটি, কাপড়া অউর মকান থাকবে। সবাই শিক্ষা পাবে, স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবে। দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সবাইয়ের অংশগ্রহণ থাকবে প্রত্যক্ষ। মানে, একটা জীবনের সুস্থ যাপন করতে হলে যা যা দরকার – সব থাকবে।

-      কি বলছো তুমি কৃষ্ণ! বর্ণাশ্রম...

-      আজ্ঞে... মুনিসম্রাট, সেভাবে থাকবে না।

-     রোটি, কাপড়া অউর মকান - বেশ কথা। স্বাস্থ্য পরিষেবা – অতি উত্তম। ডেভেলপমেন্ট ফর অল – দারুণ ভাবনা। কিন্তু এডুকেশন ফর অল? এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না?

-      তখন কিছুই আর বাড়াবাড়ি থাকবে না মুনিশ্রেষ্ঠ। বায় দ্য ওয়ে, আপনিও কিন্তু আবেগে ভেসে গেলেন, আর ভেসে গিয়ে প্রারব্ধ, আরব্ধ সব কর্মফলকেই জলাঞ্জলি দিলেন! এনিওয়ে, কিন্তু এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে গিয়ে গোটা পৃথিবী মুখ থুবড়ে পড়বে। সমাজবাদ নামে একটা ধারণা আসবে।

-      সে কি! সমাজকেই তারা বাদ দিয়ে দেবে।

-      না, না। ঠিক তার উল্টো, সমাজকে ঢাল করে নিয়ে, সমাজকে মানুষের ওপরে তুলে...

-      সে আবার হয় নাকি!

-      তখন হবে। মানে, হওয়ানো করা হবে।

-     ভারতেও এই ধারণার আমদানি হবে। আফটার অল, গুড ফর অল – এই ধারণাটাই খুব সংক্রামক কিনা! বঙ্গদেশে, সুদূর দাক্ষিণাত্যের এক রাজ্যে এই দলের ক্ষমতা থাকবে দীর্ঘকাল। আর একটা দল থাকবে যারা হিন্দুত্ববাদী হবে।

-      কি বলছো তুমি কৃষ্ণ, অ্যাঁ? ভারত থেকে হিন্দুত্ব বাদ চলে যাবে!

-     হে সাধকের সাধ, এরপর থেকে যতবার আমি কোনো কিছুর পর বাদ বলবো, ততবার আপনি সেটাকে সবকিছুর ঊর্দ্ধ্বে ঠাঁই দেবেন। কেমন?

-      আচ্ছা, আচ্ছা। তা হিন্দুত্ববাদী দল তো তাহলে খুব ভালো, কি বলো?

-     আপনি যেমন ভাবছেন, তেমনটা ঠিক নয়। ইংরেজরা ভারতের প্রভুত্ব ছেড়ে যাওয়ার আগে দ্বি-জাতি তত্ত্ব, মানে, দ্বি ধর্ম তত্ত্ব, অর্থাৎ হিন্দু আর মুসলমান এই ধর্ম দুটির ওপর-

-      মুসলমান জিনিসটা কি, কৃষ্ণ?

-      সে আর একটা ধর্ম। পরে তৈরী হবে। এই পৃথিবীতে।

-      বেশ। তারপর?

-      হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিলো, হিন্দু আর মুসলমান এই ধর্ম দুটির ওপর ভিত্তি করে দেশটাকে ভেঙে দেবে। মূল ভারত নামে যে অংশটা থাকবে, সেখানেও মাথা চাড়া দেবে এই হিন্দুত্ববাদী দল। তারা দেশটাকে হিন্দুদের দেশ বানাতে চাইবে আর –

-      সে তো বেশ কথা।

-      কিন্তু সেজন্য যে কোনো রকম হিংস্রতাকে অবলম্বন করবে তারা।

-      কিরকম?

-      এই যেমন ধরুন, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রচুর খিল্লী হবে।

-      কাদের খাদ্যাভ্যাস?

-      এই হিন্দুদের।

-      হিন্দুদের।

-      হিন্দুদের আবার খাদ্যাভ্যাস কি?

-     এখন নেই, তবে তখন হবে। এই যেমন ধরুন, গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ হবে। পূজা-পাঠের দিন নিরামিষ ভক্ষণ আবশ্যিক হবে।

-      অ্যাঁ!

-      হ্যাঁ।

-      মুসলমানদেরও কোনো বিশেষ খাদ্যাভ্যাস থাকবে নাকি?

-     সে তো থাকবেই। কিছু ফারাক না থাকলে ধর্মগুলোকে আলাদা করে চেনা যাবে কি করে বলুন? তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম হবে কুর-আণ। সেখানে বলা থাকবে, তারা বরাহের মাংস পরিহার করবে। অর্থাৎ একান্ত কারে না পড়লে ভাঁড়ের জল খাবে না। কিন্তু সর্বরকমের সূরা হবে একান্ত বর্জ্যনীয়। অথচ এটা পাল্টে যাবে, বরাহের শুল-পক্ক মাংস হবে নিষিদ্ধ। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে সূরা চলবে অবাধ। তাদের একজন গানই বাঁধবে হাঙ্গামা কিঁউ বড়পা, থোড়ি সি যো পিল লি হ্যায়, ডাকা তো নেহি ডালা, চোরি তো নেহি কি হ্যায়।

-      তো?

-      তো, খাদ্যাভ্যাস দিয়ে শুরু করে, সর্ব প্রকারে নিপীড়ন করা হবে মুসলমানদের, খ্রীস্টানদের।

-      খ্রীস্টান আবার কি?

-      আরেকটা ধর্ম।

-      আচ্ছা...

-      খুন, ধর্ষণ, সব চলবে।

-      হিন্দুরা এসব করবে মুসলমানদের? খ্রীস্টানদের?

-      হুম।

-      এসব কি কথা! এসব কেন হবে? আর তারা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলবে? পাল্টা মার দেবে না?

-      তারা আরও এককাঠি সরেস।

-      জাষ্ট গিভ মী সাম টাইম, কৃষ্ণ।

 

চোখ বোঝেন দুর্বাসা। চোখ খুলেই বললেনঃ কৃষ্ণ, এরা তো ভয়ানক অলুক্ষনে লোক! সবকটা দলই মুখে এক, কাজে আর এক। এবং সেটা সবসময়। আর এই হিন্দুত্ববাদী দল আর যাই হোক, হিন্দুত্ববাদী নয়, কিংবা এরাই হিন্দুত্ববাদী কারণ এরা হিন্দুত্বটাকে পুরো বাদ দিয়ে দেবে। কৃষ্ণ ফিক করে হেসে জানতে চাইলেনঃ কোন্‌ সময়তে গেলেন আপনি, মুনিপতি? দৃশ্যতই বিপর্যস্ত লাগে দুর্বাসাকেঃ এই রে, সেটা তো এক্স্যাক্টলি বলতে পারবো না। তবে কল্‌কের ধারেকাছে গিয়েছিলাম। কৃষ্ণের চোখ সরু হলোঃ তবে খুব ধারেকাছে বোধহয় যান নি। গেলে টের পেতেন, কল্‌কের ঠিক এক বছর আগে একটা অভূতপূর্ব রাজনৈতিক দল প্রকট হবে বঙ্গদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে। তাদের মতো আজব দল আর হবে না। দুর্বাসা প্রচন্ড কৌতুহলী হলে স্লাইটলি ককেটিশ শোনায় তাঁর স্বরঃ কেন? কেন? একথা বলছো কেন? কৃষ্ণ হাসতে হাসতে বললেনঃ দেখুন মুনিনাথ, এতক্ষণ যাদের কথা শুনলেন, যাদের একঝলক দেখেও এলেন, এরা মিথ্যাচারী, কপট, হিপোক্রিট, ব্লাডবাথে অ্যারাউজড কিন্তু এদের কিছু বইপত্তর আছে, তাতে তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, বিধেয়, কর্তব্য লিখিত আছে। সেগুলোর কিছুই তারা অনুসরণ করবে না, সেটা আলাদা কথা কিন্তু দ্যাট দোজ উইল এক্সিস্ট... কিন্তু আমি যে দলের কথা বলছি তাদের তাদের চিন্তা-ভাবনা, আইডিয়োলজি এসব কোনো কিছুই কোডেড থাকবে না, কারণ কোডেড হওয়ার মতো কিছুই নেই তাদের। অথচ তারাই ভীষণ প্রকট হয়ে উঠবে বঙ্গদেশে। মজার কথা কি জানেন, সব রাজনৈতিক দলে চোর থাকবে, কিন্তু এই দলটা চোরে মিলে গড়বে। আপনি মুনিরাজ, আর একবার ভ্রমণ করে আসুন কল্‌কে শুরু হওয়ার বছর তেরো পরে, দেখবেন একটা অভূত ব্যাপার। যান, একবার যান –

দুর্বাসা মুনি আর একবার চোখ বন্ধ করেন। এবার তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ রেখেই তিনি বলে ওঠেনঃ আরে, এরা পাগল না পার্শে মাছ! চাকরী দিলো ঘুষ খেয়ে। আর সেটা নিয়ে আদালতে মামলা হলে বাদী পক্ষের উকিলকে দোষ দিচ্ছে! মানুষ কি ছাগল নাকি... চোখ খোলেন দুর্বাসা। তারপর স্তিমিত স্বরে শুধোনঃ একটা জিনিস আমি বুঝছি না, কৃষ্ণ। কৃষ্ণ তাঁর মুখের হাসি জীইয়ে রেখেই বললেনঃ বলুন না? দুর্বাসা প্রশ্নটা পেড়ে ফেলেনঃ রাজা তো একটা আছে। দেশ এখন স্বাধীন। সেই ফর্সা লম্বা সুঠাম চেহেরার ইংরেজরা নেই। এখন তো দেশীয় রাজা। তার রাজধর্ম কোথায়? তুমি ভীষ্মের কর্তব্য না করা নিয়ে এতো ক্রুদ্ধ, কিন্তু এ রাজা তো ভীষ্মের চেয়েও বহুগুণ সরেস। ব্যাটা কি জলসাঘরে থেকে সারাক্ষণ বাঈজী নাচ দ্যাখে? কৃষ্ণ অট্টহাস্য করে ফেলেন। দুর্বাসা আরও বিস্মিত হয়ে শুধোনঃ ও কি? অমনভাবে হাসছো যে? আমি কি খুব ইডিয়োটিক প্রশ্ন করে ফেলেছি? কৃষ্ণ তাঁর হাসির দমক থামিয়ে বললেনঃ হে ঋষিপতি, রাজা কোথায়? এখানে আর রাজতন্ত্র নেই। এটা গণতন্ত্র। দুর্বাসা মহা চিন্তায় পড়ে গেলেনঃ দ্যাখো কৃষ্ণ, তন্ত্র অনাদির আবিষ্কার। এবং তুমি সেটা অ্যাফিলিয়েট করেছো। সুতরাং তন্ত্রের এতরকম ফ্যাকশন হওয়ার কথা আসছে কোত্থেকে? কৃষ্ণ আবার সশব্দে হেসে ফেললেনঃ হে ঋষিরাজ, এ তন্ত্র সে তন্ত্র নয়। রাজতন্ত্র মানে, রাজার অনুশাসনে চলা। এ আপনি জানেন। কিন্তু গণতন্ত্র অন্য জিনিস। সেখানে প্রজারা কিছু বছর অন্তর অন্তর ঠিক করে দেবে, কোন্‌ রাজনৈতিক দলের দলের অনুশাসনে তারা চলবে। অবশ্য অনুশাসন শব্দটা আর থাকবে না তখন। নতুন একটা শব্দ আসবে, প্রশাসন। আমি যে দলটার কথা কথা বলছিলাম, আপনি এইমাত্র যে সময়টা দেখে এলেন, বঙ্গদেশে তখন তাদের প্রশাসন চলবে। আর সেটা প্রজারাই ঠিক করে দিয়েছে কল্‌কে শেষ হওয়ার একবছর আগে। সে আর এক উৎসব, তার নাম ভোট। নির্বাচন প্রক্রিয়া। আর এটাই গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর।

নৈঃশব্দ্য যায়। দুর্বাসা গলাধঃকরণের পর হজম করতে সামান্য সময় নেন। তারপর বলেনঃ বাহ, এ গণতন্ত্র বেশ খাসা জিনিস। অতি উত্তম জিনিস। পান থেকে চুন খসলেই... কৃষ্ণ তাঁকে থামিয়ে দেনঃ অতোটা স্ফটিক-স্বচ্ছ নয় ব্যাপারটা, মুনিনাথ। ভোট জিনিসতা অতো সোজা নয়, সে দুধে জল দেওয়ার মতো অনেক কিছু আছে, বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ব্যালট... তবে হ্যাঁ, গণতন্ত্র সেকালের মানুষদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। আর সেটা ভোট দিয়েই সেষ নয়। ডেমোক্রেসীর ট্রান্সেন্ডেড স্টেজ হলো ডায়রেক্ট ডেমোক্রেসী, লিকুইড ডেমোক্রেসী...

 

শোনো অনন্ত, দুর্বাসা কৃষ্ণকে থামান, তুমি তো জেনেই গেছো, আজ আমি চলবো। তবে দু-তিনদিন পর আবার আমি তোমার কাছে আসবো। তবে এভাবে নয়, সুক্ষ্মদেহে। এই ডেমোক্রেসী ব্যাপারটা তোমার কাছ থেকে আরো জানবার জন্য। আর একটা জিনিস কি জানো...

কৃষ্ণ জানতে চাইলেনঃ কি ঋষিপ্রবর? দুর্বাসা বললেনঃ আমি দুবার আগামীতে গেলাম। আমায় যেটা সবচেয়ে বিস্মিত করলো, সেটা হলো মানুষের সংখ্যা। অগণন মানুষ। এতো মানুষ, তাদের বিশরকম চাহিদা, হাজারো বেদনা, লাখো খোয়াইশে... সৃস্টিতত্ত্বের মূলে ভেজাল যে মিশবে, এতে আর আশ্চর্য কি! এরা অনেক কিছুতে অগ্রসর হয়েছে ঠিকই, আবার অনেক কিছুতে ক্ষয়েও গেছে। আর এটা স্বাভাবিক। আমি পরের দিন এদের নন্দনতত্ত্ব জানবো তোমার কাছ থেকে। এদের সম্পর্কে জানার আমার আর বিশেষ কিছু নেই। এদের প্রতি আমি ব্যথিত। আর ব্যথিত হলে কি আর আগ্রহ থাকে বলো, তুমি। যেখানে জানি, এদের সবকিছুই সময়ের সঙ্গে অমোঘ।

কৃষ্ণ সাষ্টাঙ্গে নমস্কার করেন দুর্বাসা মুনিকে। করে উঠে বলেনঃ অবশ্যই আসবেন। হে সাধকের সাধ, আপনি আমার কাছে সর্বদাই সুস্বাগত।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ    © 

 

 

ফটো কার্টসিঃ  গুগল ইমেজেস 

  

 

ঋণঃ এটিকে আখ্যান হিসাবে পড়াই শ্রেয়। এটুকু সত্যি যে, যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, সেই সময় কৃষ্ণের সঙ্গে দুর্বাসা মুনির একটা সাক্ষাৎ হয়েছিলো। কিন্তু সে সাক্ষাতে ঠিক কি কি কথা হয়েছিলো, সেকথা জানবার কোনও উপায় আজ আর নেই, অন্ততঃ আমার কাছে নেই। প্রথমতঃ আমি সেসময় সেখানে ছিলাম না; আর যদিও বা থেকে থাকি, সেসময়ের স্মৃতি আমার এখন আর নেই। দ্বিতীয়তঃ ঘটনা দিয়ে সময়কে বেঁধে ফেলার মানুষের যে প্রয়াস, যাকে আমরা ইতিহাস বলে জানি, সেই বিষয়ের ওপর আমার একশো শতাংশ আস্থা কোনোকালেই নেই। যে সময়ে কোনও ঘটনা ঘটে নি, সেসময়ের তো তাহলে ইতিহাস হয় না। প্রক্রিয়াগত বাধা তৈরী হয়ে যায়। অথচ কোনও কিছুই ফেলনা যায় না, একটা সময়, যে কিনা মহাকালের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাকে তুচ্ছ করার মতো গর্দভ-বৃত্তির কাজ, সজ্ঞানে থাকলে, আমার না। সুতরাং একটা সম্ভাব্যতার আশ্রয় নিতেই হয়, এখানে জাষ্ট সেটাই করা হয়েছে। কোনো টেম্পোরাল ভুল থাকলে আমি অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। একবার আবার, পুঁথি কনসাল্ট করে এই লেখা পড়লে বাক্যতে বাক্যতে ঝাঁঝিতে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা যে আছে, সে বিষয়ে চেতাবনী দেওয়া রইলো।