Thursday, October 2, 2025

দুগ্গাপুজোঃ ২০২৫ সংস্করণ

 

শরকাল বলতে আমি একদম দূর্গাপূজা বুঝি। মহালয়ার আনন্দটা ফাউ, আর ফাউকে কে-ই বা কবে ভুলে গিয়েছে। তবে তাকে বাফারে রাখি। সপ্তমীতে এসে ওই আমার শরকাল নর্ম্যাল ডিস্ট্রিবিউশনের বেল কার্ভের মতো হলো। ওখানেই যা কিছু মূল্যবান, সব শূন্য। অষ্টমী তার আভিজাত্যে অনেক গমগমে, অঞ্জলী ইত্যাদি; নবমী আনে মায়ের বাপের বাড়ীতে গড়িমসি করে কাল কাটানোর শেষ দিন, সেদিক থেকে দেখলে তার মাহাত্ম্যই আলাদা, ভীষণই অন্যরকম তার ঘ্যাম, মানব মুখু্য্যের সুরে হেমন্ত মুখু্য্যে তো গেয়েই গেছেন, নবমী নিশি রে, তোর দয়া নাই রে, এত করে সাধিলাম, তবু হইলি ভোর।

তা রাত তো জাগেই ভোর হবে বলে, কিন্তু কথাটা সেটা না, কথাটা হলো, রাতের হাত দেখতে গেলে পর আপনি, সকালের আলোর আভাসই পাবেন এসব জেনেও নবমীর রাতকে আটকে রাখার, পায়ে পড়ে বেঁধে রাখার এহেন প্রয়াস... তবুও নিরাভরণ সপ্তমী তার গোলা সিঁদুরের রঙ নিয়ে শিখরে। তার গায়ে পতাকা ওড়ে। মা আসার আনন্দের। শরতের। বলে রাখা যাক, ষষ্ঠী আর দশমীকে ধর্তব্যের মধ্যে ধরার কোনও প্রয়োজন নেই, মানে, আমি অন্ততঃ দেখি না। তা আমি অবশ্য পুজো দেওয়া, রীতি-রেওয়াজ, আচার এসব কিছুই দেখি না; ওসব দেখতে যাই আর আমার চিরকেলে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ পরিক্রমণ ঝাড় খেয়ে যাক... না, না, ওসবে আমি নেই। মা আসছে এই আনন্দ নিয়ে চলকাতে চলকাতে আমি ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের ওপর হামলে পড়ি, অনেক সিনেমা শুরু থেকে শেষ হয়ে যায়, কিন্তু একটাও ফ্রেম আমার দেখা হয় না। কারণ বাহিরে শর তুঙ্গে, ভিতরে মার ভুবনমোহন হাসি, যা নয়ন মুদেই একমাত্র দেখতে পাওয়া যায়। উত্তম কুমারের নশ্বর কিন্তু সুন্দর হাসিটি তো ইয়ে, ক্যালেন্ডারে ঝোলে, ঠাকুর্দার থোলোর মতো।

 

এখন থেকেই অনেকের মুখে শ্রাবণের সন্ধ্যে নেমেছে। কাল ভোলানাথ আসবে গিরিজাকে নিতে; খাঁ খাঁ কিংবা ধূ ধূ করবে একটা জাত, যারা পুজোর দিনগুলোতে সকাল সকাল স্নান করে নিয়েই মুখ তথা মগজশুদ্ধি করে নেয়ঃ ওঁ, দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তো, স্বস্থৈ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি, দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণী কা ত্বদন্যা, সর্বোপকারকরণায় সদার্দ্যচিত্তা। আর তারপর ঠেঙিয়ে যায় পাড়ার প্যান্ডেলে, অঞ্জলি দিয়ে বাড়ী ফিরে প্রসন্ন মনে সিগারেট, বিড়ি, কিছুদিন আগে শেখা খৈনী এবং নবলব্ধ গুটখা চিবোতে চিবোতে মেতে ওঠে খোশ আড্ডায়।

দুপুরের দিকে লুচি, ছোলার ডাল আর পিয়াঁজ-রসুন ছাড়া, শুধু আদা জিরে দেওয়া আলুর দম সাঁটিয়ে মৌজ করে একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে গান ধরে, এত গয়না বেটি কোথায় পেলি? / সিংহীর উপর ধিঙ্গী হয়ে বাপের বাড়ি চলে এলি! / অবস্থা তোর আছে জানা, ভাতের উপর নুন জোটেনা / তবে এত বড়াই কেন পরে বেনারসী শাড়ি? / শিব থাকে শ্মশান ঘাটে, / বুঝি ত্রিশূল দিয়ে সিঁদ কাটে / ভক্তের সঞ্চিত ধন তাই পরে বাহবা নিলি?

