শ্রীময়ী প্রধন্যা মিত্রের লেখনী থেকে -
❝বাবা, আজ পুরুষ দিবসে, এ লেখা তোমার জন্য
================================
যারা আমাকে অনেকদিন ধরে জানেন, আমার লেখা পড়েন, তারা জানেন, আমার বাবা-মা’র প্রিয়তম যে, সে আমি নই, আমার ভাই-ও নয়, আমার জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরাও নয় – সে আমার গডব্রাদার, আমার পিসতুতো দাদা। আমি যদি সমগ্র বিশ্বে কাউকে হিংসে করি, একমাত্র তাকেই। বাবা-মা’র ভালবাসায় ভাগ হয়ে যাওয়াটা আমি বরদাস্ত করতে পারি না, কিন্তু বরদাস্ত করতে হয়, কারন যতটুকু ঘাটতি পড়ে, তার অনেকটাই সুদে-আসলে সে কিছুটা মিটিয়ে দেয় আমাকে ভালোবেসে, বাকিটা আমি আদায় করে নিই।
এত কথা কেন?
কারণ, আমার পিতাঠাকুর, যার সঙ্গে কেবলমাত্র প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পর্ক দৈনিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে, তিনি কি না পড়ছেন একটা আস্ত বই! কাজ থেকে ফিরে, চায়ের কাপ নিয়ে, একটু একটু করে চুমুক দিয়ে প্রচন্ড মনযোগী হয়ে পড়ছেন বইটা। এবং শুধু তাই নয়, বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন, জানলার বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছেন! বই যে খুব পড়ছেন, তাও নয়। পড়ছেন একটু একটু করে, বর্ষাকালে গরম ধোঁয়া ওঠা সুস্বাদু খিচুড়ি গরাসে মুখে তোলার মতো করে, কোন তাড়া নেই। শুধু তাই নয়, মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই গুটুর গুটুর গল্প করছেন, যা সংসারের হিসাব নিকাশের বাইরে। আমি বা ভাই ঘরে ঢুকলে চুপ করে যাচ্ছেন। কেবল চোখে পড়ছে, মায়ের চোখেও কেমন যেন একটা আদুল মেদুল ভাব।
এ কি রে বাবা! হচ্ছেটা কি? এতএব, তদন্ত অবশ্যম্ভাবী।
বইটার নাম ‘ঝাল লজেন’। লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। আমি দেখলাম আড়চোখে, কায়দা করে। এও জানলাম, প্রেরক আমার গডব্রাদার। বইয়ের প্রচ্ছদ হুবহু টিনটিনের প্রচ্ছদের প্যাটার্নগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।
কিন্তু এটা ঠিক আমার হজম হল না। কি আছে ও বইতে? এত মনযোগ দেওয়ার মতো লেখক স্মরণজিৎ চক্কোত্তি আবার কবে থেকে হলেন! মা’র কাছে শুনলাম, গডব্রাদার বইটা বাবাকে দিয়েছে। বলেছে পড়তে, তার না কি ভাল লাগবে। আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়! রবীন্দ্রনাথ না, সুনীল না, এমনকি শংকর-সুনীল-সমরেশ না --- এক্কেবারে স্মরণজিৎ! পাগলা করেছে কি! এদিকে ঝাঁঝেই যে আমার মরণ হওয়ার উপক্রম!
বাবার কিছু কিছু জিনিসে আমার অধিকার আছে। তার অমন সুন্দর চশমার ফ্রেমটা হাতিয়েছি, তার কয়েকটা গোলগলা এবং গোল-না-গলা-কলারওলা টি-শার্ট হাতিয়েছি, তার কিছু কিছু শার্ট, পছন্দ হলে মাঝে মাঝে পড়েছি (বাড়ীতেই), তার প্যাকেট থেকে, ইয়ে মানে, লজ্জার মাথা খেয়েই বলছি, এক-আধবার সিগারেট নিয়ে টেনেছিও। হাজার হোক, আমার বাবা যা যা করে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো আমাকে কৌতুহলী করে তোলে, আমাকেও সেগুলো করতে হবে বৈ কি। এমনকি কিশোরীবেলায়, বাবার অত্তোবড়ো সাইকেলটা চালাতে গিয়ে ড্রেনে গিয়েও পড়েছি, বাবা আর ভাই এসে উদ্ধার করেছেন। বাবা চালাতেন বলে কথা, আমি তো চালাবোই! মা বলে, আমি না কি আমার বাবার ফিমেল ভার্সান।
এতএব, বইটা একদিন চুরি করলাম। শুক্রবার বাবা গেলেন পিসীর বাড়ি। দুদিন থেকে সোমবার কাজ সেরে একবারে ফিরবেন। আমার হাতে তিনদিন সময়। তিনদিন স্মরণজিতের জন্য যথেষ্ট।
“যারা পুরোনো ভাঙা পেন ফেলতে পারে না। ক্লাস টু-তে নীল রঙের হারানো একপাটি মোজার শোকে আজও কাতর হয়। যারা ছোটবেলায় ডনাল্ড ডাক আঁকা টিফিনবক্সের ঢাকনা জমিয়ে রাখে। সবার থেকে লুকিয়ে রাখে কাচের গুলির সেই গুপ্তধন। যারা স্কুলে প্রাইজ পাওয়া নিকেল করা মেডেল রেখে দেয় যত্ন করে। রেখে দেয় ছিঁড়ে যাওয়া প্রথম পড়ার বই। রঙচটা ডায়রির ভাঁজে গোপন সুগন্ধী কাগজের চিঠি, খাম। জমিয়ে রাখে বাসের টিকিট, ট্রামের টিকিট। সেই ‘তার’ দেওয়া লজেন্স আর চকোলেটের র্যায়পার। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রথম ঘড়ি। ভুল করে ফেলে যাওয়া চুলের ক্লীপ। মায়ের কাঠের বাক্সে খুঁজে পাওয়া ছোট্ট সোনালী সেফটিপিন। ক্ষয়ে যাওয়া গন্ধ রাবার। আর শত চেষ্টা করেও যারা আজও ভুলতে পারে না সেই ফোন নাম্বার।” তাদের---
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী উৎসর্গ করেছেন এদের। আমার বাবা কি এদেরই একজন? আমি পড়তে শুরু করি বইটা...
