শরৎকাল বলতে আমি একদম দূর্গাপূজা বুঝি। মহালয়ার আনন্দটা ফাউ, আর ফাউকে কে-ই বা কবে ভুলে গিয়েছে। তবে তাকে বাফারে রাখি। সপ্তমীতে এসে ওই আমার শরৎকাল নর্ম্যাল ডিস্ট্রিবিউশনের বেল কার্ভের মতো হলো। ওখানেই যা কিছু মূল্যবান, সব শূন্য। অষ্টমী তার আভিজাত্যে অনেক গমগমে, অঞ্জলী ইত্যাদি; নবমী আনে মায়ের বাপের বাড়ীতে গড়িমসি করে কাল কাটানোর শেষ দিন, সেদিক থেকে দেখলে তার মাহাত্ম্যই আলাদা, ভীষণই অন্যরকম তার ঘ্যাম, মানব মুখু্য্যের সুরে হেমন্ত মুখু্য্যে তো গেয়েই গেছেন, নবমী নিশি রে, তোর দয়া নাই রে, এত করে সাধিলাম, তবু হইলি ভোর।
তা রাত তো জাগেই ভোর হবে ব’লে, কিন্তু কথাটা সেটা না, কথাটা হলো, রাতের হাত দেখতে গেলে ‘পর আপনি, সকালের আলোর আভাসই পাবেন – এসব জেনেও নবমীর রাতকে আটকে রাখার, পায়ে পড়ে বেঁধে রাখার এহেন প্রয়াস... তবুও নিরাভরণ সপ্তমী তার গোলা সিঁদুরের রঙ নিয়ে শিখরে। তার গায়ে পতাকা ওড়ে। মা আসার আনন্দের। শরতের। বলে রাখা যাক, ষষ্ঠী আর দশমীকে ধর্তব্যের মধ্যে ধরার কোনও প্রয়োজন নেই, মানে, আমি অন্ততঃ দেখি না। তা আমি অবশ্য পুজো দেওয়া, রীতি-রেওয়াজ, আচার এসব কিছুই দেখি না; ওসব দেখতে যাই আর আমার চিরকেলে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ পরিক্রমণ ঝাড় খেয়ে যাক... না, না, ওসবে আমি নেই। মা আসছে এই আনন্দ নিয়ে চলকাতে চলকাতে আমি ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের ওপর হামলে পড়ি, অনেক সিনেমা শুরু থেকে শেষ হয়ে যায়, কিন্তু একটাও ফ্রেম আমার দেখা হয় না। কারণ বাহিরে শরৎ তুঙ্গে, ভিতরে মা’র ভুবনমোহন হাসি, যা নয়ন মুদেই একমাত্র দেখতে পাওয়া যায়। উত্তম কুমারের নশ্বর কিন্তু সুন্দর হাসিটি তো ইয়ে, ক্যালেন্ডারে ঝোলে, ঠাকুর্দার থোলোর মতো।
এখন থেকেই অনেকের মুখে শ্রাবণের সন্ধ্যে নেমেছে। কাল ভোলানাথ আসবে গিরিজাকে নিতে; খাঁ খাঁ কিংবা ধূ ধূ করবে একটা জাত, যারা পুজোর দিনগুলোতে সকাল সকাল স্নান করে নিয়েই মুখ তথা মগজশুদ্ধি করে নেয়ঃ ওঁ, দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তো, স্বস্থৈ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি, দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণী কা ত্বদন্যা, সর্বোপকারকরণায় সদার্দ্যচিত্তা। আর তারপর ঠেঙিয়ে যায় পাড়ার প্যান্ডেলে, অঞ্জলি দিয়ে বাড়ী ফিরে প্রসন্ন মনে সিগারেট, বিড়ি, কিছুদিন আগে শেখা খৈনী এবং নবলব্ধ গুটখা চিবোতে চিবোতে মেতে ওঠে খোশ আড্ডায়।
দুপুরের দিকে লুচি, ছোলার ডাল আর পিয়াঁজ-রসুন ছাড়া, শুধু আদা জিরে দেওয়া আলুর দম সাঁটিয়ে মৌজ করে একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে গান ধরে, এত গয়না বেটি কোথায় পেলি? / সিংহীর উপর ধিঙ্গী হয়ে বাপের বাড়ি চলে এলি! / অবস্থা তোর আছে জানা, ভাতের উপর নুন জোটেনা / তবে এত বড়াই কেন পরে বেনারসী শাড়ি? / শিব থাকে শ্মশান ঘাটে, / বুঝি ত্রিশূল দিয়ে সিঁদ কাটে / ভক্তের সঞ্চিত ধন তাই পরে বাহবা নিলি?
আর বিকেলে এক ঘন্টার পাওয়ার ন্যাপ দিয়ে নিয়ে নতুন জামা-জুতো পরে মাকে দেখতে যায় জাগো শক্তি, জাগো স্বপ্ন, জাগো জাগো উমা, জাগো স্পর্ধা, জাগো ইচ্ছে, জাগো জাগো উমা, জাগো বিস্ময়, জাগো স্পন্দন, জাগো জাগো উমা গাইতে গাইতে... সেই তারা আজ বড়ো বিষণ্ণ...
কিন্তু আমা শালা বেজাত, অথবা বজ্জাত; এদের মধ্যে পড়ি না। আর সিম্পলি পড়ি না বলেই ভেবে নিতে পারি, আর মাত্র তিনশো তেষট্টি টা তো দিন, তারপর আবারও মা আসছে। অথচ মা এলে কী করব, জানি না। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে পাঁয়তাড়া কষছি একদিন সন্ধ্যারতির সময় কষে ঢাক শুনতে যাব বলে, পাশে থাকবে অনেক অনেক অনেক ধুনোর গন্ধ -
...হয়তঃ ভাবতে ভাবতেই এই জন্মটা যাবে। পরজন্মে এক বাঙালী আবার শারদগন্ধে মাতাল হবে।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ !
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।
No comments:
Post a Comment