Friday, September 22, 2023

রেজগি - ১

 

 

খুচরো-রেজগি থেকে অচল পয়সা, যা কিনা শবযাত্রায় ছড়ানো হয়, খইয়ের সঙ্গে, তেমনই অকিঞ্চিৎকর এগুলো। খুব বেশী মনোযোগ তো দূর কি বাত, পড়ারও আদৌ কি কোনও দরকার আছে, সেটাই এখনো অজ্ঞাত...

 

ওহ, হ্যাঁ, কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজেদের কোমরের মাপে বিভিন্ন নামী কোম্পানীর বটমওয়্যার কেনেন; যে ফিটটা পছন্দ হয়, সেটা নিয়ে, মিলের সবচেয়ে পছন্দের এবং দামের কাপড় কিনে দর্জিকে দেন, কার্বন কপি বানাবার জন্য; ফারাক বলতে শুধু পকেটদ্বয়কে একটু বড়ো করতে নির্দেশ দেন; পাঁচ, দশ এমনকি কুড়ি টাকারও কয়েন এসে গেছে যে; আর, একথা আজ কে না জানে যে, যে কয়েন যতদামী, ভার তার ততোই বেশীএঁদের মধ্যে আমি পড়িনা; আমার আট ছর আগে কেনা অ্যাটায়ারের গ্লেজই তিলমাত্র কমেনি; কমবে কি করে, আমি তো বাড়ী ছেড়ে বেরোইই না। আজকাল কিংবা অনেকদিন।

 

আর এই বালের লেখাগুলো আমি ঠিক লিখছি না কিন্তু; বেঁচে থাকা যেরকম, কেউ বাঁচিয়ে নিচ্ছে আমায় দিয়ে, এই লেখাগুলোও সেইরকম, কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে আমাকে মাধ্যম করে; ফলতঃ বুঝি, এদের উৎস যেমন অজানা, উপসংহারও সেরকম; - অসংজ্ঞাত; তবে সার যা বুঝেছি, তা হলো, এরা কেউ স্থাণু নয়, আয়ু শেষ হলে যে যার মতো ঘরে ফিরে যাবে। ঘর; - আমি সেসবের ঠিকানা রাখিনি, ছবিও আঁকিনি, কোথা সে জানি না; মন, তবু তারই কথা বলে...

 

ওহ্‌, হ্যাঁ, এদের মধ্যে কালানুক্রম নেই; জন্মদিন পালন করে না এরা। রেজগি নামে এরা এখানে থাকবে; এবং কেউ যদি পড়েন, আমি অবশ্য তেমনটা আশা করি না, কেননা, লেখা আমার কাছে আয়নামাত্র, দর্পণে নিজেকেই দেখি; এক কি দুবছর আগে কেমন ছিলাম; আর এখন কেমন আছি। নাহ, নার্সিসিজম নয়; আছি কেন সেটার উত্তরের আশায়...

 

তবুও... সময়ের ওভারল্যাপিং চোখে পড়তেই পারে, জাষ্ট ইগনোর করবেন। রেজগির এক একটা পর্বে কমপক্ষে তিনটে ভাগ থাকবে, ঠিক ওই সিরিয়ালে যেমন তিনটে সাব-পর্ব হয়, মাঝখানে থাকে দু থাক্‌ বিজ্ঞাপনপর্ব...

 

 

#

 

মিনিট দশেক হলো, ব্রহ্মমুহূর্ত চলছে। একদম এখন। একটু পরে আলো ফুটবে, শুরু হয়ে যাবে রগরগে আর একটা দিন। তবুও মানুষ ছুটবে, ছোটার হ্যান্ডনোট সে দিয়েই এসেছে, যেখান থেকে তার আসা এবং কিছু বা অনেকটা পরে তার ফিরে যাওয়ার ব্যতিক্রম হয়ে ঝকঝকিয়ে জ্বলছি আমি; না, না, আসা-যাওয়ার ষ্টেশনের কথা বলছি না, বলতে চাইছি, আসা-যাওয়ার ভার্চুয়াল পথের ধারে, ‘সুখের সাথে ভাব হলো যে, দুখের সাথে জানাশোনা হলো’; - সেই সব পরিচয়ের কথা, সেগুলো যেন বা সূর্যের প্রতিপক্ষ; কেননা, আমার তো কোথাও যাওয়ার নেই, সূর্যের সঙ্গে আমার কোনো দেওয়াও নেই, নেওয়াও নেইবরঞ্চ বেওয়া হয়ে পড়ে থাকা আছে।

 

 

এইসময়ে, যখন কিনা ঘুমোতে যাওয়ার মতো কিছু একটা করতে যাই, আমার মধ্যে কিছু বেফালতু ঘটনা... হ্যাঁ, বলা যেতেই পারে, যে, আমি পজেসড হয়ে যাই। এই তো একটু আগে স্নানে গিয়ে, বলিরসামগ্রী যথা চুপচাপ, অশোভনতাহীন দাঁড়িয়ে আছি শাওয়ারের নীচে; মনে হলো, এই যে দাঁড়িয়ে আছি, দম আটকে বেমালুম পড়ে যাচ্ছি না; অথচ পেট্রোল নয়, ডিজেল নয়, সোলার (আবার সূর্য!) বা অ্যাটমিক এনার্জি নয়, হার্টটা, নির্বিবাদে নির্বিকার পাম্প করে যাচ্ছে বলেই না! রক্তের গতি, চাপ ইত্যাদি আলাদা হলে, দুটো নির্দিষ্ট সংখ্যার রেঞ্জের মধ্যে থেকে ধকধক করনে লাগা নয়, ধকধক করতা রহা হ্যায়। শুরু ইস্তক।

 

তো, সেই হৃদপিণ্ড যখন বেজে চলেছে বিধাতার বেহালার মতো, চারপাশের বিশ্ব প্রপঞ্চ টলমল করলেও নিত্য সে উদার, সুখে দুখে অবিকার; তখন আমিই বা আপস করে নিই না কেন, সূর্যের সঙ্গে। আপোস করতে গেলাম, পুরু মাফিক আলেকজান্ডারের কাছে, এমনতরই তো ছকে রেখেছিলাম, কিন্তু ওই, ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস; - দেখি, আমার সুরহীন কন্ঠ অরব, কিন্তু অন্দর গাইছে, অন্তরে অন্তরে দাও আলো দাও, কালিমা কলুষ যতো মুছে নিয়ে যাও...

 

পরাজয় কি কখনোও কাঙ্ক্ষিত, গৌরবের হতে পারে না?

 

#

 

সারাদিন ও ঘরে যাইনি আজ, কিংবা এক-দুবার গেলেও, কোনোরকমে কাজটা সেরে দুড়দাড় ছুটে আসা। তোমার দুটো ছবিতেই মোটা গোড়ের রজনীগন্ধার মালা দিয়েছে জয়িতা; তোমার মৃত্যুর স্মৃতির ওপর পড়া সরটাকে সরিয়ে দিয়ে, ও ঘরে, প্রকট হয়ে উঠছে ১৬ই জানুয়ারি, ২০২১।

 

এবার কি তবে রজনীগন্ধার মালার গন্ধ নাকে এলেও পালাতে হবে দিগ্বিদিক?

রজনীগন্ধার মালার গন্ধ এখন ভিতর বারান্দাতেও, গন্ধরও মনে হয় তরঙ্গ আছে, স্মৃতির সঙ্গে মিশে সে তৈরী করে নেয় এক নিজস্ব সৈকত...

আর আমি, অকারণেই একপ্রকার, নিজের ঘরের দরোজা চেপে ভেজিয়ে রেখেছি।

 

কোথায় পালাতে চাইছি, আমি? আমার ভিতরেই তো তুমি, রক্ত-মজ্জা হয়ে রয়েছো এবং রয়েই যাবে, যতদিন আমি বেঁচে থাকবো।

 

...দেখো, জানা কথা, তবু্ও কি প্রচন্ড অজানা, তাই না, বাবা?

 

 

#

 

 

আমি যে পেরেন্টহুডের মধ্য দিয়ে র‍্যেইজড হয়েছিলাম, সেটা ভয়াবহ। যার আউটকাম হিসাবে মাধ্যমিক সিনেমার পর কে কটা সিনেমা দেখতে পারে, সেটার একটা প্রতিযোগিতা যখন চলছে, তখন, পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও, 'আমি একা, বড়ো একা'আমার বেঁচে থাকার রাস্তা জুড়েই, আজও, আমি, ওই, 'আমি একা, বড়ো একা'

 

ছোটবেলায় আমার যে কোনো বই পড়ার অধিকার ছিলো, ক্লাস ফাইভে, আমি হ্যারল্ড রবিন্স, সিডনি সেলডন, হ্যাডলি চেজ (শেষোক্তজনের আর একবার আংশিক পাঠ আমি বড়ো হয়েও নিয়েছি, তাঁর ইংরেজি গদ্যগঠন দর্শনীয়। ব্যাপারটা ওই গদ্যগঠনেই সীমাবদ্ধ; কন্টেন্ট ইত্যাদি নিয়ে প্লীজ কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে যেন পীড়িত করবেন না)। ওহ্‌ হ্যাঁ, আসল জায়গাগুলো, যেখানে দাগরাজি করার নাকি কথা, মানে, করণীয় আর কি, সেটা, সম্ভবতঃ প্রথম পাঠকই বুঝেছেন এবং অতঃপর সে মহান দায়িত্ব পালনও করেছেন।

 

এনিওয়ে, পঠনের ক্ষেত্রে অপার স্বাধীনতা থাকলেও দর্শনের  ক্ষেত্রে কণামাত্র ছিলো না।

সব সিনেমাই নাকি, আমার বাবার চোখে, আমার জন্য, 'ম্যাচিওরড'! অগ্নীশ্বর, দাদাঠাকুর, গল্প হলেও সত্যি এবং আর দু-একটা ছাড়া।

 

যে কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর সব বিধিনিষেধ উঠে গেলেও বন্ধুরা আমায় সঙ্গে নিতো না; ন্যাচারাল, প্রত্যেক বাক্যের পর,  হ্যাঁরে, কি বললো রে কাঁহাতক সহ্য করা যায়!

 

আমি বড়ো হয়ে, একদিন, বাবাকে, গল্পচ্ছলে, বেকারের স্টিগমাটাইজেশন থিওরিটা বুঝিয়েছিলাম। বাবা বোঝেওনি কি ক্রুর উদ্দেশ্য ছিলো আমার। সবটা ভালো করে বোঝানোর পর অর্থাৎ এক্সটার্নালি স্টিগমাটাইজড হলে মানুষের ইনার বিয়িং কতোটা সেক্লুডেড হয় ফালানা ফালানা; বাবা একসময় বলে বসলোঃ বাবি, তুই দিওয়ার দেখেছিস?

 

আমি তো এই সিনেমাটার নামোচ্চারণের জন্যই ক্রিমিনোলজির সঙ্গে সঙ্গে সাইকোলজির থিওরিও হ্যাজাচ্ছিলাম। বললামঃ হ্যাঁ দেখেছি, তবে তোমার দেখার অনেক অনেক পরে। আচ্ছা বাবা, সিনেমাটার মধ্যে কি কোনো ম্যাচিওরড কন্টেন্ট ছিলো? বাবার নীরবতার পর বললাম, তোমার কি উচিত ছিলো না, প্রশান্তকাকুর সঙ্গে অন্নপূর্ণা সিনেমা হলে সিনেমাটা দেখে আসার পরদিনই ক্লাস সেভেনের আমাকে দেখাতে নিয়ে যাওয়া? উচিত ছিলো বাবা, কিন্তু তুমি করোনি।

 

পাশ থেকে মা; সব মায়েরা সব বাপ-ব্যাটার ঔচিত্যবোধের দ্বন্দ্বে চিরটা কাল বাপের পক্ষ নিয়েছে। আমার মা বলেছিলোঃ আরে বুঝলি না, হিন্দি সিনেমায় অনেক নাচ গান থাকে যেখানে নায়িকারা কম জামাকাপড় পরে। সেটা ভেবেই... আমি বলেছিলামঃ কিন্তু দিওয়ারে সেসব কিছু ছিলো না। (পরে একদিন কাল্ট মুভি কি বোঝাতে গিয়ে এই দিওয়ার প্রসঙ্গ আর একবার উঠেছিলো দো আঁখে বারা হাত সিনেমার পরে।) আর মা, ক্লাস লাইনে তুমি, আমায়, উত্তম-সুপ্রিয়ার অগ্নিসংস্কার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে রুম্পা সিনেমা হলে, বাবার ম্যাচিওরড কশানকে উপেক্ষা করে। নাইট শোতে চলছিলো খাজানে কি লুটেরা। সিনেমা হলের চারিদিকে তখন সিল্ক স্মিতার ছবি। পোস্টারাইজ করা। সিল্ক স্মিতার বসার ভঙ্গিটা তোমার নিশ্চয় মনে আছে। কারণ অমন অস্বস্তিকর অবস্থায় তো জীবনে তুমি আমাকে নিয়ে ওই একদিনই পড়েছিলে। মা, যিনি জগতের মা, তিনি সব ভুলের পেনাল্টি দেন, নিষ্কৃতি নেই। সেখানে। রুম্পা সিনেমা হলে তিরিশ মিনিট আগে পৌঁছে, সিনেমা শুরুর আগে, তোমার ওই আধঘন্টা নরকভোগ তোমার আমরণ মনে থাকবে।

 

প্রসঙ্গতঃ তখন বিদ্যা বালনের 'উ লা লা উ লা লা' গানের সিনেমাটা বেরিয়ে গেছে; মা জেনে গেছে, সিল্ক স্মিতা কে ও কি? এবং প্রথম স্টিল ফটো দর্শনেই খাজানে কি লুটেরার নায়িকার সঙ্গে সিঙ্কও করতে পেরেছে। বাবা বলে উঠেছিলোঃ তুমি কেন আবার বাপ-ব্যাটার গল্পের মধ্যে এলে...

 

 

পুনশ্চঃ একইভাবে শক্তি (১৯৮২) সিনেমাটার ডাইসেকশন করেছিলাম একদিন, গ্যাং থিওরি, সিঙ্গল অপরচুনিটি থিওরি, ডুয়াল অপরচুনিটি থিওরি (অংশতঃ)- এর পার্স্পেক্টিভে। তবে বাবা-মার এসকেপ রুট ছিলো; ওরা শক্তি প্রথম দেখেছিলো আমারই সঙ্গে।

 

 

অনিন্দ্য ঘোষ ©

 

 

ফটোকার্টসিঃ ???!!!

 

ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলিএখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা সেইসব গানের অংশভুক সকলকে