আমি কোনদিন ছ-কোনা কুড়ি পয়সার মুল্য বুঝতে পারব না; আমি কোনদিন ভোকাট্টা বুঝতে পারব না; বুঝতে পারব না টিকটিকি লজেন্স কিম্বা ট্রাম্প কার্ডের মহিমা; কেরোসিন তেলের ল্যাম্ফো কিম্বা হ্যাজাক বাতির মায়া আমি জানি না; কৃশানু দে-র অতিমানবিকতা কোনদিন দেখবও না; রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ভুলে যাওয়া কবিতাকে মনে করার চেষ্টা করা হতবুদ্ধি বালককে আমার কোনদিন আবিস্কার করা হবে না; একান্নবর্তী পরিবারের একটাই উঠানে আমার কোনদিন চড়ুইভাতি করা হবে না; পাঁচদাড়ি অ্যান্টেনা কিম্বা জিলিপি অ্যান্টেনা --- আমি শুনেইছি কেবল; রেডিওর নব ঘুরিয়ে ‘শনিবারের বারবেলা’ কিম্বা ‘দর্শকের দরবারে’ আমি ভাবতেও পারি না; ‘হরেকরকমবা’ কিম্বা ‘নববর্ষের বৈঠক’-এর গল্পই শুধু আমার শোনা হবে; গোল্ডস্পট কোল্ড ড্রিংক্সের বোতলের আইকন কেবল ছবিতেই দেখেছি; যদিও ছাদে মাঞ্জা দেওয়া ইন্টারন্যাশনাল ঘুড়ি-খিলাড়িদের আমি দেখেছি কিন্তু মার্বেল-ডাঙ্গুলি খেলা ছোকরা আমি দেখি নি।
বাবা এসব দেখেছেন। কলকাতার নিকটবর্তী এক মফস্বলে তিনি যখন বড় হচ্ছেন, কিশোরবেলাকার দাড়িগোঁফ গজাবার আগে যখন তার বিস্ময়কর চোখ লোডশেডিং হওয়া রাতের ছাদে কালপুরুষের শিকারী কুকুর খুঁজছেন, একটাই হ্যারিকেনের চারপাশে তারা ভাইবোন মিলে পরের দিনের স্কুলের হোম ওয়ার্ক করছেন, তখন তার ওই বড়ো হওয়াটার মধ্যে যে বিস্ময়বোধ লুকিয়েছিল, বড়োভাই, সংসারী এবং আমাদের ছোট্ট সংসারের অধিনায়ক এই মানুষটা সেখান থেকে কোন টিনের বাক্স নিজের জন্যে আনেন নি। সেই টিনের বাক্স তার বুকের মধ্যে অজ্ঞাতবাস করছে। তাকে তিনি হয়তো ভুলেই গেছিলেন। গন্ধ কাগজের গোলাপী পত্রগুচ্ছ বৃষ্টির জলে ভেসে গেছে নৌকা হয়ে, কিম্বা ফেলে আসা ভাড়াবাড়ির দেরাজের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে... তার মুখ হয়তো তার কখনও মনে পড়েও মনে পড়ে না। তার কাছে সে সেপিয়া টোনের মুখের বয়স বাড়ে নি, হয়তো দুপাশে বেণীবাধা সে স্মৃতিমুখ তিনি আজকের স্খলিত শিথিল কাঁচাপাকা চুলের মাঝখানে রঙীন করে দেখতেও চান না। সেই স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে যে হারিয়ে যেতে বসেছে তাকে নতুন প্রাণদান করেছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, বাবার সমসাময়িক বাবার সহোদর, যা কি না বাবা, কিম্বা তার মতো আরও আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের সময়ের প্রতিনিধি। পার্থক্য এই, স্মরণজিৎ লিখতে পারেন, আর আমার বাবা গুছিয়ে সেটা বলতেও পারেন না। কিন্তু স্মরণজিতের লেখার মধ্যে তিনি নিজেকে খুঁজে পান। মায়ের (আমার ঠাকুমা) একটু স্পর্শ, যে স্পর্শের কাঙাল তিনি, আজীবন, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কাঙালই থেকে যাবেন, স্মরণজিতের মতো।
পড়তে পড়তে আমি বুঝতে পারছি কেন বাবার এত ভালো লেগেছে।
এ বই ভালো, না মন্দ? খুঁত আছে, না নেই? সেই খোঁজে আমি নেই। আমার বাবাকে তিনি এক জানলা আকাশ দিয়েছেন। এতেই আমি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতায় বিচার হয় না। আমি কৃতজ্ঞ বিচারক হতে গিয়ে অকৃতজ্ঞ কন্যা হতে রাজী নই।
================
বিঃ দ্রঃ – ছবিটা রৌদ্র মিত্র-র টাইম লাইন থেকে নেওয়া। কারণ, বইটা পড়তে আমার আরও দুদিন বেশি লেগেছিল। বাবা ফিরে এসে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল। পায় নি। আমি চোর। চোর কি কখনও বামাল সমেত গ্রেপ্তার হতে চায়? পরে খবরের কাগজের ডাঁইতে পুস্তকপ্রাপ্তি হয়ে হারানিধি পাওয়ার মতো বাবা আবার পড়তে শুরু করেছেন। ছবি তুলতে গিয়ে মায়ের কাছে জানতে পারি, বইটা বাবা তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছেন। কাজের জায়গাতেও সময় পেলে না কি একটু একটু পড়ছেন। এতএব... মাঝখান থেকে আমি মায়ের কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। শাস্তি – বেলনের ঠকাস্।
================
ঝাল লজেন
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
আনন্দ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০/-
================
BLOG LINK: https://pradhanna.blogspot.com/2024/11/blog-post_20.html❞
ওফ। এই প্রতিক্রিয়াটা নিজে একটা জার্নি। এটা শ্রী স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর কাছে পাঠানো উচিত।
একজন তাঁর তথাকথিত 'পাঠ-প্রতিক্রিয়া' দিতে গিয়ে পর্যাপ্ত পরিসর নিয়ে সকারণ নিজের অস্তিত্বকে টুকরো টুকরো করে খুলে ফেলছেন, নিজের বাবাকে ভেঙে-ছেনে দেখাচ্ছেন আমাদের। আর সেটাই কি মধুর, কি সুখপাঠ্য। হিংসে জাগে, কাশ, আমিও অমনধারা লিখতে পারতাম। কিন্তু সে হিংসে হারিয়ে যায় একরাশ ভালো লাগায়। অসম্ভব ভালো এবং সৎ প্রতিক্রিয়া পড়লাম। সততা, যা ক্রমশঃ বিলুপ্ত প্রজাতির 'স্টাফ' হয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তঃ ট্র্যাশ-স্টাফড স্টাফ হয়ে যাবে।
স্মরণজিতের উৎসর্গপত্রখানি পড়লাম। এই ২০২৪ শে ৫০কে যখন ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার ট্রেন, এসব নসট্যালজিয়ার কিছু আমারও আছে বৈকি। তাদের আমারও মনে পড়ে... এখানে একটা ছোট ঘটনা বলে নিই? সুযোগ মিলেছে যেকালে; - গতকাল ঊনপঞ্চাশরকম কাজ নিয়ে খাস শহর কলকেতায় যেতে হয়েছিলো। পিঠের ব্যাগপ্যাকে কটা আর জলের বোতল ধরে! অতএব মাঝমাঝেই দশ টাকার পাত্তি উড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কিনা ভাঁড়ের চা-ও আছে। ভাগ্যিস পাইকারী দামে কেনা সিগারেটের প্যাকেট পকেটেই ছিল। তা একরাশ ঘোরাঘুরির পর সান্ধ্য খিদে চাগিয়ে উঠলে গড়িয়াহাটের মোড়ে, বেদুইনের রোল। এগ চিকেন রোলের সঙ্গে মাটন টিকিয়া মিশিয়ে খাওয়ার এক্সপেরিমেন্ট। এসবের জন্যই তো বেঁচে থাকা, নচেৎ কি-ই বা পড়ে আছে আর। তো খাচ্ছি। সামনে জয়িতা, তারও খিদে, মনোযোগ দিয়ে তার রোল চর্বন, চর্বিত চর্বন, দুজনেরই, কিন্তু খিদেটা তো নতুন। আমাদের যৌথ সখীর মঙ্গলবার। হুনুমান (হনুমান পড়বেন না, প্লীজ) জী'র বার বলে কথা। আমার একঝলকে মনে হলো, কত লোক হুনুমান চালিশা পাঠ করে গভীর ভক্তিতে, সদ্যগজানো পওনপুত্তরের মন্দিরে, আর ফিরতি পথে, বাড়ীর চালে একগাদা হনুমানের দল এসেছে দেখলে ঢিল মারে, জমিয়ে রাখা চকোলেট বোম ছুঁড়ে মারে। এসব করে, করতে বাধ্যই হয় একপ্রকার নচেৎ, সাধের কিচেন গার্ডেন তছনছ হয়ে যাবে যে! সে যাক গে, তাদের কর্ম তারা করুক, আমার কর্ম আমি - মেনে রোলে আস্তে আস্তে কামড় বসাই। কাগজের রোল অল্প অল্প ছিঁড়ি। সবই তো ইউটিলিটি কার্ভের স্পর্শকের কোণটাকে স্টিফ করে দেওয়ার জন্য, যত ফ্ল্যাট থাকবে সেই সে স্পর্শক, মার্জিনাল ইউটিলিটি তো তত তাড়াতাড়ি কমবে। বেসিক সেকেন্ড অর্ডার ডেরিভেটিভের ভ্যালু। রোল কর্ণারের সবাই গহন অভিনিবেশে নিজ পছন্দের রোলে ব্যগ্র, এমন সময় এক প্রৌঢ়, এই আমার চেয়ে কিছুটা বড়, কাঁপা কাঁপা হাতখানি বাড়িয়ে... যাঞ্চার শব্দ তার জড়ামড়ি করে একাকার। পোশাক রীতিমত ভদ্র, কিন্তু মুখে অধীর অসহায়তার ছাপ বড়ো সততার সঙ্গে, এমনই হদিশ পাই আমি। এই সময়গুলোয় আমার জন্মদাতা বাবাকে বড়ো মনে পড়ে আমার, কোনো একটা অসহায় মানুষকে দেখলে, সে কিছু চাইবার আগেই, পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা উঠে আসত, দিয়ে বলতঃ কিছু খেও। পাশ থেকে কেউ, _ দা', ও সত্যিকারের ভিখিরি কি না, সেটা না জেনেই তুমি... বাবাকে তার কথা পুরো গিলে নিতঃ চোপ শালা, ভিখিরি কি রে? ওটা আবার কি কথা। খিস্তি দিচ্ছিস, নাকি? ঈশ্বরকে লাখ প্রণাম দিস যে তোর চলে যাচ্ছে। একটা অসহায় মানুষ... আমার মনে হয়, বাবার ছিল সেই ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর - এর দশা, অরুণকান্তি যোগী মালিক, ভিখারি সেজে নীরবে এসে হেসে দাঁড়ানোর বদলে গোঙানি, কাতরানোর আওয়াজে এসেছে মনে করে, সব কাঙালের মধ্যে মালিককে খুঁজে বেড়াত। তা পায় নি, নইলে তো রিক্ত হাতে বাড়ী ফিরে দেখতে পেত কিষাণবিকাশ পত্রের অ্যাক্সিলের্যেট্যরি এফেক্ট, নিমেষের মধ্যে যেটুকু দান, ফিরিয়া আসিছে তাহারই দ্বিগুণ। কিন্তু কই, অভাব তো তবু্ও আমাদের কণামাত্র ছিল না। তখন। বরং বাবা মরে যাওয়ার পর ইদানীং অভাব এসে ঝাঁকি দিয়ে যায় ঘরে। এই অভাবই এসে জানান দিয়ে গেছে আমাদের, ক্যানসার রোগ একজনকে মারে, আর ক্যানসার রোগীকে টিকিয়ে রাখা রোগীর পরিবারের সবাইকে মারে।
রোলের গন্ধে, মানুষের তৃপ্তির উদগারে বেদুইন চত্বর যখন ধুন্ধুমার, আমিও আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে... কিন্তু আমার পকেটে এখন, এই অবেলায় হাত ঢোকালে কতই বা বেরোবে আর, বড়োজোর এক কি দুজনের একটা স্কোয়ার মিল মিলতে পারে মাত্র; সুতরাং আমি বলিঃ কিছু খেও। কিন্তু তোমার হাত অমন কাঁপছে কেন? উত্তরে সে যা বলে, আমি জানতে পারি, তার স্পাইনের এল ফোর আর এল ফাইভের মধ্যের বিরাট ফাঁক, সঙ্গে দাঁড়িয়ে ফিকফিক করে হাসছে স্পন্ডিলাইটিস, তার অপারেশন দরকার। তার স্ত্রী র্যিহ্যউম্যেট্যয়েড আর্থ্রাইটিসের পেশেন্ট, তাঁর ওষুধ জোগাড়ের পয়সা সে করে উঠতে পারেনি তখনো। আবারও একবার আমার মনে পড়ল, সাধ করে রেজিগনেশন দিয়ে আসা আমার শেষ চাকরিটার কথা, সেটা থাকলে অনায়াসে নিঃখরচায় তাদের সুস্থ করে তোলার জন্য যে কোঅর্ডিনেশন লাগে, সেটা করে দিয়ে আসতে পারতাম আমি। এখন আর পারি না; তাই দেখে যাই, দেখে যেতে হয় অগণন মানুষের অজস্র কাতরতা, যন্ত্রণা।
আমারও কি নসট্যালজিয়া নেই? - আছে। পুরোদস্তুর আছে। একটা আকাশের মতো ফাঁকা ছাদের মধ্যে কৃশাকৃতি অ্যান্টেনা, তার ওপর বুস্টার, চিত্রহার, চিত্রমালা, সাপ্তাহিকী; রোয়াক, পাড়ার সদ্যতরুণ দাদাদের আড্ডা, মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল, রোসি বনাম জিকো, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত, কিরণ মোরেদের ছাপিয়ে সদানন্দ বিশ্বনাথের জন্য হাহাকার (এর ফাঁকে ঢুকে আসতেন সেসময়ের বয়োজেষ্ঠ্যরাঃ ওরে, পিকে ব্যানার্জি কোনোদিন মোহনবাগানের জালে নিজের পায়ে বল ঢোকায় নি রে, আমাদের চুনী তোদের সক্রেটিসের সমান মানের খেলোয়াড়, বল প্লেয়ার ছিল সে, গেমমেকার ছিল সে, বুঝলি। তোরা তো দেখতেই পেলি না চুনীর খেলা, বলরামের খেলা, মঙ্গল পুরকায়স্থ'র খেলা। গাভাসকার তো বটেই, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথও খোলা মাথায় ওইসব দানবের মত ফাস্ট বোলারদের শুধু কবজির মোচড়ে...), জ্যোতি বসু-ইন্দিরা গান্ধী / রাজীব গান্ধী- বোফর্স কামান, কম্পিউটার; বিয়ে বাড়ীর এইচ লেখা কার্ডবোর্ড-কাঠের চেয়ার, কাগজের রোল, কলাপাতা, নুন, লেবু, শেষ পাতের দই; পাড়ারই বৃদ্ধ কেউ আচম্বিতে অসুস্থ হয়ে পড়লে হলদে ট্যাক্সিতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, সামনের সীটের জন জানলা থেকে হাত বের করে লাল সালু দোলাবে, হাসপাতালে তাদেরই রাতের পর রাত জাগা, তিন চাকার টেম্পোতে করে হাসপাতাল থেকে তাদের মৃতদেহ আনা; জীবনের প্রথম এবং শেষ পাব্বুনি (পার্বণী) যার মধ্যে ছিল, থাক একটা 'সম্ভবতঃ' থাক এখানে, দুটো কুড়ি পয়সা, দুটো দশ পয়সা, একটা পাঁচ পয়সা এবং তাতে হয়েছিল তিনটে ফুচকা, গাদাখানেক চুড়মুড়, একটা গ্যাস বেলুন, দুটো এমনি বেলুন আর তিন-তিনখানা সাপ বেলুন; যখন আমি কিছুটা বড়ো তখন গোল্ড স্পটের দাম দু টাকা পঁচিশ পয়সা; আমার জীবনে হিন্দী ডিস্কো গানের বাতায়ন খুলে দিত ওয়েসিস মনের মত গান, মনে রাখা কথা, বিবিধ ভারতীর অনুরোধের আসর টপকে শ্রাবন্তী মজুমদারের মিস্টি মিস্টি কথা তখন নতুন ও ফলতঃ, কর্ণাভিরাম, আমি তখন এক কি দুই কেলাসের, বিড্ডুর সুরে আপ য্যায়সা কোই মেরী জিন্দেগী মেঁ আয়ে বোধহয় আগে শুনে ফেলেছিলাম (কার্টসিঃ পুজো প্যান্ডেল বা কোনো উৎসব ম্যারাপ), কিন্তু অ্যায় মেরী য্যায়সী হাঁসিনোঁ কা দিল ইঁহা জিসসে মিল যায়ে ওইখান থেকেই আমি পিক করে নিয়েছি, যা আজও আমার পোর্টেবল এম থ্রি প্লেয়ারে আছে... বাজেও, মাঝেমধ্যে, আংরেজি মেঁ কহেতি হ্যায় কি আই লাভ ইউ গানটিও ওখান থেকেই প্রথম শোনা, খুব একটা পছন্দের থাকে নি যদিও; আর শ্রাবন্তী মজুমদারের কন্ঠ চুপ করে যাওয়ার তিরিশ মিনিট পরই শুরু হত হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্সের শনিবারের বারবেলা এবং আমার মাঃ অ্যাই, দুটো বাজে। খেতে বোস; ডাংগুলি খেলতে যাওয়ার আগে বাবা পইপই করে মনে করিয়ে দিত পিল থেকে প্রথম শটটা কেউ যখন তুলছে, নিজের চোখকে খেয়াল রাখতে, গুলির টিপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে বামহাতে খেলা শুরু করেছিলাম, এই একটা খেলায় আমার বোধহয় কনজেনিটাল স্কিল, আমি গুলি জীবনে দুবার কিনেছি, বাকী কৌটো কৌটো গুলি... ইয়েস, লোটা মাল, লাল লাঠি খেলার সময় খাট দিতে গিয়ে ভয়ানক কান্না পেত, মনে আছে, একবার মিশনপল্লী থেকে ভাড়াবাড়ী প্রায় কিলোমিটার খানেক পথ খাট মেরে আসতে হয়েছিল, গজে খেলতে আমার কোনদিনই ভাল লাগে নি, বাদবাকী যে খেলাই আমাকে শেখান হোক না কেন, পরিত্রাণের সহজ রাস্তা আমার জানাই ছিলঃ ধূস, এ তো মেয়েদের খেলা, আসলে লাল টুকটুকে গাছপাকা ফলের মত বলটা আমায় টানত, হাতছানি দিত বড় সাইজের বলটাও যেটা পায়ের জন্য, আর কিছু কিছু তেমন পায়ের জন্য সবাই সেসব পায়ের ওপর পড়ে, এই নির্মল আকুলতা আবহমান; তখন তো বিকেলের দুটো গন্ধ থাকত, এক গন্ধ গোধূলির, অন্যটা মিছিলের, শ্লোগানের, পরে, কিছুটা বড় হলে যখন কিনা কৈশোর ভাঙছে, লোকাল কোঅপারেটিভে গেলে এবং সেখানকার কোনো কর্মী, যিনি রেনিগেড (ডিজেনারেটেড?) বামপন্থী, কাউকে মার্কিন কাপড় দেখালেইঃ এ কি গো _কাকা, মার্কিন কাপড় ঘিয়ে রঙের? তাঁর জিজ্ঞাসু চোখ, সম্ভাব্য ক্রেতার জিজ্ঞাসু চোখ... বলতেই হত, মার্কিন কাপড়কে তো কালো হতেই হবে। মনে নেই, মার্কিন সাম্রাজ্যের কালো হাত - ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও, বাকী যা কিছু অর্থাৎ রেস্ট অফ দ্য ওয়র্ল্ড সব সাদা, এভারেস্টের চূড়ার মত সাদা; এবং আরও বড়, এটা ২০০৪ - '০৫ এর কথা, ধানবাদ ষ্টেশনে রাজধানী এক্সপ্রেস থামলে এবং ভাঁড়ের চায়ের পর দাম চুকোতে গেলে দৈববাণী শোনাঃ বাবু, ইঁহা পর চৌ আনি নেহী চলতি; ওহ, এটা লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম, ঠিক হ্যায়, এখানেও লেখা যাবে, তবে তার আগে দূরবীন আর একটু ঘোরানো ভালো, সেটুকু ঘোরালেই একটু বেশী দূরের ছোটবেলা, ওই যেখানে গজে, খো খো, কাবাডি এসব খেলাকে এড়িয়ে আপন করে নিচ্ছি পিট্টু, কিড়িং কিড়িং, টেবল টেনিস খেলাগুলোকে, ঠিক সেখানে ধানকাটার পরপরই বাদা ফাঁকা হলে শুরু হত আমাদের বাঁশ পুঁতে মাঞ্জা চড়ানোর (সুতোয়) পালা, বাদার একধারে ছিল ভাগাড়, অনেকে ভূতের ভয় দেখাত আর বাবা বলে দিয়েছিলঃ ধুস, তুই মানুষ। অন্য জীবের ভূত তোর কি করবে, ইন ফ্যাক্ট, কোনো ভূতেরই কিস্যু করার ক্ষমতা নেই। তুই তো ভীষণ ডিটেকটিভ গল্প পড়িস, তুইই বল, কোনো মানুষ কি খুন হওয়ার আগে মরে যেতে চায়? অথচ মরার পর তো জেনে যায় কে তাকে মারল, তাহলে তারা প্রতিশোধ নেয় না কেন? কারণ খুব সহজ, পারে না বলে; তো একদিন মাঞ্জা দিচ্ছি, ছেঁড়া শাড়ীর পাড় মাঞ্জার পাতলা লেইতে ভিজিয়ে, গভীর মনোযোগে, হঠাৎ হাত পাঁচেক দূরে একটা বড়ো পাখি এসে ঝাঁপিয়ে বসল, পরক্ষণেই উড়ে যাওয়ার সময় ঝলকের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম মেরি বিস্কুট রঙয়ের একটা সাপ, তখনো দড়ি পাকাচ্ছে তার নখের পিঞ্জরে, আবার বাবা, পাখির রঙ পাঁশুটে (পাংশুটে) এর ওপর কালো ছিট ছিট শুনে বললঃ হুম, বাজ। ঈগলের ছোটভাই। আর সাপটার রঙ? - সব শুনে টুনে বললঃ পদ্ম গোখরো। খুব বেঁচে গিয়েছিস। সাপের রাজা হলো গিয়ে ওই গোখরো। কামড়ানোর আগে ভয় দেখায়। কেউটে সাপের মত নয় যে নিজের ছায়াকে ছোবল মারবে। তবে খুব বিষাক্ত। গোখরো নামটা কোত্থেকে এলো বুঝতে পেরেছিস তো? - গরুর ক্ষুরের মতো একটা দাগ ফণায় থাকে বলে, এহ, একবার ফণা তুললেই দেখতে পেতিস; পরবর্তীতে ব্যোমকেশ পড়তে গিয়ে অজান্তে সঁতে হয়ে গিয়েছিল, গোক্ষুরা --> গোখুরা --> গোখরা --> গোখরো। ধ্বন্যালোপ আর ধ্বন্যাগম। কিন্তু বলা গেল না, কেউটে আর গোখরো বলে আলাদা কিছু হয় না, সবই কোবরা, এদের গোত্র আছে, গাঞী হয় না, অ্যাডাল্ট প্রতি মারণ ডোজ ১৮.৬ মিলিগ্রাম, সবার, যেমন বলা হয় নি, সেদিন সাপটাকে আমরা বন্ধুরা আগেই দেখেছিলাম, বাকীরা পালিয়েছিল মাঞ্জার মালপত্তর ফেলে, একমাত্র আমি ছাড়া, আর ওদের পালানোর সময় পায়ের শব্দের কম্পনেই ফণা তুলেছিল সাপটা, আমার দিকে পিছন করে, তাতেই দেখে নিয়েছিলাম গোক্ষুরা'র চিহ্ন, আমার সারাজীবনের জন্য একটা ছোট্ট পাওনা হল, আমার বাকী বন্ধুরা দেখতে পায় নি যে ফণা তোলার জন্যই সাপটাকে আরও ভালো স্পট করে নিয়েছিল বাজটা, কারণ ফণা নামানোর মিনিট খানেক পরই তার ছোঁ এসে নিয়ে যায় তাকে, শমন যথা, দেখতে পায় নি পালিয়েছিল বলে, আমি পালাই নি বলেই দেখেছিলাম, আমি এরকম দেখতে পাই কারণ আমি পালাই না। তবে ২০২৪ এর আমি-সংলগ্ন পৃথিবী স্বতন্ত্র একটা কথা। একে আর নেওয়া যাচ্ছে না...
রঙচটা ডায়রির ভাঁজে গোপন সুগন্ধী কাগজের চিঠি ইত্যাদি বৃত্তান্ত থাকলে হয়তঃ মহড়া নিতে পারা যেত, কিন্তু নেই যে। যেমন নেই, কোনো কিছু জমানোর বাক্স। আমি যা লিখেছি মুছি নি কোনোদিন, মোছার নয়, মুছবো বলে তো আর লিখি নি - আর তাই পেন্সিল নয়, খুব ছোটবেলা থেকেই আমার হাতে, নাহ, ফাউন্টেন পেনও নয়, পাতি ডট পেন, পরে বল পয়েন্ট পেন ('লেখার সময় কালি শেষ হয়ে গেলে ভরো রে, লেখা ভালো না পড়লে ঝাঁকাও রে, অ্যাটেনশনের দফারফা হয়ে যাবে। লেখাপড়া একটা সাধনা। ওটার জন্য সততা লাগে, দেহ লাগে, শপথ লাগে, সময় লাগে, তীব্র ইচ্ছে লাগে, নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া লাগে। এসময় কাউকে বিরক্ত করতে নেই।' - মম পিতৃউবাচ, যার প্রতিটি ধ্বনিকে আমি সমর্থন তো করিই, উল্টে কিছু যোগও করি।), সুতরাং গন্ধ রবারে আমার কি বা প্রয়োজন, তবে এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত হাজার পাঁচেক অচল কলম ডাঁই করে রাখা ছিল ঘরের একটা ধারে, তাদের মধ্যে আমি আমার পাঁচ-ছয় বছরকে দেখতে পেয়েছি অনেকবার। সুখের কথা, তাদেরকে হটানো গেছে। আরে, মাটির দেহ মাটি হবে, পুড়ে হবে ছাই, এ দেহ পচা দেহ, গরব কিসের ভাই যখন, মামুলি এক পেলাস্টিকের কলম আমাগো কোন কামে আইবো!
এখনো মনে পড়ে, বছর তিরিশেক আগের এক সদ্যযুবককে, টিউশনি সেরে ফিরতি পথে ছাতিম ফুলের গন্ধে, বোধহয়, মাতোয়ারা হয়েই সাইকেল থামিয়ে বসে থাকে সে সীটের ওপর, তারপর ল্যাম্পপোস্টের ষাট ওয়াটের বালবের সিল্যুয়েটে জামার হাতায় ঘনঘন তার মাথা নামানো এবং পিঠের নড়াচড়া দেখে বোঝা যায় সে ছেলে হাউহাউ করে কাঁদছে। আসলে হয় কি - পার্থেনিয়াম গোত্রের এ গাছের ফুলের গন্ধ বিষাক্ত হলেও মনে সে করাবেই আসন্ন শীতকালের কথা, আর সেসব দিনগুলোতে ফেলে আসা শীতকাল দিয়ে আগুয়ান শীতকালকে প্রতিস্থাপন করে দেওয়া যেত বিনা আয়াসেই। আমার পরিষ্কার মনে পড়ে, সে রাতে, স্মৃতির এরকমই কোনো এক শুঁড়ি পথ দিয়ে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম একেবারে ছোটবেলায়, যে সময়টা আমার মামারবাড়ীতে কেটেছে, সেই সময়তে। সেসময় শুক্কুরবার রাত আটটা দুইয়ে কলকাতা ক তে নাটক। গোপালমামা আসত, সঙ্গে তার সোনারপুর থেকে রাজপুর (৬ কিলোমিটার মত দূরত্ব) - এর রাস্তাটা ঢেকে দেওয়া যায় এমন এক চাদর। বস্তুতঃ স্কুলে সারাদিন হুটোপুটির পর ওইসময় আমার ঘুম পেয়ে যেত। ঘুম পেলে অথচ ঘুমোতে না পারলে, সে বয়সে কান্না ছাড়া আর সম্বল কি? কিন্তু গোপালমামা ঠাহরাত অন্যরকমঃ শীত করছে তো। কেন যে তোরা ওকে গরম জামা পরাস না... আয়, আমার কাছে আয়। আমিও সেঁধিয়ে যেতাম সে চাদরের নীচে, ক্ষারের গন্ধ, ঢুলুনিটা আরও পোক্ত হয়ে উঠত। না দেখেও দেখতে পেতাম, গোপালমামার সামনে থালা, সেখানে এসে পড়ছে গরমাগরম রুটি, পাঁচ মেশালী সব্জীর ঘটি বাড়ীর রান্না। শেষ রুটি জয়নগরের নলেন গুড় দিয়ে, সযতনে জিরেন দেওয়া। এখানে বলে রাখা ভালো, ঘটিবাড়ীর রান্নায় চিনি তো চিরন্তন, কিন্তু সব রান্নায় পিঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতা, কারিপাতা তখনও ঢোকে নি, মাছ ছোট আর টাটকা হলে জিরে-ধনেগুঁড়ো দিয়ে হলুদগোলা ঝোল, ইদানীং তো দেখি, সব রান্নাতেই মিনিমাম এক-দেড়খানা পিঁয়াজ, জিঞ্জার-গার্লিক পেস্ট, আর ধনে পাতার কুচো দিয়ে গার্নিশিং। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সামান্য দূরে থাকা সেই দিনটা যেদিন মিস্টির দোকানে একটা ভোজনরসিক-তবে-ফুডি-নয় লোক এক প্লেট মিহিদানা নিয়ে বসেছে, মিহিদানার ওপর ধনেপাতার সবুজ কুচি হলদে সবুজ ওরাংওটাংকে মনে করাচ্ছে, এপাশ ওপাশ থেকে উঁকি মারছে কারিপাতা, আর পাশে, তুলনায় ছোট একটা প্লেটে কুচোনো পিঁয়াজ চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে।
গোপালমামা রুটি শেষ করেও চটচটে হাতে বসে থাকত, কেননা, বেশী নড়াচড়া করলে আমার চটকাটা ভেঙে যাবে, আর ওদিকে, রেডিও'র নাটকেও ক্লাইম্যাক্সও তখন ওই আসে ভৈরব হরষে। নাটক শেষ তো রুটিপর্ব শেষ, মা খাঁচা থেকে মুরগী বের করার মত করে গোপালমামার চাদরের অন্দর থেকে নড়া ধরে আমায় বাহার করে নিয়ে বরাদ্দ খাবার নিয়ে পড়ত, আর গোপালমামাকে বলে দিতঃ গোপলা, কাল কিন্তু দেরী করিস নি। ঠিকঠাক সময়ে ছেলেটাকে স্কুলে পৌঁছে দিস। বস্তুতঃ এটাই ছিল গোপালমামার কাজ। এর বাড়ী, তার বাড়ীর ফাই ফরমাস খেটে দেওয়া আর বদলে দু'বেলার পেট ভরা খাবার। তবে এ ডিশটা এলিট ডিশ, গোপালকে না দিলেও চলবে'র মত আরবান স্নবারি, ক্লাস ডিস্ক্রীমিনেশনের মিনিয়েচার আমাদের চত্বরে তখনো আসে নি, সব খাবারই গোপালমামাকে দেওয়া হত, পেট ভরার তৃপ্তি, নাটক শুনতে পাওয়ার তৃপ্তি নিয়ে গোপালমামা রওনা দিত নিজের ঘরে, শীতের দাঁতালো ধার থেকে বাঁচবার জন্য কেউ তাকে, তার জন্য, এমনকি তার ভাইয়ের অন্নে বাঁচা মায়ের জন্যও দার্জিলিং কি নেপাল মায় কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে এনে দিয়েছে মোটকা, ধুমসো কম্বল; ওম তারা পর্যাপ্ত দেয়। গোপালমামার তাড়া অন্যত্র, এক তো ঘুম পাচ্ছে, আর দুই, কাল _ দা (মম পিতাশ্রী) কড়ার করে রেখেছে এক নাগরি খাঁটি খেজুর-রস এনে দিলেই সন্ধ্যেবেলা তিন প্যাকেট চার্মস, গোপালমামার ফেবারিট স্টিক। একটা চাকরী জুটলে গোপালমামা চার্মসের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিত, _দা (সেই একই লোক, মম পিতাশ্রী)'র মত অন্ততঃ ছ প্যাকেট তো ফুঁকত, এক দিনে-এক রাতে, _দাও ওই ষাটটাই খায়, তবে চারমিনার, ওটা ভীষণ কড়া লাগে তার। কিন্তু না, গোপালমামার চাকরি হয় নি, পাড়ার সবাই ওকে ভালোবাসে, পাড়ার সবাই এর, ওর, তার ছেলের, এমনকি, জনা কয়েক মেয়েরও চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছে, গোপাল তাদের ভাইয়ের মত, কারোর ভাইপোর কাছাকাছি, তারা সবাই গোপালের জন্য করেছে, করছে, করবেও। করবে গোপালের মৃত্যু অবধি। তবে এগারোটা কেলাস পাশ দেওয়া, বোর্ডের পরীক্ষা পাশ দেওয়া গোপালকে তারা চাকরীটা করে দেবে না। পৃথিবী জিলিপি হয়ে যাচ্ছে, অতো সহজ, সরল ছেলে দেখে কেউ যদি কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দেয়, কে পোয়াবে সে ফ্যাচাং? কে সামলাবে সে ঝঞ্ঝাট? একটা আগো-তাগড়া ছেলে, গানের সুরে মিঠাস থাকলেই তার ভাব এসে যাবে! মুখে ঠাকুর নয়, কুকুর নয়, সারাক্ষণ, আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম রাবণ আছে... চলছে কোথায় রাত কে জানে, তা কেউ যখন জানে না, তখন তোর ওতো ভাবসমাধির কি আছে রে, ছোকরা! রাতে ঘুমোবি মোষের মত, সকালে খাটবি গাধার মত। এ ছেলেকে পিওনের চাকরী করে দিলেও দুদিনের মধ্যে সবাই তার জাত বুঝে যাবে, তারপর একটা গ্রামাফোন আর খানকয়েক রেকর্ড দিলেই হয়ে গেল, তারপর দু খানা করে রেকর্ড, আর এ ছেলে ফাইলের নোটশিটের পাতা খুলে দেখাতে, এমনকি টুকে নিতেও সময় করে দেবে। ঘুষ, কালোবাজারি এসব গোপালমামার কাছে নক্ষত্রপারের জিনিস। সে বোঝে প্রীতি উপহার। এর বাইরে তার জানা যায় না। সে যাক বা না যাক, যা হওয়ার নয় তা নিয়ে ভেবে, এই ঘরে ফেরার সময় গোপালমামা আর চাপ বাড়াতে চায় না; তা রসের দামও _দাই দেবে। গোপালমামার শুধু যাওয়া আর আসা। শুধু স্রোতে ভাসা।
কিন্তু ভাসতে ভাসতে হঠাৎ করে চড়ায় ঠেকে গেল গোপালমামা। আমি যখন ক্লাস সিক্স, নরেন্দ্রপুর মিশন থেকে পুজোর ছুটিতে বাড়ীতে, একদিন টালির চাল থেকে স্বহাতে লালিত চালকুমড়ো পাড়তে গিয়ে ফাটা টালির ওপর কনুই রেখে ফেলল সে। নীচে বাঁশের খাঁচা পচে গিয়ে মচমচ করছে। একটা টুসকি ঢুকে যাচ্ছে বাঁশের ভিতর। সেসব তো আর তার জানার কথা না। চালকুমড়োকে ধরে রাখবে দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত সবল টালি এমনই জানা ছিল তার। ফলতঃ ব্যালেন্স হারিয়ে যাওয়া, ফলতঃ পড়ে যাওয়া, ফলতঃ পড়ে গিয়ে হাতে টালি ভেঙে হাতে ঢুকে যাওয়া। তার মুখ নাকি যন্ত্রণায় নীল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোপালমামার মুখে নাকি তখনো হাসি, নীলচে হাসি নিশ্চয়!
কিন্তু গোপালমামাকে কি দেখার লোকের অভাব? তাছাড়া ঢুকেছে তো একটা টালি, বার করে স্টিচ করে দিলেই হবে, ক্লাবের ছেলেরা গোপালমামাকে, তাদের গোপালদাকে সতর্ক নিয়ে গেল গোরা ডাক্তারের চেম্বারে।
গোরামামা হাসিখুশী মানুষ। রোগীদের সঙ্গে রসিকতা না করে আমোদ পায় না। গোরামামা, গোপালমামাকে দেখে বলে উঠলঃ গোপাল তুই? তোর আবার কি হলো? যেন গোপালমামা কোনও কিছু হওয়ার আউটার জোনের মানুষ। গোপালমামার ক্ষতটা একবার লহমায় দেখে নিয়েই গোরামামা বললঃ তোরা এক কাজ কর। মেডিকেলে নিয়ে যা ওকে। সবাই বিস্মিত, বিহ্বল সমস্বরে প্রশ্ন এলঃ সে কি গোরাদা, মামুলি একটা টালি ফুটেছে, আর তুমি (খেয়াল করুন, সেসময়ের সোনারপুরের সফল এবং ব্যস্ততম ডাক্তারকে এরা দা বলে ডাকছে, সম্মোধন চলছে তুমি-তুইতে, কারণ, গোরামামাও ছুটি নেয় পটাপট, দুমদাম চেম্বার বন্ধ রাখে, তারও ফুটবল খেলা আছে, মাছ ধরা আছে। বিভিন্ন ক্লাবের ছেলেরা তার একান্ত কাছের। সদা হাসিমুখ (কয়েক বছর আগে গোরামামার বড় ছেলে, আমাদের ঠেকের দীপাঞ্জন চলে গেল লাঙ ক্যানসারে। তারপর গোরামামাদের শরিকি বাড়ীটা বিঘৎ জমিসমেত কিনে নিল দালালেরা, রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, গোরামামারা উঠে গেল ভাড়াবাড়ীতে, এখনো সে কাজ শেষ হয়নি, কিন্তু আর গোরামামার হাসিমুখ, স্টেথো তো দূর, গোরামামাকেই আর দেখা যায় না, নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছে সে) বলছ এতটা পথ ঠেঙিয়ে সেই মেডিকেলে নিয়ে যেতে। এহ, গোরাদা, স্টিচ করে ক্যাপসুল (মানে, অ্যান্টিবায়োটিক) চালিয়ে দাও। গোপালদা শক্ত আড়ার লোক, তিনদিনে ঘা টেনে যাবে, খাড়া হয়ে যাবে। গোপালমামার মুখে তখনো সেই অম্লান হাসি। তবে নীলাভ। সেই হাসিটা অনভ্যাসের হাসিহীন মুখে খানিকক্ষণ দেখে নিয়ে গোরামামা বললঃ যা বুঝিস না, সেটা নিয়ে প্যাঁজ-ফুলুরি ভাজতে যাস না। কড়া উল্টোবে। ওটা টালি নয়, ওটা গোপালের হাতের হাড়, ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। ওটার জন্য অপারেশন করতে হবে। তোরা নিয়ে যা, আমি স্যারকে ফোন করে দিচ্ছি। আজই সব হয়ে যাবে।
সেদিন কিন্তু কিছুই হয় নি, কারণ গোরামামার স্যার আউটষ্টেশন ছিলেন, রাতের দিকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পেরেছিল গোরামামা। সব শুনে তিনি বলেছিলেন, তিনি নিজে ওটি করবেন, তবে পরদিন বিকেলের দিকে।
ঘটনাটা ঘটেছিল একটা দিনের বেলার দিকে, তার পরের দিন সন্ধ্যের মুখে মেডিকেল কলেজের অপারেশন থিয়েটারগুলোর কোনো একটায় গোরামামার স্যার গোপালমামার হাতে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে টের পেলেন, হাতের ক্ষত টক্সিক হয়ে গেছে। তিনি স্টাফদের শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলেনঃ তোমরা কেউ পেশেন্টকে অ্যান্টিটিটেনাস কিছু দাও নি? তারা জানিয়েছিল যে, তারা ভেবেছে যে পেশেন্ট টক্সাইড পেয়েছে বাড়ীতেই বা লোকাল ডক্টরের চেম্বারে। রেফারার তো একজন আছেন। এই কলেজেরই আল্যুমনাই। গোরামামার স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেনঃ এখন অপারেশন আর সম্ভব নয়। তোমরা পেশেন্টকে বেলেঘাটা আই ডি তে শিফট করে দাও। পেশেন্টের উন্ডে গ্যাংরিন ক্রিপ করে গেছে। ওখানে পেশেন্টের কন্ডিশন যদি ইমপ্রুভ করে, তো দেখা যাবে।
বেলেঘাটা আই ডিতে বন্ধু গোপালকে পরদিন দেখতে গিয়েছিল আমার ছোটমামা, হাতে যন্ত্রণা নাকি বেড়েছে, তা ব্যান্ডেজ খুললেও কি, না খুললেও বা কি, যন্ত্রণা তো আর দেখা যায় না। গোপালমামা চিন্তার অতল থেকে ভুস করে ঘাই মেরে উঠেঃ হ্যাঁ রে মনু, গ্যাংরিন হলে হাত কেটে দেবে নাকি? তুই জানিস কিছু? এই গম্ভীর প্রশ্নের মুখে পড়ে গেলে হতবুদ্ধি হওয়া ছাড়া কমোনারদের আর কোনো উপায় বোধহয় থাকে না বিশেষ, তেমনই এক বিবশ গলায় আমার ছোটমামাঃ জানি না। মনে হয় কেটে দেয় না। গোপালমামা তখনো বিভোরঃ মরেচে রে, একটা হাত চলে গেলে কাজ করবো কি করে? খাবো কি? কিন্তু এটা গোপালমামা, ভবিষ্যতের শঙ্কার চেয়েও তাকে বেশী প্যাঁচে ফেলে বর্তমান, সাম্প্রতিকের সমস্যাঃ মনু, একটা উপকার করবি ভাই? ছোটমামার ব্যগ্র প্রশ্নাতুর দৃষ্টির সামনে তার হাসি হাসি নজর আর তন্ময় স্বরঃ এরা কাল থেকে আমায় খুব যত্নে রেখেছে রে। খুব ভালো খেতে দিয়েছে। আমি তো সবটা খেতেই পারলাম না। হবে না, কে পাঠিয়েছে দেখতে হবে তো! কিন্তু... গোপালমামার বাক্যিগাড়ি হাম্পে থেমেই যায়, ফলে ছোটমামাকে জানতে চাইতেই হয়ঃ কিন্তু কি? গোপালমামা ফিসফিস ফিসফিস করে জানতে চায়ঃ তোর কাছে একটা বিড়ি হবে? অর্থাৎ বিশ্বনিখিল ফেঁড়ে মানুষের কাঙ্ক্ষা সাত জন্মের শোধ এক জনমে তুলে নিয়ে যখন ছুটে যাচ্ছে দিকবিদিক, গোপালমামার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলতে একটা বিড়ি; মওকা মিললে বড়োজোর একটা চার্মস চাইত সে। ছোটমামা আশ্বস্ত হয়, ফেরার ভাড়াটুকু ছাড়া পকেটে বিশেষ তো কিছু নেই, একপাতা ট্যাবলেট কিনে দিতে বললেই চিত্তির হয়ে যেত, উৎসুক গলায় ছোটমামা শুধোয়ঃ কোথায় খাবি? গোপালমামা ছোঁচা স্বরে বলেঃ কেন, ওই তো বাথরুম। চ, চ। মেল ওয়ার্ডের ওয়াশরুম, বুঝে নিন অ্যামোনিয়া কিরকম মাত্রায় ঝাঁঝালো হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যেই নিরাসক্ত দুজন বিড়ি ধরায়, শাশ্বত আদরে টানে, ধোঁয়া ছাড়ে, কিছুক্ষণ পর তাদের একজন ফিরবে বাড়ী, অন্যজন নির্দিষ্ট বেডে। ফেরার সময় ছোটমামা, বুদ্ধি করে, বন্ধুর হাতে গোটা বান্ডিলটাই, দেশলাইসমেত দিয়ে এসেছিল। সেটাই গোপালমামার জীবনে পাওয়া শেষ প্রীতি উপহার। মাঝরাত থেকে তার শরীর ক্রমশঃ বেঁকে যেতে থাকে, চলতি বাংলায় আমরা যাকে ধনুষ্টংকার বলি আর কি, তাকে শিফট করা হয় সেই ঘরে, যে ঘরে জ্যান্ত কিন্তু অসুস্থ মানুষ ঢোকে বটে, তবে সে ঘর সুস্থ হয়ে জীবনে ফেরার জন্য নয়, সে ঘর থেকে সবাই অবধারিত বেরোয় বডি হয়ে, আর বডি হয়ে বেরোনোর পর ডিস-ইনফেকট্যান্ট দিয়ে স্যানিটাইজ করে নেওয়া হয়। গোপালমামা, সেসময় ওষুধই বা কি, পথ্যিই বা কি, কিন্তু সে খেতে পেয়েছে পেট ভরে; - অন্যের বাড়ীতে, কিছু কাজ করে দেওয়ার বদলে হলেও, খেতে তো পেয়েছে, দেড় দিন লড়াই দিয়েছিল খুব, যেমনটা একটা চৌত্রিশ - পঁয়ত্রিশ বছরের তাজা জান দেয়, তারপর প্লাস্টিকে চৌপর মোড়া তার লাশ বাড়ীতে, তিন চাকার টেম্পোতে এলে 'পর সবাই দরজা-জানলা বন্ধ করে দিতে শুরু করেছিল, ধনুষ্টংকার নাকি বড়ই ছোঁয়াচে, আর গোপালমামার মা, কেনাদিদা, কাঁদে নি সামান্যটুকুও, শুধু তার মরা বড়ছেলের কপালে একটা চুমু খেয়ে, এমন শুকনো যেন মনে হয় কৃত্রিম স্বরে-সুরে বলেছিলঃ পরের জন্মে একটা মোটামুটি ঘরে জন্মাস বাবা, যেন আশ মিটিয়ে খেতে পাস, পরতে পাস। পরের হাততোলা হয়ে যেন না থাকতে হয় তোকে। আর একটু যেন গান শুনতে পাস। গান শিখতে পাস।
আমি পরদিন মিশনে ফিরব, ভ্যাকেশন খতম, বাবা, অফিস যায় নি সেদিন, গোপালমামার জন্যই যায় নি, মামারবাড়ীর কাছে, নাকে রুমালচাপা চারজন কাঁধ থেকে ক্লাবের সামনে বডি নামালে আমাকে দেখতে যেতে বলেছিল। বাড়ীর সবাই হাঁইমাই করে উঠলেঃ ভীষণ ভালোবাসতো ওকে। বাবিকে। শেষবার দেখে আসুক।
কিন্তু নিজে যায় নি।
কিন্তু গোপাল কি অতো সহজে যায়, আজও আমি আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি গানটা কানে এলে ছিটকে সরে যাই, একটা আবছা অবয়ব, সে আর গোপালমামা নেই, বালগোপাল হয়ে আমার ভিতর, ধরাছোঁয়ার অতীত হতে, হাতছানি দেয় ইশারাতে, আর লুকিয়ে বেড়ায় ক্ষণে ক্ষণে, আড়াল পথে আমার মনে - হয়ে সেঁধিয়ে গেছে। সেখানেই সে উদাসী, বাজায় বাঁশী, কেউ জানে না...
জানি না, এসব কথা কোত্থেকে এল, কেনই বা এল; আমি শুধু দেখলাম আমি হড়হড়িয়ে বমি করে গেলাম খানিক, বমির সঙ্গে, না, রক্ত নয়, অশ্রু কি কিছু বেরোল? - ঠাহর করতে পারলাম না ঠিক। রক্তবমি? আহা, ভবিষ্যত বলে কি একটা শব্দ নেই, মানুষের জীবনের অভিধানে?
আসলে কোনো পাঠ প্রতিক্রিয়া দেন নি প্রধন্যা, একটা বইকে ঘিরে এটা দুই প্রজন্মের এক পারিবারিক গদ্য।
ধরা যাক, একজন মা আর তাঁর মৃত্যুমুখে থাকা সন্তান, দিশেহারা মা'র কাছে কেমন করে যেন এসে যান এক মহার্ঘ ডাক্তার, লোকে তাকে সামনে বলে ধন্বন্তরি, আড়ালে বলে পয়সা-পিশাচ। তিনি সারিয়ে তোলেন, একদম সুস্থ করে দেন সেই সন্তানকে। মায়ের চিরকৃতজ্ঞ মন কি করে বিচার করবে সে ডাক্তার অর্থহায়েনা নাকি অশ্বিনীকুমারদ্বয় ডিভাইডেড বায় টু। ঠিক জায়গায় লেখনী নামিয়ে নিয়েছেন প্রধন্যা, এক কন্যার চোখ দিয়ে বাবার ভালো থাকার জন্য কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়েছেন লেখকের। উপন্যাসটি পড়লেও তার ভালো-মন্দের কচকচির দিকে, তার ঘাড় ধরে আতশকাঁচের তলায় ফেলার ধারই মাড়ান নি তিনি।
এই সৎ প্রতিক্রিয়ার জন্যই, এই সততাটুকুর জন্য ভালবাসা প্রাপ্য হয়েছে তাঁর, আর প্রাপককে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার শিক্ষে আমি পাই নি কখনও।
তো নসট্যালজিয়া, তো অতীতচারিতা, আমার ক্ষেত্রে সেখানে কত না মানুষ, ওই গোপালমামার মতন, একটা সময় ছিল, বড় প্রখর, বড় প্রকট ছিল তারা, কিন্তু আজ আর নেই, কতজনের মুখের আদলই ঝাপসা মেরে গেছে... কিন্তু সেগুলোই মনে পড়ে, এরা কেউই সুখের জীবন কাটায় নি, আর ঠিক তাই মনে করিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দিয়ে আমায় স্থাণু করে দেয় যে, কত মানুষ এখনও ভালো নেই; - মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও, মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও, এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও, ভালোবেসে দাঁড়াও, তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়। আমার অতীতচারিতা কিছুতেই আমার ফেলে আসা দিনগুলি, যা কিনা রয়ে গেছে সোনার খাঁচায়, তাদেরকে আঁকড়ে ধরতে দেয় না, আমি শুধু এক অশ্রু থেকে অন্য অশ্রুতে যাই ভেসে যাই। অশ্রুর আওড়ে আটকা পড়ে আমি মানুষের প্রাপ্যটুকু না পাওয়ার রিস্টিচক্রের রাতুল-পিঙ্গল হলকায় ভুল করে ছিঁড়ে ফেলি মায়ার ছন্দ, মায়ার তন্তুজাল, ভুলে যাই দখিনা কালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে...
আমি শুধু ভাবি, কল্পনার বিলাস করি, সেই দিনটাকে, যেদিন মানুষের সব জানলার গরাদ ভেঙে যাবে, সবার রান্নাঘরে ভাতের গন্ধ ছুটবে। পৃথিবীর সব গোপালমামা নিজের রান্নাঘরে ছোটা গন্ধের ভাত খাবে। খেতে পাবে।
থাক, ওই উৎসর্গপত্র তাদের জন্য, যারা সঠিক অর্থে নসট্যালজিক হতে পারে, যাদের জমানো জিনিস অক্ষয়, বিমলের ট্যাক্সিটার মত। আমি যে কেন তাদের মত নই...কিংবা হয়তঃ তাদেরই মত ছিলাম, গোপালমামার চাদরের মত অতীতের চাদর আমাকেও ঢাকতে এসেছিল, কিন্তু স্মৃতিমেদুর হতে পারলাম কোথায়? কই, কোথায় জীবন্ত, যেন-জ্যান্ত হয়ে উঠল ভোরের বেলা ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায়, বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়? ফুল নেই, সুর নেই, মুকুতা ফলের ন্যায় নীলাভ আকাশ নেই... এ আমি কোথায় এলাম? আমার নসট্যালজিয়া আমায় মোটেও স্থাণু করে দেয় নি, বরং ঠেলে দিয়েছে অজানায়, আর দৌড়ে, থেমে, আবার দৌড়তে দৌড়তে আমি বোধহয় উন্মার্গগামী হয়ে গেলাম। অতীতের সেপিয়া টোনে তবুও তো কিছু আলো আছে, দেখা যায়, চারপাশ, কিন্তু আমার চারপাশে কে সূর্যটাকে কি জানি কি ভেবে দু হাতে নিয়ে জ্বেলে আবার গেছে নিভিয়ে, যাবার বেলায় গেছে তাকে মাড়িয়ে, জ্বলতে না পারে যেন কখনো আবার করল! তাহলে কি স্মৃতিকাতরতায় আমার রাত্রি ফুরিয়ে যাওয়া ফুরাল, আমার দিনরঙা আকাশটা হারাল? এসব যদি হয়, তাহলে তো আমায় মন্ত্রোচ্চারণে বসতেই হয়। মন্ত্র... ভাগাড়-পিয়াসী শকুনের চোখের মত, পচা আমিষ লোভী লেড়িকুত্তার কানের মত, যা দেখি, যা শুনি সবই সেই মন্ত্র, মন্ত্রের মতই কিছু নির্দিষ্ট শব্দ সেখানে, ঘুরেফিরে একই প্যাটার্ন তৈরী করে চলেছে –
হোক পোড়া বাসি ভেজাল-মেশানো রুটি
তবু তো জঠরে বহ্নি নেভানো খাঁটি
এ এক মন্ত্রঃ রুটি দাও, রুটি দাও!
বদলে বন্ধু, যা ইচ্ছে নিয়ে যাও!
সমরখন্দ্ বা বোখারা তুচ্ছ কথা
হেসে দিতে পারি স্বদেশের স্বাধীনতা।
শুধু দুইবেলা দু-টুকরো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যেরও আগে উঠি।
ঝোড়ো সাগরের ঝুঁটি ধরে দিই নাড়া
উপড়িয়ে আনি কারাকোরামের চূড়া।
হৃদয় বিষাদ, চেতনা তুচ্ছ গণি
রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি।
হাঃ হাঃ চারপাশ ফের ঝকঝকে, চনমনে। তাহলে? মন্ত্রোচ্চারণের পর কি-ই বা থাকে পড়ে বলবার বা লেখবার? তাছাড়া মুছে যাতে না যায়, তাই এত লিখলাম। সুতরাং আমি তো রইলাম। অবশ্যই আমার মত করে। এবং যদি তাকে থাকা বলে... আদৌ।
কিন্তু এবার পথ। পথ এখনো অজানা। কিন্তু পথ চিনতে গেলে সাথীকে ডেকে নিয়ে পথেই কি নামতে হয় সবসময়? আইনস্টাইন তো শুনেছি গড়পড়তা মানুষ যেখানে চোখ বুজলে তিনটে মাত্রা দেখতে পায়, তিনি পাঁচটা মাত্রা দেখতে পেতেন। তার জন্য তাঁকে চতুর্থ মাত্রা ঠেঙিয়ে পঞ্চম মাত্রা অবধি হাঁটতে হয়েছিল বলে তো শুনি নি। অতএব বিষয়টা ভাববার। বিমলের অব্যয় একগুঁয়েমি'র মত ভাববার। আর ভাবনা জিনিসটা আর কিছুই না, একটা সাধনা মাত্র। তাহলে? তাহলে আর কি -
কিছু গান, ভালবাসা
সমবেদনা
সম্বল এই শুধু
আর কিছু না
তারই সাধনায়
সুখে দুখে সাথী হয়ে
কাঁদি ও হাসি
অনেক গানের পাখি
এখনো জাগাতে বাকী
আসে ঝড় বৈশাখী, সর্বনাশী
বেশ, তবে ঐ কথা থাক,
আমি আসি।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
স্বীকারোক্তি ১। কি লিখেছি, পড়া তো দূর, চোখ তুলেও দেখি নি। ড্রাফট হিসাবে পড়বেন, যদি কেউ পড়তে চান।
স্বীকারোক্তি ২। শ্রী স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর ঝাল লজেন বইটি পড়া তো দূর, তার স্পর্শ জানি না, প্রচ্ছদও অদেখা ছিলো।
স্বীকারোক্তি ৩। এটা এখনই ব্লগে দেওয়া তো দূর, লেখারই কথা ছিলো না। ব্লগে দেওয়ার জন্য তিন তিনখানা লেখা ৯০ ভাগ আছি সংযত, প্রস্তুত হয়ে পড়ে আছে। তাদেরকে দেওয়ার আগে (পাবলিশ করার আগে) কিছু সংযোজন - বিয়োজনের (ড্রাফটগুলোকে পালিশ করা) ইচ্ছে ছিলো। মোটের ওপর, একটা সংস্কার করা যাকে বলে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। আর যব যব যো যো হোতা হ্যায়, তব তব উয়ো উয়ো হোতা হ্যায়। প্রধন্যার লেখার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সততা, লিখতে একান্ত অপারগ আমাকে দিয়ে লিখিয়েই ছাড়লো শেষ অবধি। তবে এরকম ন্যাড়া, ঊষর গদ্য আগে লিখেছি বলে মনে পড়ে না। স্মৃতি এলোমেলো, আর তাই গদ্যও ন্যালাক্ষ্যাপা, এই ভেবেই মাফ-মার্জনা করে দেবেন না হয়।
ফটো কার্টসিঃ গুগল ইমেজেস ।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment