ইস বার
শাওন দ্যহেকা হুয়া হ্যায়
ইস বার
মৌসম বহেকা হুয়া হ্যায়
ভোর
চারটের
সময় যখন কিনা মিডনাইট কৃস্টাল ক্লীয়ার, বাঁকানো
চাঁদের সাদা ফালিটি তুমি বুঝি বড় ভালোবাসতে, আর
উত্তরে যখন কিনা মানুষ ভেসে যায় অনিচ্ছায়, কেননা, নদীর
বুকে বৃষ্টি পড়ে, পাহাড় তাকে সয় না, আমি
সব কিছুকে বিস্মরণে ধসিয়ে দিয়ে গানটির মাদকতার
মধ্যে সটান ঢুকে যাতে পারি, এবং নিজেকে চমকে দিয়ে, যাইও।
বর্ষার
জমা জল, নানাবিধ রোগের সংক্রমণ, যার
একটা আমার মায়ের হলে ভায়া আই সি ইউ, তবে
একদিন, সোজা ইলেক্ট্রিক চুল্লীর কিউব, আর
জমা জল পাড়িয়ে কাজের কাজ কিছু আর যাই হোক, করতে
যাওয়া যে যায় না - এতসব মেনে নিয়েও বলছি, একটা
দিন ছিল, যখন আমরা বৃষ্টি কখন আসবে নিয়ে বোধহয় একটা যৌথ
উপন্যাস
লিখতে বসতাম। এই আমরাটা কারা, সেটা আর বলছি না, তবে
ইশারা থাকুক, এ কন্যে জয়িতা
নয়। তখন ক্লাস ইলেভেন... কবিতা, প্রেম, বিপ্লব
সব হইহই করছে। তো, আমরা মেঘ জমে
কলঙ্ক কালো হওয়ার আগেই ক্লাস কেটে বেরিয়ে পড়তাম। বৃষ্টি আসে নি, কিন্তু
মেঘ চিরে ফ্ল্যাশ যখন ডুয়াল লেডের চেয়েও তীব্র হতো আর তার গম্ভীর
রবাব যখন ধীরে ধীরে বাস এবং ভল্যুম দুই-ই বাড়াত, আর
আমাদের পুলক ফাঁপিয়ে উঠত। আজ একথা বললে এই জেন জেড
কি আদৌ বুঝবে যে, আমরা নিড়েনের ধানক্ষেতে
গিয়ে দুজনে মিলে নিঃসঙ্গ, কিংবা, পরষ্পরের
সান্নিধ্যে ভিজেছি অপার? ক্ষেত
ডিঙোলে একটা বটগাছ ছিল, আর কিছুটা দূরে রেল লাইন, অহরহ
বাজ পড়ছে, অথবা বাজের মতোই তীব্র কিছু, আর
আমরা বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে
সশব্দে হাসছি! টেলিফোন তো দূরের কথা, ধারেকাছে কোনও
বাড়ী পর্যন্ত নেই, যেদিকে চোখ
যায়,শুধু ধূ ধূ, একটা প্রাণীও
চোখে আসে না। তার স্কুলের দামী শাড়ি ভিজে একশা। আমার
প্যান্টটা কমদামী টেরিকট, তবে জামাটা পিওর
কটনের, আর তাতে করে লেপ্টে বসত গায়ে। আমার ঘাড় অবধি চুল থেকে
চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে, আর সে একটা
একটা করে জলের দানা আঙুলে করে নিচ্ছে, তারপর
সেগুলোর
প্রতি সে কি অবহেলা তার, টোকা মেরে ফেলে দিচ্ছে দিকবিদিক!
আর সামনে, অনেক দূরে আকাশ গিয়ে বেঁকে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে, আর তার সবটুকু জুড়ে ধূসর, কালো মেঘ; সূর্যের আলোর আভাতে গাছের কালচে সবুজ আর বেবি গ্রীন ঝলসে উঠছে। বৃষ্টির দমক কমতেই একঝাঁক বক... কিন্তু পারল না তারা, গাছ খুঁজে পাওয়ার আগেই ক্ষেতের ফাঁকায় ভিজে উপুড়চুপুড় ভারী হয়ে গেল। তাদের শ্লথ হয়ে আসা সাদা ডানাগুলো উজ্জ্বল হতেই আমরা পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আঁক কষি, যদি এই দমকার পর পশ্চিম আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়, আমরা একটা গোধূলির হয়ে ওঠা দেখতে পাবো। আমরা খুশীতে ধ্বংস হয়ে যাই, শুধু পেট বলে চলে সে ফাঁকা, আমরা একটু একটু করে ভিজতে ভিজতেই লোকালয়ের দিকে এগোতে থাকি, আমাদের একটা চায়ের দোকান পেলেই হবে, গরমাগরম ডিম টোস্ট আর চা...
একবার শহরে গিয়ে এরকম বৃষ্টির আওড়ে পড়েছিলাম, উদ্দেশ্য ছিল গোলপার্ক থেকে গড়িয়ার অটো ধরার, তা রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে নেমেই ভিজে চুপসে গেলাম দুজনে। কোথা যাই, কোথা শুকাই করতে করতে ঢাকুরিয়া লেকের কাছে। তখনো বৃষ্টি বিগত যৌবনা হয় নি। যা দেখলাম, সেটা অনভ্যস্ত দেখা, অন্ততঃ আমার। চাদ্দিক অন্ধকার নামিয়ে দেওয়া উথাল-পাথাল বৃষ্টি, সাদা হয়ে যাচ্ছে চারদিক, হাওয়ায় সেই সাদা দুলে কাছে আসছে, পর মুহূর্তেই দূরে সরে যাচ্ছে - এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মাঝমধ্যিখানে দাঁড়িয়ে গাছের তলায় আড়াল খুঁজে নিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকারা বৃষ্টিটাকেই ভুলে যাবে! তাদের দিকে অবাক তাকাতেই আমার সহচরীর লাল চোখঃ ওদের নয় অনিন্দ্য, আমাকে দেখো। তা তাকেও একটু অন্যরকম দেখতে লাগছিল। স্কুলের কাছে থাকা এক বন্ধুর বাড়ী থেকে যে স্কুলের ইউনিফর্ম পাল্টে নিয়ে স্কার্ট-টপে এবং সাবেক হলেও টপের কাপড় অনেক পাতলা, তার শরীরের আভাস আসছিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ এগুলোই কি দেখতে বলছ? হাসল, নাকি ঠোঁটের কোণ ডিসপ্লেসড হলো তারঃ মন্দ কি? ডু আই লুক সাচ ব্যাড? আমি অতো জলের মধ্যেও শুকনো গলায় বলেছিলামঃ তাহলে ফারাক কি রইল? হাসি চওড়া হলে বুঝেছিলাম, ভালোবাসছেঃ বেশ তাহলে দেখো না, বাট টক। টক টু মী।
বৃষ্টিকে বক দেখিয়ে কারা যেন ছাউনি খুঁজে নিয়ে উনুন ধরিয়েছে, শুকনো কাঠ ভিজে গেছে, বাজারে নতুন আসা নীল কেরোসিনে জ্বলে ওঠে তারা, সঙ্গত দেয় গুল আর ঘুঁটে, কিংবা দুই-ই। উনুনের সাদা ধোঁয়ার ক্রমাগত বমন গিয়ে মেশে বৃষ্টির তোড়ের সাদার সঙ্গে, দুজনের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা হয়; তখন তাদের ডাক দিয়ে যায় আপ বজবজ শিয়ালদা লোকাল, তারপর উনুনের ধোঁয়ার সাদা ভালোবাসা ভেঙে উপরে উঠতে থাকে, পিছনে নজরুল মঞ্চের করোগেটের ছাদে অল্প বৃষ্টিতে শব্দের ধুনকি ওঠে, বৃষ্টির ঝামট বাড়লে আমরা মঞ্চটাকে নীরবে, বেকুবের মতো ভিজতে দেখি।
তারপর কত কথা... সব কথাই বৃষ্টির জল খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
নাছোড় বৃষ্টির অঝোর ধারায় তৈরী হওয়া সেইসব স্রোত, যাতে কাগজ কি কস্তি ভাসানো যায়, সেই স্রোতের সঙ্গে আমাদের কথাগুলোও হারিয়ে গেছে কবেই!
আজকাল বৃষ্টি হলে, বাজ পড়লে প্রকৃতিকে, প্রকৃতিকে খচিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষকে গাল পাড়তে পাড়তে দরজা জানলায় আগল তুলি। গ্যাজেট বাঁচানোর জন্য কয়েকটার তার খুলি, কারোর বা এমসিবি নামিয়ে দিই। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। ব্যথার মাঝে? জানি না। যখন ঘুম ভাঙে, তখন কেউই কড়া নাড়ছে না, তবে, বৃষ্টি থমকে গেছে। খবর দেখি ইন্টারনেটে। ট্যাবে। কার কি গেলো, কে নিজেই গেলো, এসবের খতিয়ান শুনতে শুনতে মানুষকে আর এক দফা খিস্তি করি। মন-মুখ তেতো হয়ে যায়। জয়িতার যত্নে বানানো চায়ে স্বাদ গন্ধ কিছুই পাই না।
অথচ আমাদের, এখন আমার, একটা দিন ছিল, তখন বৃষ্টির জলেই মুখ মগজ মিষ্টি হয়ে যেত, ঠান্ডা হয়ে যেত।
...একদিন, সেদিন আর বেশী দূরে নেই, সংক্রান্তির লগ্ন তো এগিয়েই এলো, সব ক্লান্তির অন্ত এবার; যখন এই বৃষ্টি না থাকবে তেতো, না মিষ্টি। আগুন সব আর্দ্রতা শুষে নেবে। স্মৃতি, সাম্প্রতিক সবই পিছনে রয়ে যাবে। পড়ে থাকবে ছাই, আর কিছু ফুল। হয়তঃ ছাইয়ের মধ্যেই চন্দন চর্চন জেগে থাকবে। আগুন পাবক ঠিকই, কিন্তু মানুষের ভালোবাসাও জেতে কখনো সখনো, কারণকি, সে শুদ্ধ। তাকে মানুষ অন্যভাবে কলুষিত করে, সে অন্য কথা। আর শুধু সেই জন্যই, পরের বৃষ্টিটাকে দেখা যায়।
অহ্ হ্যাঁ, নীচে যে ছবিটাকে দেখছেন, ওটা কিন্তু আমাদের নয়। ছবির মেয়েটি শাড়ি পরে আছে, আর তার পোশাক তো লিখেছি; তবে আড়া তার অমনধারাই ছিল, এমনই মনে পড়ে।
নিজের কথা লিখে লোককে আর নয়ই বা হাসালুম!
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ফটো কার্টসিঃ গুগল ইমেজেস ।
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ, অনেকসময় কবিতার কোনো অংশ, কারোর গদ্যের কোনো অংশ, নামকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব কবিদের, গদ্যকারদের আর গানের ক্ষেত্রে, গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।