সে আমরা যতোই চিল্লাই কেন; এটা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি ভাই; মানে কিনা, ডায়মন্ড জুবিলিরও পাঁচ বছর কেটে গেছে, প্ল্যাটিনাম জুবিলির আর মাত্র পাঁচ বছর বাকী; - অতএব পতাকায়, বিপ্লবীদের ছবিতে ফুলেল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়, আলোয়, গানে, নাচে, কবিতাপাঠে, আবৃত্তিতে, ছবি আঁকায়, নাটকে, চলচ্চিত্রে অর্থাৎ রূপে, রসে, রঙে, গন্ধে ভরিয়ে দিতে হবে গোটা দেশকে। এক্কেবারে মুড়ে দিতে হবে।
স্বাভাবিক, কেনই বা নয়? - ৪৯৩ জন বাঙালীর মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে ফাঁসি হয়েছিলো দেশকে, তার নিজস্ব রাজ কাঁধে করে বয়ে এনে দেওয়ার জন্য; ঠিক যেমন প্রত্যেক খ্রিস্টানকে নিজের ক্রস নিজে বয়ে নিয়ে চলতে হয়, অন্য কেউ বয়ে দিতে পারে না। যদিও স্বাধীন শীলা তার জওয়ানি দেখিয়ে, কিন্তু স্পর্শ করতে না দিয়ে, শুধু আর কতো রাত একা থাকবো বলে গেয়ে তার দিকে মারহাব্বা বলে ছুঁড়ে মারা পয়সা গোনে, ঠ্যাং ফাঁক করে বসে, মেহফিল শেষে, একা হলে।
আসলে কিন্তু স্বাধীনতা থুরথুরে বুড়ো না হোক, চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছে, লোল চামড়ার ফাঁক দিয়ে দেখছে আমাদের নিবিড় উদযাপন কিংবা লাস্যময় ক্যাওড়া কেত্তন। দূর থেকে আমি, মায়োপিক আমি, তার হাসিমুখ যেন দেখতে পেলাম, স্পষ্ট, আর কাছে গিয়ে দেখলাম সে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, বলার আগে তার শিথিল চামড়ার ফোকলা মুখ হাসতে লেগেছে, আর সে লেগেছে তো লেগেছেই; একসময় আমি তার বিড়বিড়ানিকে স্বকর্ণে শুনলাম যে, হ্যাঁ বাবারা, আজ আমার ফোকলা মুখ কিন্তু তোমাদের এই মোচ্ছবের স্বাধীনতা আমি যে নিজের চোখে দেখেছি; আর যা দেখেছি, সে তো আমারই এই ছেঁড়াখোঁড়া শরীর; তোমরা তো জানোই যে, মাটি তো আগুনের মতো হবেই যদি তোমরা ফসল ফলাতে না জানো; তোমরা যদি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও, তোমাদের স্বদেশ তাহলে মরুভুমি। যদি না পারো, তবে জেনো, মনে মনে অনেকদূর চলে এসেছো, এখান থেকে ফিরতে দুটো জন্মই লাগে। যে মানুষ গান গাইতে জানে না, যখন প্রলয় আসে সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়। তোমরা মাটির দিকে তাকাও, মাটি প্রতীক্ষা করছে; তোমরা মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।
তাই শুধোচ্ছি তোমাদের এই স্বাধীনতা কি সত্যিই স্বাধীন? স্বাধীন হলে কতোটা স্বাধীন বাবারা? তোমাদের স্বাধীনতার মাপকাঠি কি? - যদি এগুলোর একটাও না জানো, তাহলে, বাবারা, খোঁজো, তোমাদের সাধের স্বাধীনতা কোথায় কোথায়, কার কার সিন্দুকে রাখা আছে। তাদের খুঁজে বের করে পায়ের তল দিয়ে কুচিয়ে দাও; তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যতো রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলো, তার দুগুণ রক্ত এদের শরীর থেকে ঝরাও। তারপর ছেঁড়াখোঁড়া স্বাধীনতাগুলো ওদের সিন্দুক থেকে বার করো, টুকরোগুলোকে মেলাও, একদম মিলে গেলে ওই জমাট বাঁধা রক্তে, আমাকে ছুপিয়ে ছাপিয়ে নিয়ে উড়িয়ে দাও শুন্যে, ঘুড়ির মতো। দেখবে, এই ঘোলাটে আকাশ কেমন আদুরে নীল হয়ে গেছে, এলোমেলো ভাসছে সাদা মেঘ, চেহারা তার ক্ষণে ক্ষণে কেমন পাল্টে যাচ্ছে। বাবারা, জেনো, তখনই কাশফুল ফোটা সার্থক, তখনই প্রকৃত পূজা হয় মায়ের, যিনি আক্ষরিক অর্থে সর্বরূপেণ সংস্থিতা।
নীল আকাশের নীচে এই ভারতবর্ষের ওই তিন রঙের পতাকা কোমল হাওয়ায় পেলব দুলছে, এই মৃদু দৃশ্যটুকু দেখার জন্য অনেক রক্ত আর মাটির রঙের ডোরাকাটা দুরত্ব পার করে পথ বেয়ে যেতে যেতে, পথ হারিয়ে ফের খুঁজে নিয়ে গমনামনের জন্য, আমি, সবকিছু তুচ্ছ করে সর্বদা প্রস্তুত। কতো মানুষ, কতো হাহাকার; অথচ বন্ধ একটু দূরের দুয়ার বাতায়ন, সব; ‘বাড়ী আছো?’ বলে ডাকলেও সাড়া মেলে না; শ্রান্ত আমরা সবাই, অর্দ্ধ অন্তর্ধানে মিলিয়ে যেতে যেতে, জানি, ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে এসে কড়া নাড়বে আমার অন্দরে, আর এও জানি, মানুষের সে দলের মধ্যে থেকে আবারও কারোর ‘বাড়ী আছো?’ আহ্বানে আমার তন্দ্রাঘোর কেটে যাবে, আমার মনে পড়বে, শুধু আমি নই, আদতে ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট আশার খবর রাখতে জন্ম-ইস্তক আমরা সবাই নিয়োজিত। দরজা-জানালার ওপারে পৌঁছে যাচ্ছে কাতারে কাতার জমা মানুষের আর্তস্বর, তাদের আটপৌরে কথা, তাদের খিদে, তাদের চীৎকার… এটাই বন্ধ দরজার কপাট খুলে দেবে, ভেঙে দেবে বন্ধ জানালার গরাদ; পূরণ করতে পারা বা না পারা পরের কথা, আগে তো তাদের সবটুকু শুনতে চেয়ে তাদেরকে মানুষের মর্যাদাটুকু দেওয়া হোক। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার আয়োজন সম্পূর্ণ হলে সে ভারত ভ্রমণ সার্থক হিসাবেই আমি ধরে নেবো।
অনিন্দ্য ঘোষ ©
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেট (গুগুল ইমেজেস)
ঋণঃ আমি সজ্ঞানে বা অজান্তেই একপ্রকার, আমার বাক্যের শুরু, মাঝখান বা শেষে, বহু গায়ক / গায়িকার গানের অংশ ব্যবহার করে ফেলি। এখানেও যদি করে থাকি, তো, সেইসব গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক / গায়িকা ও সেইসব গানের অংশভুক সকলকে।