আর বিকেলে এক ঘন্টার পাওয়ার ন্যাপ দিয়ে নিয়ে নতুন জামা-জুতো পরে মাকে দেখতে যায় জাগো শক্তি, জাগো স্বপ্ন, জাগো জাগো উমা, জাগো স্পর্ধা, জাগো ইচ্ছে, জাগো জাগো উমা, জাগো বিস্ময়, জাগো স্পন্দন, জাগো জাগো উমা গাইতে গাইতে... সেই তারা আজ বড়ো বিষণ্ণ...

কিন্তু আমা শালা বেজাত, অথবা বজ্জাত; এদের মধ্যে পড়ি না। আর সিম্পলি পড়ি না বলেই ভেবে নিতে পারি, আর মাত্র তিনশো তেষট্টি টা তো দিন, তারপর আবারও মা আসছে। অথচ মা এলে কী করব, জানি না। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে পাঁয়তাড়া কষছি একদিন সন্ধ্যারতির সময় কষে ঢাক শুনতে যাব বলে, পাশে থাকবে অনেক অনেক অনেক ধুনোর গন্ধ -

 

...হয়তঃ ভাবতে ভাবতেই এই জন্মটা যাবে। পরজন্মে এক বাঙালী আবার শারদগন্ধে মাতাল হবে।

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ    ©

 

 

ফটো কার্টসিঃ  !

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে

 

 

 

 

 

Sunday, September 21, 2025

ভয়হীনতার একান্ন বছর

 

 

এরকম নামের একটা লেখা লেখাই যেত, কিন্তু অকারণ জল মিশিয়ে কি লাভ?

আমাদের বাড়ীর একটা জানলার শার্সি ভাঙা। একদম বাইরে না হলেও বাইরের হাওয়া আসে, এমন একটা জায়গা আছে। ছবিটা পরিষ্কার করলে এইরকম দাঁড়াবে - ভাঙা শার্সি যে দেওয়ালে, তারপর বাড়ীর পিছনের দিক, সেপটিক ট্যাঙ্ক, উঠোন, টাইমকলের জলের রিসার্ভার, টিউবওয়েল, - এইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘটনা হলো, বাড়ীর পিছদুয়ারও আছে। আর আমরা সামনের দরজা খুলি না তেমন, পিছদুয়ারই ব্যবহার করা হয়।

ভাঙা শার্সিটার ঠিক পিছনে সেপটিক ট্যাঙ্ক। তারপর বাউন্ডারি ওয়াল।

 

একটু আগে শুতে যাব, তাই ভিতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছি, ওয়াশ বেসিনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে-মুখে জল দেওয়া আমার অনেক  দিনের অভ্যাস। এমনসময় একটা কুকুর ডাকল বাইরে। এটা কোনও কাজের কথা না; কিন্তু আমি আমার জীবনে কুকুরের কান্না তো কমবার শুনি নি, এমনকি কিছু ডাকের অর্থও বোঝা যায়। কিন্তু এই অপরিচিত সুর এবং অদ্ভূত ডুডলিং...

যাঁরা বহু আগে নৃসিংহ রহস্য সিরিয়াল দেখেছিলেন, তাঁদেরকে আমি আশ্বস্ত করতে পারি এই মর্মে, যে, সিরিয়াল শুরু হওয়ার সময় টাইটেল মিউজিকে কুকুরের যে ভয়াবহ-যদিও-কৃত্রিম কান্না মেশানো চেল্লানি শোনা যেত, এটা বৈচিত্র্য তথা গহনের দিক থেকে অনেক হাইয়ার ডিগ্রীর।

আমার চোখ, কারণ শুধোলে বলতে পারব না, গেলো কিছুটা দূরে, ভাঙা শার্সিটার দিকে। দূরের পোস্টের আলো এসে পড়েছে, তেরছা দেখাও যাচ্ছে। কোনও কার্যকারণ না বুঝেই আমি গিয়ে দাঁড়ালাম শার্সিটার ঠিক সামনে। এবার পোস্টের আলো বাঁদিকে কোণ করে, তবে সোজা; বাইরের হাওয়া এসে মুখে লাগছে। আচমকা আমার মনে হলো, এখনই শার্সির ওপারে একটা মুখ এসে দাঁড়াবে। শার্সির ফাটলের ফাঁক দিয়ে আমি তাকে দেখতে পাবো পরিচ্ছন্ন এবং দেখবও। মানুষেরই মুখ, তবে সে আমার পরিচিত হোক বা না হোক, মৃত যে সে, এটুকু নিশ্চিত।

যাঁরা আমায় চেনেন, তাঁরা জানেন ভয়ের অনুভূতিটাই আমার নেই। ওই কিছু মানুষ আছে না, যারা একটা অঙ্গ না নিয়ে জন্মায়, যাদের আমরা অ্যাদ্দিন কানা, খোঁড়া, ল্যাংড়া এসব বলে এসে ইদানীং ডিফারেন্টলি এবল বলতে শিখেছি, অনেকটা তাদেরই মতো, ভয় আমার জন্ম থেকেই নেই।

অথচ অশরীরী, ভূত, প্রেত সবকিছুর অস্তিত্বতেই আমার সায় আছে। তারা থাকে তাদের মতো, আমি আমার মতো; - এক্সিস্টেন্সের বেশ একটা পিস এগ্রিমেন্ট আছে। কিন্তু আজ যে এলো না, অথচ যাকে এক্সপেক্ট করেছিলাম... সেই প্রত্যাশা করার ফাঁকে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করছিলামঃ আমি কি ভয় পাব? পাওয়া কি উচিত? বিশেষ করে যখন এতদিন কেটে গেছে? হাসছিলাম। ব্রাশ করা শেষ হয়ে গিয়েছিল। মিলিয়ে গিয়েছিল কুকুরের ডাক। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মুখে আমার হাসি ঠিকই, কিন্তু আমার শরীর থেকে একটা রিমঝিম অনুভূতি দলা পাকিয়ে উঠে মাথার দিকে চলে গেলো। কপালের কাছাকাছি এলে আমি টের পেয়েছিলাম। টিকলিং ফীলিং একটা, মাথার চুলের ডগা দিয়ে সেই শিরশিরানি বহে বেরিয়ে গেলো।

খুবই মৌহর্তিক ব্যাপার এবং সত্যিকারের হাসিতে ফিরতে আমার কয়েক সেকেন্ড কিংবা তাও লাগে নি; কিন্তু আমি বুঝে গেলাম, মানুষ কি করে ভয় পায়। চোখ না থাকতেও দেখতে পাওয়ার মতো করে আমি ভয়কে দেখলাম। আমারই ভয়, কিন্তু সে আমার অন্দরে নেই, বাহিরে বিলকুল। নেহাত তাই চেনা গেলো; বুঝলাম যে মানুষ নিজেই নিজেকে ভয় পাওয়ায়। এটাও এক ধরনের সোশ্যালাইজেশন।

লিখতে ভুলে গিয়েছি কুকুরের দ্বিতীয় ডাকটা, যেটা অবিকল আগের ডাক, কিংবা কান্নার জেরক্স কপি, কানে এসেছে আগেই, কিন্তু তখন দূরে কিছুটা। তারপর সেটা আরও দূরে সরে যেতে যেতে খান ছয়েক ডাক অথবা কান্নার মধ্যে মিলিয়েও গেলো। এটাও কিঞ্চিত আজব লাগল আমার, প্রতিদিনই তো শুতে শুতে পাঁচটা বাজে, কিন্তু কোনও রাতে ওয়াশরুম ইত্যাদিতে এলে কুকুরের ডাক দলবদ্ধ শুনেছি। কান্নাও সেই একই। একটা কান্না থেকে কিউ পেয়েই তবে অন্য আর একটা কুকুর কাঁদে, কখনো-শখনো সেই কান্নার তল্পি ধরে আর একটা। সচরাচরের প্যাটার্ন অনেকটা এইরকম।

কিন্তু পাড়া ভর্তি কুকুরের মধ্যে একটা ডেকেই যাচ্ছে কিংবা কেঁদেই যাচ্ছে তাজ্জব সুরে, আর অন্যরা নৈঃশব্দ্যে হিরন্ময়, এমনটাও আগে শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

মৌহর্তিক শব্দটা লেখার আগে-পরে ল্যাম্পপোস্টে টাঙানো চোঙা থেকে বাজল তোমার আলোর বেণু ভেসে আসছিল। চমকে গিয়েছিলাম, কেননা, আমি জানতাম মহালয়াটা কাল।

এখন দ্বিজেনবাবু প্রবাহিত হচ্ছেন আর ভোরের বাতাস আরও শান্ত এবং সান্ত হয়ে উঠছে। এই বাতাসকে মাতৃপক্ষ জ্ঞানে ছোঁয়া যায় দ্বিধা ছাড়াই।

 

২০২৫-শে দেখছি সবই অদ্ভূত, মায় মহালয়াটাও!

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ    ©

 

 

ফটো কার্টসিঃ  !

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে